গতিবৈষম্য-সড়কযন্ত্রণা: গতি ও দুর্গতির ফাঁস by ফারুক ওয়াসিফ
আমাদের সড়কগুলো আমাদের জীবনের দুর্দশার যতটা দারুণ, ততটাই করুণ এক প্রতীক। কার্ল মার্কস লিখেছিলেন তাঁর এথনোগ্র্যাফিক নোটবুকস-এ যে বাঙালিরা নাকি সরলরেখা আঁকতে জানে না। আজও আমাদের সড়ক আর জমির আইলগুলো আমাদের বাঁকা মন ও বাঁকা নজরের প্রতিবিম্ব হয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে, সরলরৈখিকতা আমাদের ধাতে নেই।
সরল চিন্তাও করতে পারি কি না সন্দেহ। বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা দুনিয়ার অনেকখানেই অনেক ইমারত-সড়ক-সেতু ইত্যাদি বানিয়ে তারিফ পেলেও, দেশে বড় সড়ক-সেতু বানাতে আমরা চীনা-জাপানি-কোরীয় কি ভারতীয়দের ডাকাডাকি করি। মার্কস জানতেন না, আমরা জানি, আমাদের সব সরকার মহাশয় আর আমলানিচয়ের ঘুরপথেই ঝোঁক বেশি, সোজা পথে তাঁরা যান না। সড়ক ব্যবস্থাপনার বেলায়ও তাঁরা সেই খাসলতের প্রমাণ রাখেন।আমাদের যাবতীয় নৈরাজ্যের ব্যারোমিটার আমাদের জাতীয় সড়কগুলো। আমাদের লেন-বাইলেন এবং অলিগলিরও মোড়ে মোড়ে, বাঁকে বাঁকে নৈরাজ্য। সমাজ এখানে উপচে এসে রাস্তার বৈষম্যরক্ষক শৃঙ্খলা ভাঙে।
সড়কে সবচেয়ে যা নেই, তা হলো গণতন্ত্র। অসম ক্ষমতা আর অসম সুযোগের বিকট এক বন্দোবস্তের মধ্যে সেখানে আমাদের চলাচল করতে হয়। মুরগির খাঁচার মতো বাসের জানালায় সারি সারি বিরক্ত ও বিষণ্ন মুখগুলো কিংবা ট্রাকে গরুর মতো গাদাগাদি দাঁড়িয়ে থাকা ‘ওরা’ আর পরিহাস করে ভুস করে চলে যাওয়া আলিশান গাড়িগুলোর ‘তারা’র মধ্যে বিরাট ফারাক। যাঁরা বিত্তবান ও ক্ষমতাশালী, সড়কজুড়ে তাঁদেরই প্রতাপ বেশি। ঢাকা শহরের প্রায় সব সড়কের ৮০ ভাগ জায়গা দখলে থাকে ব্যক্তিগত গাড়ির, যেগুলোকে আমরা প্রাইভেটকার বলি। প্রাইভেটকারের প্রাদুর্ভাবে ক্রমশ ‘প্রাইভেটাইজড’ হয়ে যাওয়া সড়কগুলোর যানজটের প্রধান কারণও এগুলোই। চলমান অবস্থায় অথবা রাস্তার পাশে পার্ক করে থাকার মাধ্যমে সড়কে এগুলোর প্রাধান্য বজায় থাকে। বাসে যতটা জায়গায় ১২ থেকে ১৪ জন বসতে পারে, রাস্তায় ততটা জায়গা নিয়ে একেকটা প্রাইভেটকারে একজন বা দুজন চলাচল করেন। বাস-সিএনজিচালিত অটোরিকশা প্রভৃতি পাবলিক পরিবহনকে এসব চকচকে কারের গায়ের লাবণ্য বাঁচিয়ে সাবধানে চলাচল করতে হয়, একটু ঘষা খেলেই সর্বনাশ। এর মধ্যে আবার কিছু কিছু সড়ক ভিআইপি, সেখানেও এসব প্রাইভেটকারের প্রাইভেট-সুবিধার প্রাইভেটাইজেশন। তার ওপর ভিআইপি-ভিভিআইপিদের