একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-বাংলায় আইন রচনা by কাজী এবাদুল হক

ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে কোম্পানির প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম এ দেশে বাংলা ভাষায় আইন প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন ফার্সি ভাষায় রচিত অনেক আইন গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন তৎকালীন কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারী ডানকান মেয়ার, অ্যাডমনস্টোন, ফরস্টার প্রমুখ।


তৎকালীন প্রচলিত আইন বাংলায় অনুবাদের উদ্দেশ্য ছিল, যেন নিম্ন আদালতে আইনচর্চায় তৎকালীন আদালতের ভাষা ফার্সির সঙ্গে বাংলা ভাষায় আইনচর্চা হতে পারে। ১৮৩৭ সাল থেকে সরকারি ভাষা ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি করা হলে এবং এ দেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রসার লাভ করলে বাংলা ভাষায় আইন গ্রন্থ রচনা কমে যায় এবং ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কয়েকবছর পর পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সঙ্গে বাংলা স্বীকৃত হলে এবং ১৯৬৯ সাল থেকে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষায়ও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বিধান করা হলে আইনের ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য কিছু কিছু আইনের বইপুস্তক বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হতে শুরু হয়।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তার পরে বাংলা ভাষা চালু হবে—সে হবে না।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই বঙ্গবন্ধুর নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশের অফিস-আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার চালু হয় এবং সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ ঘোষিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে আইন-আদালতে বাংলা ব্যবহারের জোয়ার আসে। এমনকি হাইকোর্টের দৈনিক শুনানির তালিকাও বাংলায় প্রকাশিত হতে থাকে। তখন থেকে বাংলায় আইন গ্রন্থ রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মরহুম গাজী শামছুর রহমান। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গাজী শামছুর রহমান দীর্ঘদিন নিম্ন আদালতের বিচারক হিসেবে কর্মরত থাকার সময় নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষায় আইনচর্চার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। আদালতে যেসব আইন গ্রন্থের ব্যবহার বেশি, সে রকম প্রায় ৪০টি আইন গ্রন্থ তিনি রচনা ও প্রকাশ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আইন গ্রন্থ ছিল দেওয়ানি কার্যবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি, যা আদালতে আইনচর্চায় একান্ত অপরিহার্য। তাঁর কতিপয় আইন গ্রন্থসহ বাংলা একাডেমী কিছু কিছু আইন গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আইন গ্রন্থ হচ্ছে: অধস্তন আদালতের ওপর একজন বিচারক, আবদুল হামিদ রচিত আইন কোষ এবং ঢাকার একজন লেখক রচিত ডি এফ মুল্লার মোহামেডান লর বাংলায় অনুবাদ। তা ছাড়া বিচারপতি কাজী এবাদুল হক রচিত বিচারব্যবস্থার বিবর্তন, ভূমি আইন ও ভূমিব্যবস্থার ক্রমবিকাশ এবং নজির আইন সংহিতা উল্লেখযোগ্য। বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পাদিত কানাডিয়ান সাহায্য সংস্থা সিডার অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত আইন শব্দকোষ একটি মূল্যবান আইনের বাংলা পরিভাষা গ্রন্থ।
এসব আইন গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন লেখক আইনের অনেক গ্রন্থ, আদালতে আইনচর্চা-সম্পর্কিত গ্রন্থ, নির্বাচনসংক্রান্ত আইন, চাকরিসংক্রান্ত আইন প্রভৃতি বিষয়ে রচনাও প্রকাশ করেছেন এবং এখনো করছেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইন গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করার জন্য কোনো ব্যবস্থা না হলে শুধু ব্যক্তি উদ্যোগে আইন গ্রন্থ রচনা করে বাংলা ভাষায় আইন গ্রন্থের অভাব পূরণ করা যাবে না। আইন-আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার চর্চা বিস্তৃত করার জন্য, বিশেষত আইন গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ করার জন্য সরকারি উদ্যোগে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একান্ত আবশ্যক।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষায় প্রচলন আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ সরকার যেসব আইন, বিধিবিধান, পরিপত্র, বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি প্রকাশ করছে, তা বাংলায় প্রকাশ অব্যাহত আছে।

No comments

Powered by Blogger.