সরল গরল-সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব কার? by মিজানুর রহমান খান
আইএইচএস গ্লোবাল ইনসাইট আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন একটি অর্থনৈতিক পূর্বাভাস সংস্থা। বাংলাদেশের ক্যু-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সেনা সদর দপ্তরের ১৯ জানুয়ারির সংবাদ সম্মেলনের পরদিন তারা একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। এই সংস্থার বক্তব্য নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারণে নিউইয়র্ক টাইমস, এশিয়ান ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন প্রভৃতি মিডিয়া অহরহ তাদের বরাত দেয়। তারা বলেছে, অভ্যুত্থানের চেষ্টা বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশে তেমন বড় প্রভাব ফেলবে না।
তাদের বিশ্লেষণের আলোকে আমরা এটা বুঝতে চেষ্টা করব যে দুই বড় দলের বিভাজন ও মেরুকরণসর্বস্ব রাজনীতি সশস্ত্র বাহিনী নামের প্রতিষ্ঠানটির ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে। তারা বলেছে, ‘এ ঘটনা ঘটেছে এমন এক পরিবেশে যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।’
আমরা তাদের বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেব আরও একটি কারণে। এ সংস্থার সহযোগী প্রকাশনা হচ্ছে জেন্স ডিফেন্স উইকলি ও জেন্স ইন্টেলিজেন্স উইকলির মতো প্রভাবশালী সামরিক সাময়িকী (আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানেরা দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জেন্সকে সাক্ষাৎকার দিয়ে থাকেন)। আইএইচএস গ্লোবাল ইনসাইট বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছে, ‘বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ও ব্যর্থ অভ্যুত্থানগুলোর পেছনে রয়েছে জাতীয় পরিচয় নিয়ে মিশ্র সংগ্রামের জটিলতা, ক্ষমতার রাজনীতি এবং নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত। এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক চলে না যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সেনাবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সামরিক বাহিনী কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনায় বেসামরিক রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন দিয়ে আসছে।’ লক্ষণীয় মন্তব্য হলো, ‘বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে সর্বদাই কোহেশন বা দৃঢ়ভাবে একত্রে লেগে থাকার কার্যকারিতায় ঘাটতি দেখা গেছে। দলাদলি তাকে আরও চাঙা করেছে। দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এই পরিস্থিতিকে আরও তাড়িত করেছে। এই দুটি দলই সামরিক বাহিনীর মধ্যে নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তাদের ভেতরে সমর্থনের পরিধি বাড়ানো ও তাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে থাকে।’
বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এবারে প্রথম সেনা অভ্যন্তরের ঘটনাবলি সম্পর্কে জনসভায় ইঙ্গিত দেন। চট্টগ্রামের জনসভায় বলেছিলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এমনকি সেনা কর্মকর্তারাও এখন গুম হচ্ছেন। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন।’ ১০ জানুয়ারি ২০১২ আইএসপিআর বিরোধীদলীয় নেতার দাবি নাকচ করে। তাদের কথায়, ‘বেগম খালেদা জিয়ার অভিযোগ উসকানিমূলক ও বানোয়াট।’ তখনই মন্তব্য চাওয়া হলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এ বিষয়ে তাঁর কিছুই জানা নেই। তিনি এ বিষয়ে তথ্য জানতে সচেষ্ট হবেন।’ কিন্তু অদ্যাবধি আমরা বিএনপির তরফে নির্দিষ্ট তথ্য পাইনি। মন্তব্য পাচ্ছি বানের জলের মতো।
আইএসপিআর গত ১০ জানুয়ারি কার্যত সুনির্দিষ্টভাবে বিরোধী দলীয় নেতার বক্তব্য তথ্যগতভাবে অসত্য বলে দাবি করেছিল। সুতরাং আমরা জানতে আগ্রহী ছিলাম, এ রকম সুনির্দিষ্ট দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীদলীয় নেতা কী বক্তব্য দেন। তিনি নাম ও ঠিকানাসহ একটি তালিকা দেবেন কি না আমরা জানি না। তবে ১১ জানুয়ারি বিএনপি এক বিবৃতিতে আইএসপিআরের বিবৃতিকে ‘অবাঞ্ছিত এবং দুর্ভাগ্যজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে। কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসন আইএসপিআরকে খণ্ডন করতে গিয়ে আরও স্পর্শকাতর অভিযোগ করেন। তাঁর কথায়, গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এবং তাদের গুম হওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাদের পরিবার জানে না তারা কোথায় আছে। এই খবর সংবাদপত্রে এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। যদিও ‘ফেসবুক’ কথাটি বিএনপির বিবৃতিতে ছিল না। কিন্তু কেউ অনুমান করতে পারেন যে বিএনপির ১১ জানুয়ারির বিবৃতিতে ‘ফেসবুক’ বিষয়ে ইঙ্গিত ছিল। যে ফেসবুকের কথা আমরা ১৯ জানুয়ারি সেনা সদরের কাছ থেকে জেনেছি।