জন্য ট্রাফিক নিয়ম প্রায়শই শিথিল। আগে-পিছে হুইসেল বাজিয়ে প্রধানমন্ত্রী বা পেরাষ্ট্রপতি যখন যান, তখন মনে হয় রাজপথ বুঝি রাজাদেরই! আগে জমিদারদের সামনে বাহনে চড়ে যাওয়া যেত না, নেমে হেঁটে পার হতে হতো তাঁদের দৃষ্টির সীমানা। এখন তাঁদের গতায়াতের পথের নিরাপত্তা ও দ্রুততার জন্য লাখো মানুষকে গতিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, মরণাপন্ন ব্যক্তিদের অ্যাম্বুলেন্সেরও তখন ছাড় নেই। সাধারণ মানুষকে স্থবির করে দেওয়া এই গতিই গতিবৈষম্য। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এর শিকার।
এই অবস্থা বুঝিয়ে দেয়, কে দামি আর কে কম দামি নাগরিক। সবার মবিলিটি বা চলমানতা এখানে সমান নয়। বিত্তই ঠিক করে দেয় সড়কে কার কতটা সম্মান, কে কতটা গতির অধিকারী। গতি এখন চড়া দামে কিনতে হয়। অদূর ভবিষ্যতে বিশেষ বিশেষ রাস্তায় নামতেও ফি দিতে হবে, নির্মীয়মাণ উড়ালসড়কগুলো নিয়ে তেমনটাই ভাবা হচ্ছে। এই অবস্থা সাধারণ যাত্রীদের সড়কের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেয়। এঁরাই রাস্তার নিম্নবর্গ, এঁদের মধ্যে আরও করুণ অবস্থা হয় নারী-শিশু ও বৃদ্ধদের। আমাদের সড়ক, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও গণপরিবহনগুলো তাঁদের প্রতি বৈরী।
সড়কই আমাদের সবচেয়ে সহিংস অঞ্চল। নিয়মের বালাই নেই, সবার আগে পৌঁছানোর তাড়নায় গাড়িতে গাড়িতে ধাক্কাধাক্কি, বড় গাড়িওয়ালার ছোট গাড়িওয়ালাকে চাপাচাপি, বাসে ওঠার জন্য যাত্রীদের পাল্লাপাল্লিতে, সড়কে সবারই মেজাজের ঘড়ি বারোটায় চড়ে বসে থাকে। প্রত্যেকেই তখন প্রত্যেকের শত্রু। দামি ও বড় গাড়ি কোণঠাসা করে কম দামি ও ছোট গাড়ি এবং সেগুলোর কম ‘দামি’ যাত্রীদের। রাস্তার থেকে শ্রেণীবিভাজিত তঞ্চল আর কী আছে?
গতির বদলে রাস্তা হয়েছে দুর্গতির খনি। জীবনের বড় একটা সময় এখানেই খরচ হয়ে যায়। ঢাকার লোকজনের গড়পরতা দিনে দুই থেকে তিন ঘণ্টা রাস্তায় থাকতে হয়। এই হিসাবে কেউ যদি ৪০ বছর যাতায়াত করে, তাহলে রাস্তায় ব্যয় হওয়ার কথা কমপক্ষে চার বছর সময়। আদর্শ অবস্থায় হয়তো এর অর্ধেকটা সময় লাগার কথা ছিল। এই বিচারে রাস্তায় থমকে থাকা বাবদ আমাদের জীবন থেকে প্রায় দুই বছর সময় অপচয় হয়ে যায়। স্বল্প আয়ুর এই জীবন থেকে এভাবে প্রত্যেকের দুটি বছর, মানে কোটি মানুষের কোটি কোটি বছর যে চলে গেল, তা কে ফিরিয়ে দেবে? এ সময়টুকুর অর্থনৈতিক মূল্যও কি কম?
কেবল জীবনের মূল্যবান বছরই নয়, মূল্যবান অনেক জীবনও খেয়ে নেয় এই নৈরাজ্য। গড়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫ জন মারা যাচ্ছে, তার মানে বছরে প্রায় ২০ হাজার জন। এগুলো থানায় মামলা হওয়ার পরিসংখ্যান, পুলিশ বা গণমাধ্যমের অগোচরে রয়ে যাওয়া মৃত্যুগুলো যোগ করলে সংখ্যাটা আরও ভীতিকর হওয়ার কথা। এই মৃত্যু কেবল যুদ্ধের গণহত্যার সঙ্গেই তুলনীয়। ঝাঁকুনিতে হাড় ক্ষয় করে আর অকাতরে প্রাণ নিতে নিতে সড়কগুলো যে মোটামুটি উইপন অব ম্যাস ডেসট্রাকশন বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র হয়ে উঠেছে, সেই আক্কেল জনগণের হলেও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা তা স্বীকার করতে চান না। তাঁরা তো আর ভুক্তভোগী নন। তাই জাতীয় সংসদে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী অবলীলায় বলতে পারেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে প্রতিবাদের কিছু নেই’। তাহলে কি ভুক্তভোগীদের অবলীলায় মরে যাওয়াই উচিত!
দুই.
জাতীয় জীবনের মিলনস্থলও কিন্তু সড়কই। শহরাঞ্চলে সড়ক ছাড়া মানুষে মানুষে পাশাপাশি-ঘেঁষাঘেঁষি হওয়ার আর জায়গা নেই। ঘরবাড়ি যার যার, সড়কই একমাত্র স্থান, যেখানে মানুষের সাড়াশব্দ টের পাওয়া যায়। সড়কই সমাজ এবং সেই সমাজ সর্বদাই চলমান। কয়েক দশক আগেও ঢাকা শহরে কিছু ময়দান ছিল, যেখানে উৎসবে ও প্রতিবাদে গণজমায়েত হতে পারত। সেই মাঠের দুঃখ মাঠেই মারা গেছে। অথচ এই জাতির রাজনৈতিক জন্ম কিন্তু হয়েছিল ময়দানেই। ঢাকার রেসকোর্সের ময়দান, পল্টন ময়দানের জাতীয় জমায়েতগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামের একেকটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছিল। ময়দানের এই রাজনৈতিক চরিত্র ঢাকতে এখন রেসকোর্স ময়দানকে করা হয়েছে পার্ক আর পল্টন ময়দানে নিষিদ্ধ হয়েছে জনসভা। জাতি আজ দিনমান রাস্তায় দৌড়ে বেড়ায় আর ছোট ছোট ঘরবাড়িতে সেঁধয়, ময়দানে একত্র হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ তাদের নেই। রাজনীতির জমায়েত তাই ময়দান-বঞ্চিত হয়ে রাস্তায় নেমেছে। খেয়াল করার বিষয়, মিসরে আন্দোলনের শক্তি প্রমাণের জায়গা হয় তাহরির চত্বর আর আমাদের বিরোধীদের লক্ষ্য রাজপথ। কার্যকরভাবে রাস্তা দখল করতে পারলে রাষ্ট্রক্ষমতাও দখল করা যায় এবং তাতে জীবনও যায়। সম্প্রতি ঢাকা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও রাজশাহীতে এ রকম রাস্তা দখলের যুদ্ধে পাঁচটি প্রাণ ঝরে গেছে। রাজনীতির চিরাচরিত যুদ্ধক্ষেত্র তাই রাস্তা। সেখানে সংঘাত হবে যন্ত্র ও মানুষে, বন্দুক ও বুকে।
তবে রাস্তার এই রাজনৈতিক চরিত্রও বদলাচ্ছে। আগে রাস্তার লড়াইয়ে সরকারি পুলিশের চেয়ে বিরোধীদলীয় পিকেটারদের সুবিধা ছিল বেশি। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সাফল্যের এটাও ছিল একটি কারণ। ধাওয়ার মুখে পালিয়ে যাওয়া, আবার ফিরে এসে রাস্তার দখল নেওয়ার কৌশল ঢাকায় এখন প্রায় অকার্যকর। এখন মূল সড়কগুলোয় যেভাবে কাঁটাতার দেওয়া ডিভাইডার বসেছে, যেভাবে অলিগলির সঙ্গে বড় রাস্তার সহজ চলাচল কঠিন করা হয়েছে, তাতে রাস্তার লড়াইয়ের কৌশলগত সুবিধার ভরকেন্দ্রটা পুলিশেরই বেশি। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস একদা খেয়াল করেছিলেন, ফরাসি বিপ্লবের জয়ের পেছনে বিপ্লবীদের ব্যারিকেডগুলোর অবদান ছিল। কিন্তু পরে সেসব রাস্তার ধরন এমন করা হয়, যাতে ব্যারিকেড গড়াই আর সম্ভব হয় না। দেশের বড় শহরগুলোতে এমনটাই ঘটেছে। আমাদের আধুনিক নগর পরিকল্পনায় নিরাপত্তা স্পর্শকাতরতা টের পাওয়া যায় সড়কগুলোকে বদলে যাওয়া বিন্যাসে।
তিন.
রাস্তার নৈরাজ্য, বৈষম্য ও নিরাপত্তাভীতি—এই তিনের ফল একটাই, সড়কগুলোর ক্রমশ জীবনের জন্য বিপজ্জনক, মনের ওপর পীড়াদায়ক এবং অধিকারের দিক থেকে অগণতান্ত্রিক হয়ে ওঠা। সড়ক অনেকটা জীবনের রক্তনালির মতো, ওই তিন ফাঁসে একে আটকে রেখে কত দূর যেতে পারব আমরা?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
সড়কে সবচেয়ে যা নেই, তা হলো গণতন্ত্র। অসম ক্ষমতা আর অসম সুযোগের বিকট এক বন্দোবস্তের মধ্যে সেখানে আমাদের চলাচল করতে হয়। মুরগির খাঁচার মতো বাসের জানালায় সারি সারি বিরক্ত ও বিষণ্ন মুখগুলো কিংবা ট্রাকে গরুর মতো গাদাগাদি দাঁড়িয়ে থাকা ‘ওরা’ আর পরিহাস করে ভুস করে চলে যাওয়া আলিশান গাড়িগুলোর ‘তারা’র মধ্যে বিরাট ফারাক। যাঁরা বিত্তবান ও ক্ষমতাশালী, সড়কজুড়ে তাঁদেরই প্রতাপ বেশি। ঢাকা শহরের প্রায় সব সড়কের ৮০ ভাগ জায়গা দখলে থাকে ব্যক্তিগত গাড়ির, যেগুলোকে আমরা প্রাইভেটকার বলি। প্রাইভেটকারের প্রাদুর্ভাবে ক্রমশ ‘প্রাইভেটাইজড’ হয়ে যাওয়া সড়কগুলোর যানজটের প্রধান কারণও এগুলোই। চলমান অবস্থায় অথবা রাস্তার পাশে পার্ক করে থাকার মাধ্যমে সড়কে এগুলোর প্রাধান্য বজায় থাকে। বাসে যতটা জায়গায় ১২ থেকে ১৪ জন বসতে পারে, রাস্তায় ততটা জায়গা নিয়ে একেকটা প্রাইভেটকারে একজন বা দুজন চলাচল করেন। বাস-সিএনজিচালিত অটোরিকশা প্রভৃতি পাবলিক পরিবহনকে এসব চকচকে কারের গায়ের লাবণ্য বাঁচিয়ে সাবধানে চলাচল করতে হয়, একটু ঘষা খেলেই সর্বনাশ। এর মধ্যে আবার কিছু কিছু সড়ক ভিআইপি, সেখানেও এসব প্রাইভেটকারের প্রাইভেট-সুবিধার প্রাইভেটাইজেশন। তার ওপর ভিআইপি-ভিভিআইপিদের জন্য ট্রাফিক নিয়ম প্রায়শই শিথিল। আগে-পিছে হুইসেল বাজিয়ে প্রধানমন্ত্রী বা পেরাষ্ট্রপতি যখন যান, তখন মনে হয় রাজপথ বুঝি রাজাদেরই! আগে জমিদারদের সামনে বাহনে চড়ে যাওয়া যেত না, নেমে হেঁটে পার হতে হতো তাঁদের দৃষ্টির সীমানা। এখন তাঁদের গতায়াতের পথের নিরাপত্তা ও দ্রুততার জন্য লাখো মানুষকে গতিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, মরণাপন্ন ব্যক্তিদের অ্যাম্বুলেন্সেরও তখন ছাড় নেই। সাধারণ মানুষকে স্থবির করে দেওয়া এই গতিই গতিবৈষম্য। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এর শিকার।
এই অবস্থা বুঝিয়ে দেয়, কে দামি আর কে কম দামি নাগরিক। সবার মবিলিটি বা চলমানতা এখানে সমান নয়। বিত্তই ঠিক করে দেয় সড়কে কার কতটা সম্মান, কে কতটা গতির অধিকারী। গতি এখন চড়া দামে কিনতে হয়। অদূর ভবিষ্যতে বিশেষ বিশেষ রাস্তায় নামতেও ফি দিতে হবে, নির্মীয়মাণ উড়ালসড়কগুলো নিয়ে তেমনটাই ভাবা হচ্ছে। এই অবস্থা সাধারণ যাত্রীদের সড়কের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেয়। এঁরাই রাস্তার নিম্নবর্গ, এঁদের মধ্যে আরও করুণ অবস্থা হয় নারী-শিশু ও বৃদ্ধদের। আমাদের সড়ক, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও গণপরিবহনগুলো তাঁদের প্রতি বৈরী।
সড়কই আমাদের সবচেয়ে সহিংস অঞ্চল। নিয়মের বালাই নেই, সবার আগে পৌঁছানোর তাড়নায় গাড়িতে গাড়িতে ধাক্কাধাক্কি, বড় গাড়িওয়ালার ছোট গাড়িওয়ালাকে চাপাচাপি, বাসে ওঠার জন্য যাত্রীদের পাল্লাপাল্লিতে, সড়কে সবারই মেজাজের ঘড়ি বারোটায় চড়ে বসে থাকে। প্রত্যেকেই তখন প্রত্যেকের শত্রু। দামি ও বড় গাড়ি কোণঠাসা করে কম দামি ও ছোট গাড়ি এবং সেগুলোর কম ‘দামি’ যাত্রীদের। রাস্তার থেকে শ্রেণীবিভাজিত তঞ্চল আর কী আছে?
গতির বদলে রাস্তা হয়েছে দুর্গতির খনি। জীবনের বড় একটা সময় এখানেই খরচ হয়ে যায়। ঢাকার লোকজনের গড়পরতা দিনে দুই থেকে তিন ঘণ্টা রাস্তায় থাকতে হয়। এই হিসাবে কেউ যদি ৪০ বছর যাতায়াত করে, তাহলে রাস্তায় ব্যয় হওয়ার কথা কমপক্ষে চার বছর সময়। আদর্শ অবস্থায় হয়তো এর অর্ধেকটা সময় লাগার কথা ছিল। এই বিচারে রাস্তায় থমকে থাকা বাবদ আমাদের জীবন থেকে প্রায় দুই বছর সময় অপচয় হয়ে যায়। স্বল্প আয়ুর এই জীবন থেকে এভাবে প্রত্যেকের দুটি বছর, মানে কোটি মানুষের কোটি কোটি বছর যে চলে গেল, তা কে ফিরিয়ে দেবে? এ সময়টুকুর অর্থনৈতিক মূল্যও কি কম?
কেবল জীবনের মূল্যবান বছরই নয়, মূল্যবান অনেক জীবনও খেয়ে নেয় এই নৈরাজ্য। গড়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫ জন মারা যাচ্ছে, তার মানে বছরে প্রায় ২০ হাজার জন। এগুলো থানায় মামলা হওয়ার পরিসংখ্যান, পুলিশ বা গণমাধ্যমের অগোচরে রয়ে যাওয়া মৃত্যুগুলো যোগ করলে সংখ্যাটা আরও ভীতিকর হওয়ার কথা। এই মৃত্যু কেবল যুদ্ধের গণহত্যার সঙ্গেই তুলনীয়। ঝাঁকুনিতে হাড় ক্ষয় করে আর অকাতরে প্রাণ নিতে নিতে সড়কগুলো যে মোটামুটি উইপন অব ম্যাস ডেসট্রাকশন বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র হয়ে উঠেছে, সেই আক্কেল জনগণের হলেও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা তা স্বীকার করতে চান না। তাঁরা তো আর ভুক্তভোগী নন। তাই জাতীয় সংসদে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী অবলীলায় বলতে পারেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে প্রতিবাদের কিছু নেই’। তাহলে কি ভুক্তভোগীদের অবলীলায় মরে যাওয়াই উচিত!
দুই.
জাতীয় জীবনের মিলনস্থলও কিন্তু সড়কই। শহরাঞ্চলে সড়ক ছাড়া মানুষে মানুষে পাশাপাশি-ঘেঁষাঘেঁষি হওয়ার আর জায়গা নেই। ঘরবাড়ি যার যার, সড়কই একমাত্র স্থান, যেখানে মানুষের সাড়াশব্দ টের পাওয়া যায়। সড়কই সমাজ এবং সেই সমাজ সর্বদাই চলমান। কয়েক দশক আগেও ঢাকা শহরে কিছু ময়দান ছিল, যেখানে উৎসবে ও প্রতিবাদে গণজমায়েত হতে পারত। সেই মাঠের দুঃখ মাঠেই মারা গেছে। অথচ এই জাতির রাজনৈতিক জন্ম কিন্তু হয়েছিল ময়দানেই। ঢাকার রেসকোর্সের ময়দান, পল্টন ময়দানের জাতীয় জমায়েতগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামের একেকটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছিল। ময়দানের এই রাজনৈতিক চরিত্র ঢাকতে এখন রেসকোর্স ময়দানকে করা হয়েছে পার্ক আর পল্টন ময়দানে নিষিদ্ধ হয়েছে জনসভা। জাতি আজ দিনমান রাস্তায় দৌড়ে বেড়ায় আর ছোট ছোট ঘরবাড়িতে সেঁধয়, ময়দানে একত্র হয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ তাদের নেই। রাজনীতির জমায়েত তাই ময়দান-বঞ্চিত হয়ে রাস্তায় নেমেছে। খেয়াল করার বিষয়, মিসরে আন্দোলনের শক্তি প্রমাণের জায়গা হয় তাহরির চত্বর আর আমাদের বিরোধীদের লক্ষ্য রাজপথ। কার্যকরভাবে রাস্তা দখল করতে পারলে রাষ্ট্রক্ষমতাও দখল করা যায় এবং তাতে জীবনও যায়। সম্প্রতি ঢাকা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও রাজশাহীতে এ রকম রাস্তা দখলের যুদ্ধে পাঁচটি প্রাণ ঝরে গেছে। রাজনীতির চিরাচরিত যুদ্ধক্ষেত্র তাই রাস্তা। সেখানে সংঘাত হবে যন্ত্র ও মানুষে, বন্দুক ও বুকে।
তবে রাস্তার এই রাজনৈতিক চরিত্রও বদলাচ্ছে। আগে রাস্তার লড়াইয়ে সরকারি পুলিশের চেয়ে বিরোধীদলীয় পিকেটারদের সুবিধা ছিল বেশি। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সাফল্যের এটাও ছিল একটি কারণ। ধাওয়ার মুখে পালিয়ে যাওয়া, আবার ফিরে এসে রাস্তার দখল নেওয়ার কৌশল ঢাকায় এখন প্রায় অকার্যকর। এখন মূল সড়কগুলোয় যেভাবে কাঁটাতার দেওয়া ডিভাইডার বসেছে, যেভাবে অলিগলির সঙ্গে বড় রাস্তার সহজ চলাচল কঠিন করা হয়েছে, তাতে রাস্তার লড়াইয়ের কৌশলগত সুবিধার ভরকেন্দ্রটা পুলিশেরই বেশি। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস একদা খেয়াল করেছিলেন, ফরাসি বিপ্লবের জয়ের পেছনে বিপ্লবীদের ব্যারিকেডগুলোর অবদান ছিল। কিন্তু পরে সেসব রাস্তার ধরন এমন করা হয়, যাতে ব্যারিকেড গড়াই আর সম্ভব হয় না। দেশের বড় শহরগুলোতে এমনটাই ঘটেছে। আমাদের আধুনিক নগর পরিকল্পনায় নিরাপত্তা স্পর্শকাতরতা টের পাওয়া যায় সড়কগুলোকে বদলে যাওয়া বিন্যাসে।
তিন.
রাস্তার নৈরাজ্য, বৈষম্য ও নিরাপত্তাভীতি—এই তিনের ফল একটাই, সড়কগুলোর ক্রমশ জীবনের জন্য বিপজ্জনক, মনের ওপর পীড়াদায়ক এবং অধিকারের দিক থেকে অগণতান্ত্রিক হয়ে ওঠা। সড়ক অনেকটা জীবনের রক্তনালির মতো, ওই তিন ফাঁসে একে আটকে রেখে কত দূর যেতে পারব আমরা?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments