হায় ফিলিস্তিন, আবার নতুন ষড়যন্ত্র by গাজীউল হাসান খান
ইসরায়েলের ইহুদিবাদী দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আগামী মাসে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এখন অত্যন্ত উদগ্রীব; কিন্তু ইতিহাসের এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানের পথে যথারীতি আবারও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন ইসরায়েলের ইহুদিবাদী নেতারা এবং তাঁদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য মিত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েল চায় না, এ বিষয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে তাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটুক। তারা জানে, এ ব্যাপারে সারা বিশ্ব ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। তাই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু চান জাতিসংঘের বাইরে এ বিষয়টি নিয়ে ফিলিস্তিনের সঙ্গে নতুন পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি আপস নিষ্পত্তিতে পেঁৗছাতে। অথচ ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেমসহ (আল-কুদস) তারা যেসব আরব ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছিল, তা ফিরিয়ে দেওয়া কিংবা সেখানে বসতি নির্মাণ বন্ধের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে এখনো কিছু বলছে না। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ফিলিস্তিনি নেতারা তাঁদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদের প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদে গেলে তাঁরা ভেটো দেবেন। তাই ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস ও প্রধানমন্ত্রী সালাম ফায়েদ পর্যবেক্ষকের মর্যাদা পেলেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটিতে যেতে চান। তাঁদের দৃঢ়বিশ্বাস, ১৯৬৭ সালে সংঘটিত যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেলে তাঁরা পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের কাজ বন্ধ করতে পারবেন।
এ ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন ইসরায়েলের ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ফিলিস্তিনিরা জাতিসংঘে যাওয়ার আগে ইসরায়েলিদের সঙ্গে শেষবারের মতো একটি চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনায় বসা প্রয়োজন। তাতে ইহুদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নে কিছু ভূমি বিনিময় করার প্রয়োজন পড়তে পারে। অপরদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, পূর্ব জেরুজালেমের ব্যাপার পর্যন্ত কতদূর কী করা যায়, তা ভেবে দেখা হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে এখনো মুখে কিছু বলছেন না। শুধু বলেছেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে যখন যেখানে খুশি আলোচনা হতে পারে।
এ ব্যাপারে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান মধ্যস্থতাকারী সায়েব এরেকাত স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন যে 'এ কথার ওপর আলোচনা শুরু হতে পারে না।' যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক মুখে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা মেনে নেওয়ার কথা বললেও পাশাপাশি আবার প্রয়োজনবোধে ভূমি বিনিময়ের কথাও উল্লেখ করেছেন। ওবামার কাছে এখন আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়টিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সে নির্বাচনে তাঁর ইহুদিদের অর্থ ও সমর্থন_দুটিই অত্যন্ত প্রয়োজন হবে বলে অনেকে মতপ্রকাশ করেছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্ববিরোধী ভূমিকা যথারীতি সবাইকে হতাশ করেছে।
ফিলিস্তিনি প্রধান মধ্যস্থতাকারী সায়েব এরেকাত বলেছেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘের বাইরে আলোচনার ব্যাপারে নিশ্চিত হলে তাঁকে সেপ্টেম্বর আসার আগেই স্পষ্ট করে কিছু জানাতে হবে। আর পূর্ব জেরুজালেম অর্থাৎ আল-কুদস্, যেখানে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী স্থাপন করার কথা, তার অবস্থানসহ ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা মেনে নিতে হবে। বন্ধ করতে হবে সব অবৈধ বসতি নির্মাণ। এই বসতি নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখার প্রশ্নেই গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ওবামা আয়োজিত সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। গত ২১ জুলাই বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আরব ইলেকট্রনিক মিডিয়া 'আল আরাবিয়াকে' একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন। তাঁর এবারের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে প্রথমবারের মতো আয়োজিত সে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা যদি জাতিসংঘে স্বীকৃতির জন্য না যায়, তাহলে তিনি ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা নিয়েও আলোচনা করতে রাজি আছেন। তারপর ইসরায়েল কিংবা তাঁর দিক থেকে আর কোনো উদ্যোগের কথা শোনা যায়নি। এর আগে তিনি ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা নিয়ে কথা উঠলেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া ইহুদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দিক থেকে 'অপ্রতিরোধ্য' হয়ে উঠবে বলে উল্লেখ করতেন। তা ছাড়া ইসরায়েলের ইহুদিবাদী এবং দক্ষিণপন্থী নেতারা বারবারই বলেছেন, জেরুজালেমকে বিভক্ত করা চলবে না। তাঁদের মতে, দুই হাজার বছর আগেও জেরুজালেম ছিল তাঁদের ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী; কিন্তু একটি কথা তাঁরা ভুলে যান, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কিছুটা উত্থান-পতনসহ এক হাজার ৩০০ বছর বৃহত্তর ফিলিস্তিনে ইসলামী শাসন বলবৎ ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করেই প্রতিষ্ঠা হতে হবে আগামী দিনের স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র_এ অভিমত আপামর ফিলিস্তিনবাসীর। মক্কায় কেবলা স্থানান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত যেহেতু জেরুজালেম ছিল বিশ্ব মুসলিমদের প্রার্থনা বা নামাজের প্রথম পবিত্র কেবলা, সেহেতু কোনোমতেই ইহুদি আগ্রাসনের কাছে তা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সে পূর্ব জেরুজালেমেই মসজিদুল আকসার পাশে রয়েছে 'ডোম অব দ্য রক', যেখান থেকে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সানি্নধ্য লাভের জন্য মেরাজ গমন করেছিলেন বলে কথিত রয়েছে। পূর্ব জেরুজালেমের সেসব ঐতিহাসিক ও পবিত্র স্থান ছাড়া ফিলিস্তিন বা আরবদের কাছে সুপরিচিত 'ফিলিস্তিন' রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হবে অর্থহীন।
১৯৭৪ সালের ফিলিস্তিন বিভক্তির পর জাতিসংঘ ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনের জন্য যে ভূখণ্ড চিহ্নিত করেছিল, ১৯৬৭ সালে ইসরাইয়েলের চাপিয়ে দেওয়া ছয় দিনের যুদ্ধের আগে তা মাত্র ২২ শতাংশে পেঁৗছেছিল। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানাকে মেনে নিয়েছিল স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য সীমানা নির্ধারণের স্বার্থে। ২০০০ সালে সে সীমানাকে চূড়ান্ত ধরেই তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে ওয়াশিংটনে শান্তি আলোচনায় বসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আলোচনা সফল হয়নি। এহুদ বারাক পরে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থীদের নিয়ে গঠিত জোট সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হলেও নেতানিয়াহু তাঁর কোনো পরামর্শ না নিয়ে নিজ কৌশলে শান্তি আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। তাতে তিনি ফিলিস্তিনকে ২২ শতাংশ ভূমির ৬০ ভাগও দিতে রাজি হননি, উপরন্তু দখলকৃত পশ্চিম তীর ও বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমের (আল-কুদস) যে আরব অংশ, তার পুরোটাতেই (বৃহত্তর বা অখণ্ড জেরুজালেম) ইসরায়েলের রাজধানী স্থাপন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পূর্ব জেরুজালেম পশ্চিম তীরে প্রেসিডেন্ট ওবামার অনুরোধে ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের পর ইসরায়েল সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের নীতিগত বিরোধিতার মুখে আবার বসতি নির্মাণের কাজ শুরু করলে গত ডিসেম্বরে বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক মহল বেশ কিছুটা সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। তারপর ওয়াশিংটনের আমেরিকান-ইসরায়েলি প্রভাবশালী লবির কারণে প্রেসিডেন্ট ওবামার ভূমিকা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নেতানিয়াহু পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে আরো নিত্যনতুন বসতি স্থাপনের ঘোষণা দেন। (ফিলিস্তিন : এক সংগ্রামের ইতিহাস, প্রকাশক : দিব্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১১)।
ছয় দশক ধরে ফিলিস্তিন সমস্যা বিশ্বের একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিরাজ করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর 'ব্যালফোর ঘোষণা' অনুযায়ী ফিলিস্তিনে 'ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসভূমি' গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