আইএইচএস গ্লোবাল ইনসাইট এ প্রসঙ্গে পিলখানা বিদ্রোহের প্রসঙ্গ টেনেছে। বেগম খালেদা জিয়াও কিন্তু টেনেছিলেন। চট্টগ্রামের ওই জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘পিলখানা বিদ্রোহের প্রতিবাদে যেসব সামরিক কর্মকর্তা সোচ্চার হয়েছিলেন সরকার তাঁদের বরখাস্ত এবং হয়রানি করছে।’ বিএনপির বিবৃতিতে অতঃপর বিস্ময় প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, বিএনপি কিংবা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয় যে বিএনপির চেয়ারপারসনের কোন বক্তব্যটি অসত্য। ওই সময় বিএনপি আরও বলেছিল, আইএসপিআর বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করেছিল। কারণ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে।
আইএসপিআর বলেছিল, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি নস্যাৎ করার অপচেষ্টা করেছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছিলেন। জাতি বিরোধী দলের নেতার কাছ থেকে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক, উসকানিমূলক ও অর্থহীন বিবৃতি আশা করে না। এর আট দিনের মাথায় ‘তথাকথিত ব্যর্থ অভ্যুত্থান’ (সেনা সদর দপ্তরের লিখিত বিবৃতির পরিভাষা) সম্পর্কে আইএসপিআর নয়, সেনা সদর দপ্তরের মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারে।
সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বরাবর অনুজ্জ্বল। এর ঐতিহাসিক কার্যকারণও রয়েছে। আইএইচএস গ্লোবাল ইনসাইট বলেছে, ‘শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা নিয়েই বাংলাদেশের বেসামরিক শাসকদের চিরায়ত অনুশীলন শুরু করে দেয়। যারা অন্য রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ও আদর্শের প্রতি বেশি মাত্রায় সমর্থক কিংবা তেমন বলে প্রতীয়মান হয়, তাদের হেনস্তা করার চেষ্টা করে। তবে এও ঠিক যে উল্লেখযোগ্য কোনো অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় সেনাবাহিনীতে বদলি কিংবা পদোন্নতিতে প্রকাশ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা থেকে নিজেকে সংযত রাখে। যদিও বাংলাদেশের স্থানীয় মিডিয়া সাম্প্রতিককালে বলেছে, সামরিক বাহিনীতে সরকারবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। সামরিক বাহিনী ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও বাড়ছে।’ পিলখানার বিদ্রোহ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন, ‘২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর হত্যাকাণ্ড হাসিনা সরকারের কর্তৃত্বের প্রতি প্রথম প্রকৃত পরীক্ষা ছিল। সেই ঘটনা সামরিক বহিনীর শক্তিশালী রাজনৈতিক ভূমিকাকে সামনে আনে, এর ভেতরের বিভক্তি এবং সরকারের সঙ্গে অব্যাহত উত্তেজনাকে হাইলাইট করে। যদিও শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেন। তবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আপসমূলক উদ্যোগের বিষয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরাট অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল।’ এরপর তারা লিখেছে, ‘যদিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শেখ হাসিনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে, তদুপরি এটা এখনো বাংলাদেশি সমাজের একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। বেসামরিক প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি-সামর্থ্যকে ব্যাপক দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক লালফিতা এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ টানাপোড়েনের মধ্যে রেখেছে। অতীতের অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থানের চেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা চলে যে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য সমগ্র সামরিক বহিনীকে সম্পৃক্ত করার দরকার নেই। এমনকি তুলনামূলক ক্ষুদ্রসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।’
আমরা আশা করব, দুই প্রধান দলই এটা মনে রাখবে। কারণ ওই পর্যবেক্ষণকে অস্বীকার করা চলে না। গত ২৩ জানুয়ারি আইএসপিআর গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ঐক্যের প্রতীক। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্মান সরাসরি সম্পৃক্ত। সামরিক শৃঙ্খলা রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে সেনা আইন অনুযায়ী বিচার ও শাস্তি দানের প্রক্রিয়া চলছে। আইএসপিআর বলেছে, সেনা সদর দপ্তরের নাম দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খবর বের হচ্ছে। এসব প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন ও দ্রুত তদন্তের স্বার্থে সমীচীন নয়। গত ২৩ জানুয়ারি একই দিনে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের কল্যাণ সমিতি রাওয়া ক্লাবের এক সেমিনারে লে. জেনারেল মঈনুল ইসলাম, যিনি ১৯ জানুয়ারির সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, তিনি ক্যু-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বক্তব্য দেন। সেখানে কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের দাবি জানান।
আমরা আশা করব, শুধু মিডিয়া নয়, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও সেনা আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে প্রকাশ্য মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে যত্নশীল হবেন। তবে এ মুহূর্তে সেটা সবচেয়ে বেশি সম্ভবত সরকারি দলের জন্য প্রযোজ্য হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ ৭ ফেব্রুয়ারি সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত জেনারেলদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ‘সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ড সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
যিনি যত দায়িত্বশীল পদে থাকেন, তাঁর তত দায়িত্বশীল, সংযত ও পরিমিত বক্তব্য দেওয়ার কথা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এর ঘাটতি সব সময় প্রকট ছিল ও আছে। এ বিষয়ে জনসমক্ষে যেকোনো ধরনের বক্তব্য সতর্কতার সঙ্গে দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মনে হচ্ছে না কোনো পক্ষই বাছবিচার করছে। মধ্য মার্চে বিরোধী দলের ‘ঢাকা চলো’ সমাবেশ। সরকারি দল অনেক দিন ধরেই বিরোধী দলের যেকোনো কর্মসূচিকে নির্বিচারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করার প্রচেষ্টার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা।
যথাসময়ে ফাঁস হয়ে যাওয়া ক্যু-ষড়যন্ত্রের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য সর্বাত্মক ও ব্যাপকভিত্তিক যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার দায়দায়িত্ব সরকারপ্রধান অবশ্যই সংরক্ষণ করেন। কিন্তু তিনি যখন রাজনৈতিক জনসভার ভাষা জেনারেলদের সম্মেলনে উচ্চারণ করেন বলে জনগণের কাছে প্রতীয়মান হয় কিংবা ধারণা সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি হয়, তখন মনে হতে পারে সরকার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে সুবিধা নিতে চাইছে।
সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার কাজ রাজনৈতিক দল ও তাদের নির্বাচিত সরকারকে পালন করতে হবে। সেনাবাহিনীতে সম্ভাব্য যত ধরনের অপরাধ হতে পারে, তার সবটার জন্যই সেনা আইনে শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। এর প্রক্রিয়া কোনোভাবেই সরকারের অনানুষ্ঠানিক হুকুমনির্ভর হওয়া উচিত নয়। ‘সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড’ একটি ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক পরিভাষা। এটা এভাবে প্রতিহত করার কাজ বিশ্বের কোনো সেনাবাহিনীর হওয়ার কথা নয়। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনী বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল। ২০১৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে এর ধারাবাহিকতা পরিত্যাজ্য।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আমরা তাদের বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেব আরও একটি কারণে। এ সংস্থার সহযোগী প্রকাশনা হচ্ছে জেন্স ডিফেন্স উইকলি ও জেন্স ইন্টেলিজেন্স উইকলির মতো প্রভাবশালী সামরিক সাময়িকী (আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানেরা দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জেন্সকে সাক্ষাৎকার দিয়ে থাকেন)। আইএইচএস গ্লোবাল ইনসাইট বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছে, ‘বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ও ব্যর্থ অভ্যুত্থানগুলোর পেছনে রয়েছে জাতীয় পরিচয় নিয়ে মিশ্র সংগ্রামের জটিলতা, ক্ষমতার রাজনীতি এবং নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত। এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক চলে না যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সেনাবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সামরিক বাহিনী কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনায় বেসামরিক রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন দিয়ে আসছে।’ লক্ষণীয় মন্তব্য হলো, ‘বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে সর্বদাই কোহেশন বা দৃঢ়ভাবে একত্রে লেগে থাকার কার্যকারিতায় ঘাটতি দেখা গেছে। দলাদলি তাকে আরও চাঙা করেছে। দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এই পরিস্থিতিকে আরও তাড়িত করেছে। এই দুটি দলই সামরিক বাহিনীর মধ্যে নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তাদের ভেতরে সমর্থনের পরিধি বাড়ানো ও তাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে থাকে।’
বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এবারে প্রথম সেনা অভ্যন্তরের ঘটনাবলি সম্পর্কে জনসভায় ইঙ্গিত দেন। চট্টগ্রামের জনসভায় বলেছিলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এমনকি সেনা কর্মকর্তারাও এখন গুম হচ্ছেন। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন।’ ১০ জানুয়ারি ২০১২ আইএসপিআর বিরোধীদলীয় নেতার দাবি নাকচ করে। তাদের কথায়, ‘বেগম খালেদা জিয়ার অভিযোগ উসকানিমূলক ও বানোয়াট।’ তখনই মন্তব্য চাওয়া হলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এ বিষয়ে তাঁর কিছুই জানা নেই। তিনি এ বিষয়ে তথ্য জানতে সচেষ্ট হবেন।’ কিন্তু অদ্যাবধি আমরা বিএনপির তরফে নির্দিষ্ট তথ্য পাইনি। মন্তব্য পাচ্ছি বানের জলের মতো।
আইএসপিআর গত ১০ জানুয়ারি কার্যত সুনির্দিষ্টভাবে বিরোধী দলীয় নেতার বক্তব্য তথ্যগতভাবে অসত্য বলে দাবি করেছিল। সুতরাং আমরা জানতে আগ্রহী ছিলাম, এ রকম সুনির্দিষ্ট দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীদলীয় নেতা কী বক্তব্য দেন। তিনি নাম ও ঠিকানাসহ একটি তালিকা দেবেন কি না আমরা জানি না। তবে ১১ জানুয়ারি বিএনপি এক বিবৃতিতে আইএসপিআরের বিবৃতিকে ‘অবাঞ্ছিত এবং দুর্ভাগ্যজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে। কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসন আইএসপিআরকে খণ্ডন করতে গিয়ে আরও স্পর্শকাতর অভিযোগ করেন। তাঁর কথায়, গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এবং তাদের গুম হওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাদের পরিবার জানে না তারা কোথায় আছে। এই খবর সংবাদপত্রে এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। যদিও ‘ফেসবুক’ কথাটি বিএনপির বিবৃতিতে ছিল না। কিন্তু কেউ অনুমান করতে পারেন যে বিএনপির ১১ জানুয়ারির বিবৃতিতে ‘ফেসবুক’ বিষয়ে ইঙ্গিত ছিল। যে ফেসবুকের কথা আমরা ১৯ জানুয়ারি সেনা সদরের কাছ থেকে জেনেছি।
আইএইচএস গ্লোবাল ইনসাইট এ প্রসঙ্গে পিলখানা বিদ্রোহের প্রসঙ্গ টেনেছে। বেগম খালেদা জিয়াও কিন্তু টেনেছিলেন। চট্টগ্রামের ওই জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘পিলখানা বিদ্রোহের প্রতিবাদে যেসব সামরিক কর্মকর্তা সোচ্চার হয়েছিলেন সরকার তাঁদের বরখাস্ত এবং হয়রানি করছে।’ বিএনপির বিবৃতিতে অতঃপর বিস্ময় প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, বিএনপি কিংবা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয় যে বিএনপির চেয়ারপারসনের কোন বক্তব্যটি অসত্য। ওই সময় বিএনপি আরও বলেছিল, আইএসপিআর বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করেছিল। কারণ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে।
আইএসপিআর বলেছিল, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি নস্যাৎ করার অপচেষ্টা করেছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছিলেন। জাতি বিরোধী দলের নেতার কাছ থেকে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক, উসকানিমূলক ও অর্থহীন বিবৃতি আশা করে না। এর আট দিনের মাথায় ‘তথাকথিত ব্যর্থ অভ্যুত্থান’ (সেনা সদর দপ্তরের লিখিত বিবৃতির পরিভাষা) সম্পর্কে আইএসপিআর নয়, সেনা সদর দপ্তরের মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারে।
সেনাবাহিনী ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বরাবর অনুজ্জ্বল। এর ঐতিহাসিক কার্যকারণও রয়েছে। আইএইচএস গ্লোবাল ইনসাইট বলেছে, ‘শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা নিয়েই বাংলাদেশের বেসামরিক শাসকদের চিরায়ত অনুশীলন শুরু করে দেয়। যারা অন্য রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ও আদর্শের প্রতি বেশি মাত্রায় সমর্থক কিংবা তেমন বলে প্রতীয়মান হয়, তাদের হেনস্তা করার চেষ্টা করে। তবে এও ঠিক যে উল্লেখযোগ্য কোনো অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় সেনাবাহিনীতে বদলি কিংবা পদোন্নতিতে প্রকাশ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা থেকে নিজেকে সংযত রাখে। যদিও বাংলাদেশের স্থানীয় মিডিয়া সাম্প্রতিককালে বলেছে, সামরিক বাহিনীতে সরকারবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। সামরিক বাহিনী ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও বাড়ছে।’ পিলখানার বিদ্রোহ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন, ‘২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর হত্যাকাণ্ড হাসিনা সরকারের কর্তৃত্বের প্রতি প্রথম প্রকৃত পরীক্ষা ছিল। সেই ঘটনা সামরিক বহিনীর শক্তিশালী রাজনৈতিক ভূমিকাকে সামনে আনে, এর ভেতরের বিভক্তি এবং সরকারের সঙ্গে অব্যাহত উত্তেজনাকে হাইলাইট করে। যদিও শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেন। তবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আপসমূলক উদ্যোগের বিষয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরাট অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল।’ এরপর তারা লিখেছে, ‘যদিও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শেখ হাসিনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে, তদুপরি এটা এখনো বাংলাদেশি সমাজের একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। বেসামরিক প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি-সামর্থ্যকে ব্যাপক দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক লালফিতা এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ টানাপোড়েনের মধ্যে রেখেছে। অতীতের অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থানের চেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা চলে যে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য সমগ্র সামরিক বহিনীকে সম্পৃক্ত করার দরকার নেই। এমনকি তুলনামূলক ক্ষুদ্রসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।’
আমরা আশা করব, দুই প্রধান দলই এটা মনে রাখবে। কারণ ওই পর্যবেক্ষণকে অস্বীকার করা চলে না। গত ২৩ জানুয়ারি আইএসপিআর গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ঐক্যের প্রতীক। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্মান সরাসরি সম্পৃক্ত। সামরিক শৃঙ্খলা রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে সেনা আইন অনুযায়ী বিচার ও শাস্তি দানের প্রক্রিয়া চলছে। আইএসপিআর বলেছে, সেনা সদর দপ্তরের নাম দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খবর বের হচ্ছে। এসব প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন ও দ্রুত তদন্তের স্বার্থে সমীচীন নয়। গত ২৩ জানুয়ারি একই দিনে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের কল্যাণ সমিতি রাওয়া ক্লাবের এক সেমিনারে লে. জেনারেল মঈনুল ইসলাম, যিনি ১৯ জানুয়ারির সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, তিনি ক্যু-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বক্তব্য দেন। সেখানে কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের দাবি জানান।
আমরা আশা করব, শুধু মিডিয়া নয়, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও সেনা আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে প্রকাশ্য মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে যত্নশীল হবেন। তবে এ মুহূর্তে সেটা সবচেয়ে বেশি সম্ভবত সরকারি দলের জন্য প্রযোজ্য হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ ৭ ফেব্রুয়ারি সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত জেনারেলদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ‘সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ড সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
যিনি যত দায়িত্বশীল পদে থাকেন, তাঁর তত দায়িত্বশীল, সংযত ও পরিমিত বক্তব্য দেওয়ার কথা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এর ঘাটতি সব সময় প্রকট ছিল ও আছে। এ বিষয়ে জনসমক্ষে যেকোনো ধরনের বক্তব্য সতর্কতার সঙ্গে দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মনে হচ্ছে না কোনো পক্ষই বাছবিচার করছে। মধ্য মার্চে বিরোধী দলের ‘ঢাকা চলো’ সমাবেশ। সরকারি দল অনেক দিন ধরেই বিরোধী দলের যেকোনো কর্মসূচিকে নির্বিচারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করার প্রচেষ্টার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা।
যথাসময়ে ফাঁস হয়ে যাওয়া ক্যু-ষড়যন্ত্রের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য সর্বাত্মক ও ব্যাপকভিত্তিক যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার দায়দায়িত্ব সরকারপ্রধান অবশ্যই সংরক্ষণ করেন। কিন্তু তিনি যখন রাজনৈতিক জনসভার ভাষা জেনারেলদের সম্মেলনে উচ্চারণ করেন বলে জনগণের কাছে প্রতীয়মান হয় কিংবা ধারণা সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি হয়, তখন মনে হতে পারে সরকার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে সুবিধা নিতে চাইছে।
সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার কাজ রাজনৈতিক দল ও তাদের নির্বাচিত সরকারকে পালন করতে হবে। সেনাবাহিনীতে সম্ভাব্য যত ধরনের অপরাধ হতে পারে, তার সবটার জন্যই সেনা আইনে শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। এর প্রক্রিয়া কোনোভাবেই সরকারের অনানুষ্ঠানিক হুকুমনির্ভর হওয়া উচিত নয়। ‘সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড’ একটি ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক পরিভাষা। এটা এভাবে প্রতিহত করার কাজ বিশ্বের কোনো সেনাবাহিনীর হওয়ার কথা নয়। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনী বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল। ২০১৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে এর ধারাবাহিকতা পরিত্যাজ্য।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments