মনমোহন-কারজাই চুক্তি-আফগান-অভিসারের মূল্য ভারতকে দিতে হবে by সিমন টিসডাল
হামিদ কারজাইয়ের কমজোরি সরকারের দায়দায়িত্ব নেওয়া, এবং কার্যত তাদের জিম্মাদার হওয়ার ভারতীয় সিদ্ধান্তের পুরোটাই একেবারে হাওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে হয়নি। গত বুধবার দুই দেশের মধ্যে যে কৌশলগত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, তাতে উভয় দেশ সন্ত্রাস দমন ও বাণিজ্য বিষয়ে সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছে।
এই চুক্তি মোতাবেক আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দেবে দিল্লি। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার ফাঁক তৈরি হবে, তা পূরণের দায়িত্ব নিচ্ছে ভারত। এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি এবং উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে ভারত এটা করছে নিজের স্বার্থেই। কিন্তু সদ্য স্বাক্ষরিত ভারত-আফগান চুক্তি ভালো চোখে দেখবে না পাকিস্তান বা তালেবান। এই দুঃসাহসের জন্য ভারতকে হয়তো চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
ইসলামাবাদ ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা অথবা ‘নাক গলানো’কে ব্যাপক সন্দেহ নিয়ে দেখছে। পাকিস্তান তার এই প্রতিবেশীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে যাওয়াকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ভীতিসহ দেখছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে এতটাই তার নিজের পেছন-আঙিনা মনে করে যে, এর ওপর প্রভাব টিকিয়ে রাখতে হাক্কানি নেটওয়ার্কের মতো সন্দেহভাজন জঙ্গি গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতেও দ্বিধা করছে না। কাবুল সরকারকে দুর্বল ও ভারসাম্যহীন করাতেই পাকিস্তানের সামর্থ্য।
আফগানিস্তান নিয়ে দ্বিমুখী খেলা খেলছে পাকিস্তান। এই কাজের কৌশল হিসেবে সন্ত্রাসবাদ ব্যবহার করা এখনো বন্ধ করেনি তারা। ভারত সফরে আসার সপ্তাহ খানেক আগে কারজাই এমন অভিযোগ তুলেছিলেন যে পাকিস্তান কিংবা এর নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একাংশ আফগানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী বোরহানউদ্দিন রাব্বানির হত্যার সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে ভারত ২০০৮ ও ২০০৯ সালে কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসে হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক থাকার অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তান অবশ্য সব অভিযোগই অস্বীকার করে।
কারজাই অবশ্য দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে তাঁর ভারত-মুখিনতার লক্ষ্য ইসলামাবাদ নয়। তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমাদের যমজ ভাই আর ভারত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গতকাল স্বাক্ষর করা আমাদের কৌশলগত চুক্তিটি কোনো দেশের বিরুদ্ধে নয়। এটা কারও বিরুদ্ধেই যাবে না। আমরা ভারতের কাছ থেকে বরং আফগানিস্তানের সুবিধা নিশ্চিত করেছি।’
কারজাইয়ের এই হঠাৎ কৌশলী হয়ে ওঠা তাঁর চরিত্রমাধুর্য নয়। বরং এর মধ্যে সেই রাজনৈতিক বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে যে পাকিস্তানের সহযোগিতা ও সম্মতি ছাড়া আফগানিস্তানে কোনো স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের দুই লেখকের লেখায় মার্কিন হতাশাই ব্যক্ত হয়েছে যে ‘আফগানিস্তানের জন্য কোনো বিকল্প কর্মকৌশল প্রণয়ন কিংবা সেখানে একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের অনিচ্ছাই প্রকাশিত হয়।’
কারজাইয়ের প্রচেষ্টা মনে হয় তেতো ওষুধকে মিষ্টি করে খাওয়ানো। রাব্বানির হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও তিনি বহু ধারার তালেবানদের সঙ্গে একটা সমঝোতারই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর তালেবানও ভোলেনি যে নব্বইয়ের দশকে অপশতু নর্দান অ্যালায়েন্সের পেছনে ছিল ভারত এবং তারাই আমেরিকার সাহায্য নিয়ে ২০০১-এ তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। তাই দিল্লিতে সম্পাদিত চুক্তিকে তারা দেখবে আফগান রাজনীতিতে ভারতের আরও বেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে। আরও বেশি করে বিদেশি হস্তক্ষেপের এই আয়োজন তারা প্রত্যাখ্যান করবে। ওদিকে কারজাইও গত সপ্তাহে বিস্বাদ মুখে স্বীকার করেছেন, তাঁর দেশে কখনো শান্তি আনতে হলে আমেরিকা বা ভারত নয়, কথা বলতে হবে পাকিস্তানের সঙ্গে।
২০০১-এর পর থেকেই ভারত আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করা বাড়িয়েছে। তারা আঞ্চলিক দূতাবাস খুলেছে, সড়ক ও অবকাঠামো বানাচ্ছে এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা হিসেবে দুই বিলিয়ন ডলারের সাহায্য দিয়েছে। কিন্তু এই সপ্তাহের চুক্তিটি তার থেকেও বেশি এবং ঝুঁকিপূর্ণ একটা পদক্ষেপ। আফগানিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা স্থলসেনা পাঠানোর কোনো কথা নয়াদিল্লির কেউ তোলেনি। কিন্তু আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া মানে স্পষ্টতই ন্যাটোর উত্তরাধিকার গ্রহণ করা। সুতরাং বিদ্রোহীদের ক্রোধের লক্ষ্যও ন্যাটোর পর ভারতই হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কারজাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতে এসব সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক একটা খোলা বইয়ের মতো...আমাদের মধ্যে রয়েছে সভ্যতার সম্পর্ক এবং আমরা উভয়ই থাকতে এসেছি...২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর আফগানরা যখন নিজেদের প্রশাসন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে, তখন ভারত তাদের সহযোগিতা দেবে।’ এসব কথার মূল্য ভারতকে দিতে হবে, যখনই মার্কিনরা আফগানিস্তান ছাড়বে।
এ বছরের শুরুতে বিন লাদেনের আবাস যে পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটি শহরে, তা জানার পর থেকেই পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কে অনেক চড়াই-উতরাই তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে স্বদেশেও আফগান যুদ্ধ অনেক অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় আমেরিকা খুব খুশি যে তার নতুন বন্ধু ভারত তারই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে। বারাক ওবামাও আশ্বস্ত হলেন যে আফগান যুদ্ধ একেবারে বৃথা যাচ্ছে না, সেটা এখন চলবে নিশ্চিত আঞ্চলিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে।
ভারতীয় নেতারা হয়তো একদিন টের পাবেন যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যদের ফেলে দেওয়া গরম আলু তুলে নেওয়া তাদের জন্য কতটা ভুল ছিল। পাকিস্তানকে ডিঙানোর মূল্য মনে হয় তাদের চড়াভাবেই শোধ করতে হবে।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
সিমন টিসডাল: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
ইসলামাবাদ ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা অথবা ‘নাক গলানো’কে ব্যাপক সন্দেহ নিয়ে দেখছে। পাকিস্তান তার এই প্রতিবেশীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে যাওয়াকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ভীতিসহ দেখছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে এতটাই তার নিজের পেছন-আঙিনা মনে করে যে, এর ওপর প্রভাব টিকিয়ে রাখতে হাক্কানি নেটওয়ার্কের মতো সন্দেহভাজন জঙ্গি গোষ্ঠীকে ব্যবহার করতেও দ্বিধা করছে না। কাবুল সরকারকে দুর্বল ও ভারসাম্যহীন করাতেই পাকিস্তানের সামর্থ্য।
আফগানিস্তান নিয়ে দ্বিমুখী খেলা খেলছে পাকিস্তান। এই কাজের কৌশল হিসেবে সন্ত্রাসবাদ ব্যবহার করা এখনো বন্ধ করেনি তারা। ভারত সফরে আসার সপ্তাহ খানেক আগে কারজাই এমন অভিযোগ তুলেছিলেন যে পাকিস্তান কিংবা এর নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একাংশ আফগানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী বোরহানউদ্দিন রাব্বানির হত্যার সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে ভারত ২০০৮ ও ২০০৯ সালে কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসে হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক থাকার অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তান অবশ্য সব অভিযোগই অস্বীকার করে।
কারজাই অবশ্য দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে তাঁর ভারত-মুখিনতার লক্ষ্য ইসলামাবাদ নয়। তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমাদের যমজ ভাই আর ভারত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গতকাল স্বাক্ষর করা আমাদের কৌশলগত চুক্তিটি কোনো দেশের বিরুদ্ধে নয়। এটা কারও বিরুদ্ধেই যাবে না। আমরা ভারতের কাছ থেকে বরং আফগানিস্তানের সুবিধা নিশ্চিত করেছি।’
কারজাইয়ের এই হঠাৎ কৌশলী হয়ে ওঠা তাঁর চরিত্রমাধুর্য নয়। বরং এর মধ্যে সেই রাজনৈতিক বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে যে পাকিস্তানের সহযোগিতা ও সম্মতি ছাড়া আফগানিস্তানে কোনো স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের দুই লেখকের লেখায় মার্কিন হতাশাই ব্যক্ত হয়েছে যে ‘আফগানিস্তানের জন্য কোনো বিকল্প কর্মকৌশল প্রণয়ন কিংবা সেখানে একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের অনিচ্ছাই প্রকাশিত হয়।’
কারজাইয়ের প্রচেষ্টা মনে হয় তেতো ওষুধকে মিষ্টি করে খাওয়ানো। রাব্বানির হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও তিনি বহু ধারার তালেবানদের সঙ্গে একটা সমঝোতারই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর তালেবানও ভোলেনি যে নব্বইয়ের দশকে অপশতু নর্দান অ্যালায়েন্সের পেছনে ছিল ভারত এবং তারাই আমেরিকার সাহায্য নিয়ে ২০০১-এ তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। তাই দিল্লিতে সম্পাদিত চুক্তিকে তারা দেখবে আফগান রাজনীতিতে ভারতের আরও বেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে। আরও বেশি করে বিদেশি হস্তক্ষেপের এই আয়োজন তারা প্রত্যাখ্যান করবে। ওদিকে কারজাইও গত সপ্তাহে বিস্বাদ মুখে স্বীকার করেছেন, তাঁর দেশে কখনো শান্তি আনতে হলে আমেরিকা বা ভারত নয়, কথা বলতে হবে পাকিস্তানের সঙ্গে।
২০০১-এর পর থেকেই ভারত আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করা বাড়িয়েছে। তারা আঞ্চলিক দূতাবাস খুলেছে, সড়ক ও অবকাঠামো বানাচ্ছে এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা হিসেবে দুই বিলিয়ন ডলারের সাহায্য দিয়েছে। কিন্তু এই সপ্তাহের চুক্তিটি তার থেকেও বেশি এবং ঝুঁকিপূর্ণ একটা পদক্ষেপ। আফগানিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা স্থলসেনা পাঠানোর কোনো কথা নয়াদিল্লির কেউ তোলেনি। কিন্তু আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া মানে স্পষ্টতই ন্যাটোর উত্তরাধিকার গ্রহণ করা। সুতরাং বিদ্রোহীদের ক্রোধের লক্ষ্যও ন্যাটোর পর ভারতই হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কারজাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতে এসব সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক একটা খোলা বইয়ের মতো...আমাদের মধ্যে রয়েছে সভ্যতার সম্পর্ক এবং আমরা উভয়ই থাকতে এসেছি...২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর আফগানরা যখন নিজেদের প্রশাসন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে, তখন ভারত তাদের সহযোগিতা দেবে।’ এসব কথার মূল্য ভারতকে দিতে হবে, যখনই মার্কিনরা আফগানিস্তান ছাড়বে।
এ বছরের শুরুতে বিন লাদেনের আবাস যে পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটি শহরে, তা জানার পর থেকেই পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কে অনেক চড়াই-উতরাই তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে স্বদেশেও আফগান যুদ্ধ অনেক অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় আমেরিকা খুব খুশি যে তার নতুন বন্ধু ভারত তারই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে। বারাক ওবামাও আশ্বস্ত হলেন যে আফগান যুদ্ধ একেবারে বৃথা যাচ্ছে না, সেটা এখন চলবে নিশ্চিত আঞ্চলিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে।
ভারতীয় নেতারা হয়তো একদিন টের পাবেন যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যদের ফেলে দেওয়া গরম আলু তুলে নেওয়া তাদের জন্য কতটা ভুল ছিল। পাকিস্তানকে ডিঙানোর মূল্য মনে হয় তাদের চড়াভাবেই শোধ করতে হবে।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
সিমন টিসডাল: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
No comments