বাংলাদেশের জনসংখ্যা আসলে কত? by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
বাংলাদেশের জনসংখ্যা আসলে কত? আমরা যারা প্রবাসে আছি, তারা স্বীকার করবেন যে প্রায়ই এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় সবাইকে। আর এ প্রশ্নের উত্তরে এসে সত্যিই এক গোলকধাঁধায় পড়তে হয়। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। আবার কেউ কেউ বলছেন, ১৫ কোটি। আর সরকার বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি। এ বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ীই সরকারি এই সংখ্যা বেরিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের আদমশুমারি, সেও এক মজার কাণ্ড। ২০০১-এ যে আদমশুমারি হয়েছিল তাতে দেখা যায়, সে সময় বরিশালের জনসংখ্যা ছিল ৮১ লাখ ৭৪ হাজার আর এবারের ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বরিশালের জনসংখ্যা ৮১ লাখ ৪৭ হাজার। তার মানে হিসাব করলে দেখা যায়, গত দশ বছরে বরিশালের জনসংখ্যা কমে গেছে ২৭ হাজার। বেসরকারি হিসাবে বরিশালে জন্মহার যেখানে ১.৪০ শতাংশের মতো, সেখানে বরিশালে জনসংখ্যা না বেড়ে কমে গেল কেন, সেটা এক তাজ্জব ব্যাপার। আর এর কোনো ব্যাখ্যাও নেই সরকারিভাবে। সুতরাং এবারের আদমশুমারি যে প্রহসনের আদমশুমারি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আদমশুমারি হচ্ছে সোজা বাংলায় জনসংখ্যা গণনার কাজ। এ কাজে যতটা সময় দেওয়ার দরকার ছিল, ততটা সময় দেওয়া হয়নি। আর এ জন্য যা হওয়ার কথা ছিল, তা-ই হয়েছে। এবারের ২০১১-এর আদমশুমারিটি সত্যিকারের আদমশুমারি বা জনগণনার কাজ না হয়ে বরং হয়েছে সরকারি অর্থ আর সময়ের অপচয়। অনেক নাগরিককেই আনা হয়নি এবারের গণনায়। এমনকি আদমশুমারির ফল ঘোষণার দিন সংসদ সদস্য তারানা হালিম নিজেই আপত্তি দিয়েছিলেন যে তাঁর পরিবারকে গণনা করা হয়নি। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের অনেক সংসদ সদস্যও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবারের আদমশুমারি নিয়ে। যার ফলে ইতিমধ্যে এবারের আদমশুমারি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সরকারিভাবে এবারের আদমশুমারি মেনে নেওয়া হয়েছে। এবারের আদমশুমারি নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হলেও সরকারিভাবে সেসবের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি আজও। বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে, গাণিতিক হারে নয়। কিন্তু সরকারি হিসাবে চোখ বুলালে দেখা যায় অন্য চিত্র। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৯৭৪ সালে ছিল ৭.১৪ কোটি। ১৯৮১-তে এসে তা দাঁড়ায় ৮.৭১ কোটিতে। ১৯৯১ সালে সেটি ছিল ১০.৬৩ কোটি। পরে ২০০১ সালে তা দাঁড়ায় ১২.৪৩ কোটিতে আর সর্বশেষ এবারের ২০১১-এর আদমশুমারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১৪.২৩ কোটিতে।
প্রতি দশকে প্রতিটি সরকারই আদমশুমারি বা বাংলাদেশের জনসংখ্যা হিসাবের সময় আগের হিসাবের সঙ্গে অতিরিক্ত দুই কোটিকে কেবল যোগ করেছে আগের হিসাবের সঙ্গে। যেটা আগেই বলেছি, জনসংখ্যা সরকারি হিসাব মতো গাণিতিকভাবে বাড়েনি, বরং বেড়েছে আরো বহুগুণ। যার সত্যিকারের হিসাব আজও শুভঙ্করের ফাঁকি হয়ে আছে।
বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে প্রতি দশকে জনসংখ্যা দুই কোটি করে বেড়েছে। কিন্তু পরের দশকে মূল জনসংখ্যার সঙ্গে আগের দশকের দুই কোটি থেকে উদ্ভূত নতুন জনসংখ্যা যোগ করা হয়নি। সরকার যে হিসাব দাঁড় করিয়েছে তাতে মনে হবে, প্রতি দশকে যোগ হওয়া দুই কোটি লোক অবিবাহিত থাকছে অথবা সেসব লোক বিয়ে করলেও সন্তান-সন্ততির জন্ম দিচ্ছে না।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, চোখ বন্ধ করেই এসব গণনা চালানো হয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতিসংঘ ও অন্যান্য এনজিও থেকে যেসব টাকা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য, সেসব অর্থের সদ্ব্যবহার হচ্ছে_এটা দেখানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে না সেটা বোঝাতে সরকার এ রকম মনোভাব গ্রহণ করেছে। আর এটা করতে গিয়ে আমরা সত্যিকার অর্থে কতটুকু লাভবান হচ্ছি সেটাই প্রশ্ন।
আমাদের দেশে বর্তমানে এক কোটি লোক বেকার। আরো কয়েক কোটি বসবাস করছে দারিদ্র্যসীমার নিচে।
জনসংখ্যা গণনায় মূল সংখ্যা উঠে এলে সরকার সত্যিকারের একটি চিত্র পেতে পারত। আর এর ফলে জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়লে সে ক্ষেত্রে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু ২০১১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী যেহেতু বাংলাদেশে মানুষ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে না, তাই সরকারের পক্ষ থেকে নামকাওয়াস্তে প্রচারণা ছাড়া জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জরুরি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।
বিনোদনের অভাব, অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্ক, ধর্মীয় গোঁড়ামি_এসব কারণেই বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। বিশ্বজুড়ে যখন খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে আর অর্থনৈতিক মন্দা প্রবল হয়ে উঠছে, তখন বাংলাদেশে জনসংখ্যা গণনার এ লুকোচুরি সত্যিই প্রশ্নসাপেক্ষ।
যাহোক, আমাদের ক্ষমতাসীন দল অথবা বিরোধী দলের এসব বিষয় নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তারা ব্যস্ত কেবল ভোটের পরিসংখ্যানে। দেশের জনসংখ্যা গণনার মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও তাদের মাথা ঘামানোর সময় নেই। সত্যিই সেলুকাস, বিচিত্র আমাদের বাংলাদেশ!
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া, shahnewaybiplob@hotmail.com
আদমশুমারি হচ্ছে সোজা বাংলায় জনসংখ্যা গণনার কাজ। এ কাজে যতটা সময় দেওয়ার দরকার ছিল, ততটা সময় দেওয়া হয়নি। আর এ জন্য যা হওয়ার কথা ছিল, তা-ই হয়েছে। এবারের ২০১১-এর আদমশুমারিটি সত্যিকারের আদমশুমারি বা জনগণনার কাজ না হয়ে বরং হয়েছে সরকারি অর্থ আর সময়ের অপচয়। অনেক নাগরিককেই আনা হয়নি এবারের গণনায়। এমনকি আদমশুমারির ফল ঘোষণার দিন সংসদ সদস্য তারানা হালিম নিজেই আপত্তি দিয়েছিলেন যে তাঁর পরিবারকে গণনা করা হয়নি। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের অনেক সংসদ সদস্যও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবারের আদমশুমারি নিয়ে। যার ফলে ইতিমধ্যে এবারের আদমশুমারি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সরকারিভাবে এবারের আদমশুমারি মেনে নেওয়া হয়েছে। এবারের আদমশুমারি নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হলেও সরকারিভাবে সেসবের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি আজও। বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে, গাণিতিক হারে নয়। কিন্তু সরকারি হিসাবে চোখ বুলালে দেখা যায় অন্য চিত্র। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৯৭৪ সালে ছিল ৭.১৪ কোটি। ১৯৮১-তে এসে তা দাঁড়ায় ৮.৭১ কোটিতে। ১৯৯১ সালে সেটি ছিল ১০.৬৩ কোটি। পরে ২০০১ সালে তা দাঁড়ায় ১২.৪৩ কোটিতে আর সর্বশেষ এবারের ২০১১-এর আদমশুমারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১৪.২৩ কোটিতে।
প্রতি দশকে প্রতিটি সরকারই আদমশুমারি বা বাংলাদেশের জনসংখ্যা হিসাবের সময় আগের হিসাবের সঙ্গে অতিরিক্ত দুই কোটিকে কেবল যোগ করেছে আগের হিসাবের সঙ্গে। যেটা আগেই বলেছি, জনসংখ্যা সরকারি হিসাব মতো গাণিতিকভাবে বাড়েনি, বরং বেড়েছে আরো বহুগুণ। যার সত্যিকারের হিসাব আজও শুভঙ্করের ফাঁকি হয়ে আছে।
বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে প্রতি দশকে জনসংখ্যা দুই কোটি করে বেড়েছে। কিন্তু পরের দশকে মূল জনসংখ্যার সঙ্গে আগের দশকের দুই কোটি থেকে উদ্ভূত নতুন জনসংখ্যা যোগ করা হয়নি। সরকার যে হিসাব দাঁড় করিয়েছে তাতে মনে হবে, প্রতি দশকে যোগ হওয়া দুই কোটি লোক অবিবাহিত থাকছে অথবা সেসব লোক বিয়ে করলেও সন্তান-সন্ততির জন্ম দিচ্ছে না।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, চোখ বন্ধ করেই এসব গণনা চালানো হয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতিসংঘ ও অন্যান্য এনজিও থেকে যেসব টাকা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য, সেসব অর্থের সদ্ব্যবহার হচ্ছে_এটা দেখানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে না সেটা বোঝাতে সরকার এ রকম মনোভাব গ্রহণ করেছে। আর এটা করতে গিয়ে আমরা সত্যিকার অর্থে কতটুকু লাভবান হচ্ছি সেটাই প্রশ্ন।
আমাদের দেশে বর্তমানে এক কোটি লোক বেকার। আরো কয়েক কোটি বসবাস করছে দারিদ্র্যসীমার নিচে।
জনসংখ্যা গণনায় মূল সংখ্যা উঠে এলে সরকার সত্যিকারের একটি চিত্র পেতে পারত। আর এর ফলে জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়লে সে ক্ষেত্রে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু ২০১১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী যেহেতু বাংলাদেশে মানুষ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে না, তাই সরকারের পক্ষ থেকে নামকাওয়াস্তে প্রচারণা ছাড়া জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জরুরি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।
বিনোদনের অভাব, অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্ক, ধর্মীয় গোঁড়ামি_এসব কারণেই বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। বিশ্বজুড়ে যখন খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে আর অর্থনৈতিক মন্দা প্রবল হয়ে উঠছে, তখন বাংলাদেশে জনসংখ্যা গণনার এ লুকোচুরি সত্যিই প্রশ্নসাপেক্ষ।
যাহোক, আমাদের ক্ষমতাসীন দল অথবা বিরোধী দলের এসব বিষয় নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তারা ব্যস্ত কেবল ভোটের পরিসংখ্যানে। দেশের জনসংখ্যা গণনার মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও তাদের মাথা ঘামানোর সময় নেই। সত্যিই সেলুকাস, বিচিত্র আমাদের বাংলাদেশ!
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া, shahnewaybiplob@hotmail.com
No comments