ফিলিস্তিনের আরব উপদ্বীপের অধিবাসীরা তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তার মধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল নামে ইহুদিদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফিলিস্তিনকে ইহুদিরা তাদের পূর্বপুরুষদের 'প্রতিশ্রুত ভূমি' হিসেবে উল্লেখ করেছে বারবার। ইহুদিদের অব্যাহত ভূমি দখলের কারণে লাখ লাখ আরব দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ফিলিস্তিনসহ আরবদের মধ্যে বিরাজিত অনৈক্য এবং ইহুদিদের বিভিন্ন সড়যন্ত্র ও বাধার কারণে গত ৬০ বছরেও ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয়নি। চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিগত চারটি যুদ্ধে অসংখ্য আরব প্রাণ হারায়। সে কারণেই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে স্থানীয় আবরদের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাবার্তা চলছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান হতে পারে। আবার কেউ কেউ ফিলিস্তিনে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছেন। কিন্তু ইহুদিবাদীরা কোনোমতেই তাদের 'ইহুদি রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার বাসনা বা সিদ্ধান্ত ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। আরব রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসভূমি বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নিলেও ইহুদিরা ফিলিস্তিনে তাদের দখলকৃত বাড়তি ভূমি কিংবা পুণ্যনগরী জেরুজালেমকে নিয়ে তত দিনে নতুন করে একটি অনড় অবস্থান সৃষ্টি করেছিল। আর বিভিন্ন সময়ে তাতে সমর্থন জুগিয়েছিল ইহুদি পুঁজি ও শক্তির কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের পারস্পরিক স্বার্থের প্রশ্নে কী কী গোপন চুক্তি রয়েছে, তা তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের প্রতি শত অপরাধ সংঘটিত করলেও যুক্তরাষ্ট্র সব অবস্থায়ই শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলিদেরই বাঁচাতে চেষ্টা করে। সে কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের উত্থাপিত সব প্রস্তাবেই ভেটো প্রদান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে গাজা আক্রমণ করে ইসরায়েলি সৈন্যরা অমানবিকভাবে এক হাজার ৪০০ নিরপরাধ মানুষ হত্যা করলেও যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নিন্দা জানায়নি। বরং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ গৃহীত হলেও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে তাকে বাঁচানোর বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করেছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে গত মাসে দোহায় অনুষ্ঠিত আরব লীগের ফিলিস্তিনবিষয়ক সভায় অভিযোগ করা হয়েছে।
এবারও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রশ্নে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলিদের কথা না মেনে নিরাপত্তা পরিষদে গেলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। সে কারণেই বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ফিলিস্তিন অথরিটি (পিএ) নিরাপত্তা পরিষদে না গিয়ে সাধারণ পরিষদে তাদের বিষয়টি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই। বিভিন্ন চক্রান্ত ও কূটকৌশলের ফাঁদে ফেলে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তি আরো দীর্ঘতর করার অপচেষ্টা চলছে। তা ছাড়া সামনে আসছে শীত মৌসুম। গাজা আক্রমণের প্রায় তিন বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এখনো সরিয়ে নেওয়া হয়নি ইসরায়েলের বোমা হামলায় সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপ। শুরু হয়নি ব্যাপক কোনো পুনর্বাসনের কাজ। সেখানে এখন লাখ লাখ গাজাবাসী মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এত খাদ্যসংকট ও কর্মসংস্থানের অভাবের মধ্যেও তাদের চারদিক থেকে অবরোধ করে রাখা হয়েছে। গত বছরের ৩১ মে তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে যাত্রাকারী মাভি মারমারার নেতৃত্বে 'ফ্রিডম ফ্লোটিলা' নামক ছয়টি জলযানের একটি বেসরকারি নৌবহর খাদ্য, ওষুধ, হুইল চেয়ার, নির্মাণসামগ্রী এবং ৬০০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গাজা পেঁৗছার অনেক আগেই আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের ওপর হামলা চালায় ইসরায়েলি কমান্ডো বাহিনী।
এতে ৯ জন প্রাণ হারায় এবং আহত হয় অনেক স্বেচ্ছাসেবক নারী-পুরুষ। যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এসব কারণে মাঝেমধ্যে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র যেন ইসরায়েলি স্বার্থের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সে স্বার্থগুলো কী, তা জানা প্রকৃত অর্থে এখনো কারো পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় না। যাক, এখন থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘে অনুষ্ঠেয় সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন পর্যন্ত সময়ে ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে হয়তো অনেক উদ্যোগ নেওয়া হবে, হয়তো বা ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে অনেক সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে। বিশ্বব্যাপী নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন শান্তিবাদী মানুষ তার সাফল্য কামনা করে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gayiulhkhan@gmail.com
এ ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন ইসরায়েলের ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ফিলিস্তিনিরা জাতিসংঘে যাওয়ার আগে ইসরায়েলিদের সঙ্গে শেষবারের মতো একটি চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনায় বসা প্রয়োজন। তাতে ইহুদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নে কিছু ভূমি বিনিময় করার প্রয়োজন পড়তে পারে। অপরদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, পূর্ব জেরুজালেমের ব্যাপার পর্যন্ত কতদূর কী করা যায়, তা ভেবে দেখা হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে এখনো মুখে কিছু বলছেন না। শুধু বলেছেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে যখন যেখানে খুশি আলোচনা হতে পারে।
এ ব্যাপারে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান মধ্যস্থতাকারী সায়েব এরেকাত স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন যে 'এ কথার ওপর আলোচনা শুরু হতে পারে না।' যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক মুখে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা মেনে নেওয়ার কথা বললেও পাশাপাশি আবার প্রয়োজনবোধে ভূমি বিনিময়ের কথাও উল্লেখ করেছেন। ওবামার কাছে এখন আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়টিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সে নির্বাচনে তাঁর ইহুদিদের অর্থ ও সমর্থন_দুটিই অত্যন্ত প্রয়োজন হবে বলে অনেকে মতপ্রকাশ করেছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের স্ববিরোধী ভূমিকা যথারীতি সবাইকে হতাশ করেছে।
ফিলিস্তিনি প্রধান মধ্যস্থতাকারী সায়েব এরেকাত বলেছেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘের বাইরে আলোচনার ব্যাপারে নিশ্চিত হলে তাঁকে সেপ্টেম্বর আসার আগেই স্পষ্ট করে কিছু জানাতে হবে। আর পূর্ব জেরুজালেম অর্থাৎ আল-কুদস্, যেখানে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী স্থাপন করার কথা, তার অবস্থানসহ ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা মেনে নিতে হবে। বন্ধ করতে হবে সব অবৈধ বসতি নির্মাণ। এই বসতি নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখার প্রশ্নেই গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ওবামা আয়োজিত সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। গত ২১ জুলাই বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আরব ইলেকট্রনিক মিডিয়া 'আল আরাবিয়াকে' একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন। তাঁর এবারের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে প্রথমবারের মতো আয়োজিত সে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা যদি জাতিসংঘে স্বীকৃতির জন্য না যায়, তাহলে তিনি ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা নিয়েও আলোচনা করতে রাজি আছেন। তারপর ইসরায়েল কিংবা তাঁর দিক থেকে আর কোনো উদ্যোগের কথা শোনা যায়নি। এর আগে তিনি ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা নিয়ে কথা উঠলেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া ইহুদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দিক থেকে 'অপ্রতিরোধ্য' হয়ে উঠবে বলে উল্লেখ করতেন। তা ছাড়া ইসরায়েলের ইহুদিবাদী এবং দক্ষিণপন্থী নেতারা বারবারই বলেছেন, জেরুজালেমকে বিভক্ত করা চলবে না। তাঁদের মতে, দুই হাজার বছর আগেও জেরুজালেম ছিল তাঁদের ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী; কিন্তু একটি কথা তাঁরা ভুলে যান, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কিছুটা উত্থান-পতনসহ এক হাজার ৩০০ বছর বৃহত্তর ফিলিস্তিনে ইসলামী শাসন বলবৎ ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করেই প্রতিষ্ঠা হতে হবে আগামী দিনের স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র_এ অভিমত আপামর ফিলিস্তিনবাসীর। মক্কায় কেবলা স্থানান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত যেহেতু জেরুজালেম ছিল বিশ্ব মুসলিমদের প্রার্থনা বা নামাজের প্রথম পবিত্র কেবলা, সেহেতু কোনোমতেই ইহুদি আগ্রাসনের কাছে তা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সে পূর্ব জেরুজালেমেই মসজিদুল আকসার পাশে রয়েছে 'ডোম অব দ্য রক', যেখান থেকে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সানি্নধ্য লাভের জন্য মেরাজ গমন করেছিলেন বলে কথিত রয়েছে। পূর্ব জেরুজালেমের সেসব ঐতিহাসিক ও পবিত্র স্থান ছাড়া ফিলিস্তিন বা আরবদের কাছে সুপরিচিত 'ফিলিস্তিন' রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হবে অর্থহীন।
১৯৭৪ সালের ফিলিস্তিন বিভক্তির পর জাতিসংঘ ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনের জন্য যে ভূখণ্ড চিহ্নিত করেছিল, ১৯৬৭ সালে ইসরাইয়েলের চাপিয়ে দেওয়া ছয় দিনের যুদ্ধের আগে তা মাত্র ২২ শতাংশে পেঁৗছেছিল। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানাকে মেনে নিয়েছিল স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য সীমানা নির্ধারণের স্বার্থে। ২০০০ সালে সে সীমানাকে চূড়ান্ত ধরেই তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে ওয়াশিংটনে শান্তি আলোচনায় বসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আলোচনা সফল হয়নি। এহুদ বারাক পরে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থীদের নিয়ে গঠিত জোট সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হলেও নেতানিয়াহু তাঁর কোনো পরামর্শ না নিয়ে নিজ কৌশলে শান্তি আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। তাতে তিনি ফিলিস্তিনকে ২২ শতাংশ ভূমির ৬০ ভাগও দিতে রাজি হননি, উপরন্তু দখলকৃত পশ্চিম তীর ও বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমের (আল-কুদস) যে আরব অংশ, তার পুরোটাতেই (বৃহত্তর বা অখণ্ড জেরুজালেম) ইসরায়েলের রাজধানী স্থাপন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পূর্ব জেরুজালেম পশ্চিম তীরে প্রেসিডেন্ট ওবামার অনুরোধে ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের পর ইসরায়েল সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের নীতিগত বিরোধিতার মুখে আবার বসতি নির্মাণের কাজ শুরু করলে গত ডিসেম্বরে বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক মহল বেশ কিছুটা সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। তারপর ওয়াশিংটনের আমেরিকান-ইসরায়েলি প্রভাবশালী লবির কারণে প্রেসিডেন্ট ওবামার ভূমিকা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নেতানিয়াহু পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে আরো নিত্যনতুন বসতি স্থাপনের ঘোষণা দেন। (ফিলিস্তিন : এক সংগ্রামের ইতিহাস, প্রকাশক : দিব্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ২০১১)।
ছয় দশক ধরে ফিলিস্তিন সমস্যা বিশ্বের একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিরাজ করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর 'ব্যালফোর ঘোষণা' অনুযায়ী ফিলিস্তিনে 'ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসভূমি' গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
ফিলিস্তিনের আরব উপদ্বীপের অধিবাসীরা তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তার মধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল নামে ইহুদিদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফিলিস্তিনকে ইহুদিরা তাদের পূর্বপুরুষদের 'প্রতিশ্রুত ভূমি' হিসেবে উল্লেখ করেছে বারবার। ইহুদিদের অব্যাহত ভূমি দখলের কারণে লাখ লাখ আরব দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ফিলিস্তিনসহ আরবদের মধ্যে বিরাজিত অনৈক্য এবং ইহুদিদের বিভিন্ন সড়যন্ত্র ও বাধার কারণে গত ৬০ বছরেও ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয়নি। চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিগত চারটি যুদ্ধে অসংখ্য আরব প্রাণ হারায়। সে কারণেই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে স্থানীয় আবরদের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাবার্তা চলছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতে, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান হতে পারে। আবার কেউ কেউ ফিলিস্তিনে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছেন। কিন্তু ইহুদিবাদীরা কোনোমতেই তাদের 'ইহুদি রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার বাসনা বা সিদ্ধান্ত ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। আরব রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসভূমি বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নিলেও ইহুদিরা ফিলিস্তিনে তাদের দখলকৃত বাড়তি ভূমি কিংবা পুণ্যনগরী জেরুজালেমকে নিয়ে তত দিনে নতুন করে একটি অনড় অবস্থান সৃষ্টি করেছিল। আর বিভিন্ন সময়ে তাতে সমর্থন জুগিয়েছিল ইহুদি পুঁজি ও শক্তির কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের পারস্পরিক স্বার্থের প্রশ্নে কী কী গোপন চুক্তি রয়েছে, তা তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের প্রতি শত অপরাধ সংঘটিত করলেও যুক্তরাষ্ট্র সব অবস্থায়ই শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলিদেরই বাঁচাতে চেষ্টা করে। সে কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের উত্থাপিত সব প্রস্তাবেই ভেটো প্রদান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে গাজা আক্রমণ করে ইসরায়েলি সৈন্যরা অমানবিকভাবে এক হাজার ৪০০ নিরপরাধ মানুষ হত্যা করলেও যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নিন্দা জানায়নি। বরং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ গৃহীত হলেও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে তাকে বাঁচানোর বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করেছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে গত মাসে দোহায় অনুষ্ঠিত আরব লীগের ফিলিস্তিনবিষয়ক সভায় অভিযোগ করা হয়েছে।
এবারও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রশ্নে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলিদের কথা না মেনে নিরাপত্তা পরিষদে গেলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। সে কারণেই বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ফিলিস্তিন অথরিটি (পিএ) নিরাপত্তা পরিষদে না গিয়ে সাধারণ পরিষদে তাদের বিষয়টি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই। বিভিন্ন চক্রান্ত ও কূটকৌশলের ফাঁদে ফেলে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তি আরো দীর্ঘতর করার অপচেষ্টা চলছে। তা ছাড়া সামনে আসছে শীত মৌসুম। গাজা আক্রমণের প্রায় তিন বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এখনো সরিয়ে নেওয়া হয়নি ইসরায়েলের বোমা হামলায় সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপ। শুরু হয়নি ব্যাপক কোনো পুনর্বাসনের কাজ। সেখানে এখন লাখ লাখ গাজাবাসী মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এত খাদ্যসংকট ও কর্মসংস্থানের অভাবের মধ্যেও তাদের চারদিক থেকে অবরোধ করে রাখা হয়েছে। গত বছরের ৩১ মে তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে যাত্রাকারী মাভি মারমারার নেতৃত্বে 'ফ্রিডম ফ্লোটিলা' নামক ছয়টি জলযানের একটি বেসরকারি নৌবহর খাদ্য, ওষুধ, হুইল চেয়ার, নির্মাণসামগ্রী এবং ৬০০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গাজা পেঁৗছার অনেক আগেই আন্তর্জাতিক জলসীমায় তাদের ওপর হামলা চালায় ইসরায়েলি কমান্ডো বাহিনী।
এতে ৯ জন প্রাণ হারায় এবং আহত হয় অনেক স্বেচ্ছাসেবক নারী-পুরুষ। যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এসব কারণে মাঝেমধ্যে মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র যেন ইসরায়েলি স্বার্থের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সে স্বার্থগুলো কী, তা জানা প্রকৃত অর্থে এখনো কারো পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় না। যাক, এখন থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘে অনুষ্ঠেয় সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন পর্যন্ত সময়ে ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে হয়তো অনেক উদ্যোগ নেওয়া হবে, হয়তো বা ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে অনেক সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে। বিশ্বব্যাপী নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন শান্তিবাদী মানুষ তার সাফল্য কামনা করে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gayiulhkhan@gmail.com
No comments