খোলা চোখে-পাকিস্তান: ভয় বাড়ছে by হাসান ফেরদৌস
আপনি যদি পাকিস্তানি হন, এখন খুব স্বস্তিতে থাকার কথা নয় আপনার। দৈনিক বোমাবাজি তো রয়েছেই। সকালে করাচি, তো বিকেলে কোয়েটায় বা পেশোয়ারে খুনোখুনি লেগেই আছে। এর ওপর বন্যা এবং নতুন উপদ্রব ডেঙ্গু। এর সঙ্গে যোগ করুন বিদ্যুতের ভয়াবহ ঘাটতি। সর্বশেষ বিপদ হলো পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগকে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের খোলামেলা হুমকি।
আফগান সন্ত্রাসী দল হাক্কানি গ্রুপ সম্প্রতি আফগানিস্তানে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুর ওপর পর পর কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে হামলা ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে প্রায় পুরো এক দিন ধরে অবরোধ। ওয়ারদাক প্রদেশে ন্যাটোর ঘাঁটির ওপর হাক্কানি গ্রুপ যে হামলা চালায়, তাতে শ-খানেক মার্কিন সেনা আহত হয়। সর্বশেষ যে ঘটনার জন্য হাক্কানি গ্রুপকে দায়ী করা হয়েছে, তা হলো আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রাব্বানিকে আত্মঘাতী বোমায় হত্যা। এই প্রতিটি হামলার পেছনেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্তাব্যক্তিরা যে ভাষায় অভিযোগ তুলেছেন, তাতে মনে হয় শুধু হাক্কানি গ্রুপ নয়, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাও সন্ত্রাসী।
ফলে ঘুম হারাম না হলেও পাকিস্তানিরা খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, সে কথা বলা যায় না।
তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের জড়িত থাকার কথা নতুন কিছু নয়। কয়েক বছর আগে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভ এক গাদা গোপন নথিপত্র ফাঁস করে দিয়েছিল। সেসব নথিপত্র ঘাঁটলে এ কথা বোঝা কঠিন নয় যে পাকিস্তান অনেক দিন থেকেই তালেবানদের পেছনে ছাতা ধরে আছে। টাকাপয়সা তো দিয়েছেই, অস্ত্র ও গোলাবারুদও এসেছে ইসলামাবাদ থেকে। তালেবানি খুনেদের দীর্ঘদিন থেকে তারা পুষছে এই বিশ্বাস থেকে যে ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে তাদের যখন চূড়ান্ত ধর্মযুদ্ধ হবে, পাকিস্তানকে কৌশলগত মদদ জোগাবে আফগানিস্তান। এই কৌশলগত মদদের একটি পোশাকি নাম আছে—স্ট্র্যাটেজিক ডেপ্থ। প্রস্থের হিসাবে পাকিস্তান তেমন বৃহৎ কোনো দেশ নয়। আক্রমণের মুখে হটার মতো তেমন জায়গা নেই। আফগানিস্তান হবে তাদের আশ্রয় নেওয়ার ও পাল্টা হামলা হানার মোক্ষম মোকাম। আক্রমণের মুখে তার আণবিক অস্ত্র যদি স্থানান্তরের প্রশ্ন ওঠে, তাহলে এই প্রতিবেশী দেশ হবে শেষ আশ্রয়।
সাবেক পাকিস্তানি সেনাপতি মির্জা আসলাম বেগ ১৯৮৮ সালে প্রথম যখন এই স্ট্র্যাটেজিক ডেপেথর কথা বলেন, সে সময় অবশ্য কথাটা বলেছিলেন অনেক রয়েসয়ে। তাঁর কথা ছিল, প্রতিবেশী আফগানিস্তানের সঙ্গে যদি সামরিক কৌশলগত আঁতাত গড়া যায়, তাহলে ‘হিন্দু ভারত’ এলাকা ও বাহুবলের অঙ্কে যে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ভারসাম্য অর্জন করা যাবে। তিনি তখন এই কৌশলগত অবস্থানের নাম দিয়েছিলেন ‘ইসলামিক ডেপ্থ’।
ইসলামি বা কৌশলগত যে নামেই এই ‘ডেপেথর’ নামকরণ করি না কেন, এ আসলে এক মরণফাঁদ। এ ফাঁদ খোঁড়ার জন্য শাবলখানা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রই পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়েছিল। সোভিয়েতদের তাড়ানোর নামে জিহাদিদের একত্র করা ও তাদের প্রশিক্ষণের নীলনকশা তারাই প্রথম এঁকেছিল। ওসামা বিন লাদেনও তাদেরই সৃষ্টি। সে অবশ্য ভিন্ন গল্প।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সমস্যা হলো, যত হম্বিতম্বিই সে করুক না কেন, আফগানিস্তান থেকে তালেবানি বজ্জাতদের ঢিট করতে হলে পাকিস্তানের ওপর ভর করা ছাড়া তাদের অন্য কোনো বিকল্প নেই। অন্ততপক্ষে এত দিন তেমনটাই ভাবা হতো। আফগানিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ও জ্বালানি সরবরাহ করতে হলে সবচেয়ে সহজ ব্যবস্থা হলো স্থলপথে পাকিস্তান হয়ে তা পাঠানো। লম্বা, অরক্ষিত সে পথ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাহারা না দিলে শত্রুপক্ষ যেকোনো সময় সে রসদবহরের ওপর হামলা করতে পারে। হরহামেশা সে রকম হামলা হয়েছেও। কোনো সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্র যেই ‘তালেবান রোখো’ বলে ধমক দিয়েছে, পাকিস্তান অমনি তার জবাবে ‘রোসো’ বলে তালেবানি লস্করদের লেলিয়ে দিয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র না পারে পাকিস্তানকে গিলতে, না পারে তাকে উগরাতে। বস্তা বস্তা ডলার তারা ঢেলেছে মুখ্যত পাকিস্তানি জেনারেলদের হাতে রাখতে। সে ডলার দিয়ে তাঁরা কী করেছেন, তা দেখার জন্য ইসলামাবাদের যেকোনো এলাকায় এক চক্কর দিলেই বেশ বোঝা যায়। পোয়া মাইল দূরে দূরে জেনারেল সাহেবদের এক একটা আলিশান বাড়ি। সেই বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটার সময় আমার মনে হয়েছে ‘ডালাস’ টিভি সিরিজে জে আর ইয়ং-এর খামারবাড়ি যেমন দেখেছি, ঠিক তেমন।
গত ২০-২২ বছর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বেহিসাবি নজরানা পেয়ে পাকিস্তানি জেনারেলদের খিদে ক্রমেই বেড়েছে, কিন্তু কাজের কাজ অর্থাৎ তালেবান দমন কিছুই হয়নি। এর একটা প্রধান কারণ, পাকিস্তান টের পেয়ে গেছে, আজ হোক কাল হোক, লোটা-কম্বল গুটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে ভাগল-বা হবেই হবে। তারা সেখান থেকে চলে গেলে যে রাজনৈতিক ও সামরিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে, তা পূরণে এগিয়ে আসবে হয় চীন, নয়তো ভারত। চীনকে মানা গেলেও জাতশত্রু ভারতকে সে মেনে নেবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, আসন গাড়ার প্রতিযোগিতায় ভারত ইতিমধ্যে এগিয়ে আছে। বর্তমান আফগান নেতৃত্বও ভারতের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধতে আগ্রহী। চলতি সপ্তাহে নয়াদিল্লি সফরকালে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ভারতের সঙ্গে একটি ‘কৌশলগত চুক্তি’ স্বাক্ষর করেছেন। সোভিয়েত আমলে আফগানদের অনেকেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কেউ কেউ সেখানে বিদ্যাশিক্ষাও করেছেন। চীনের ব্যাপারে তাঁদের কোনো বিদ্বেষ নেই, কিন্তু পাকিস্তান থেকে দেড় হাত তফাতে থাকতে চান তাঁরা। এই দেশের সামরিক কর্তারা যে তাঁদের হাতের তালুর নিচে রাখতে চান, তা তাঁরা ইতিমধ্যেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
আফগানিস্তানের এই অনাগ্রহ পাকিস্তানের ভালো না লাগারই কথা। তাদের সঙ্গে কথা না বলেই কোনো কোনো তালেবানি গ্রুপের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করেছিলেন আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাই। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনেই সে কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা পাকিস্তানের মনঃপূত হয়নি। আফগানিস্তান থেকে যদি যুক্তরাষ্ট্র চলে যায়, আর সেখানে শান্তি ফিরে আসে, তবে তা হবে পাকিস্তানের জন্য খুবই দুশ্চিন্তার কথা। যে সোনার হাঁস এত দিন না চাইতেই ডিম পাড়ছিল, সে তাহলে আর ডিম দেবে না। তা ছাড়া সব জেনারেলের জন্য বালাখানা এখনো তৈরি শেষ হয়নি! এতসব, দাও, দু-চার ঘা। বুঝুক শালারা, আমরা না চাইলে আফগানিস্তানে শান্তি আনা অত সোজা কথা নয়।
শুধু তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনাই নয়, পাকিস্তানের জন্য ভয়ের অন্য আরেক কারণও আছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি সরে যাবে না, অন্ততপক্ষে অদূর ভবিষ্যতে নয়। কিন্তু পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে তারা ইতিমধ্যে বিকল্প পথ খুঁজছে। তথ্যাভিজ্ঞ মহল বলছে, রাশিয়া হয়ে, মধ্য এশিয়ার দূর পথ ঘুরে রসদ চালানোর বিকল্প পথ প্রায় গুছিয়ে এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। জানা গেছে, নর্দার্ন ডিস্ট্রিবিউশন রুট বলে পরিচিত এই বিকল্প পথে ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ভারী অস্ত্র, জ্বালানি ও রসদ আনা-নেওয়া শুরু হয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ মালামাল অবশ্য এখনো করাচি বন্দর হয়েই আসছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনতে। এত দিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তাদের সামরিক কার্যকলাপের জন্য কার্যত পাকিস্তানের হাতে জিম্মি হয়ে ছিল। নর্দার্ন ডিস্ট্রিবিউশন রুট পুরোপুরি চালু হলে সেই অবস্থাটা একদম বদলে যাবে।
এসব নানা কারণে পাকিস্তানি জেনারেলদের ব্রহ্মতালু তেতে আছে। তাঁরা চান, যেভাবেই হোক, এই পুরোনো সমীকরণ অটুট থাকুক। সম্ভবত সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই হাক্কানিদের কাঁধে বন্দুক রেখে সরাসরি মার্কিন লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা হয়েছে। সমস্যা হলো, এই হামলায় নিহত হয়েছেন মার্কিন সেনাসদস্য ও কূটনীতিক কর্মী। নয়-এগারোর পর আফগানিস্তানের ওপর হামলা হয়েছিল মূলত মার্কিন লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলার বদলা নিতেই। পরাশক্তি হিসেবে, কেউ কেউ বলবে ‘পাড়ার মাস্তান’ হিসেবে, তার গায়ে কুটোটি লাগুক, যুক্তরাষ্ট্র তা মেনে নেবে না। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বাহিনীর বিদায়ী প্রধান জেনারেল মাইন মালেন আইএসআইকে হাক্কানি গ্রুপের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তার একটা ভিন্ন অর্থ থাকতে পারে। মালেন বলেছেন, আইএসআই হাক্কানি নেটওয়ার্কের অংশ, আর হাক্কানি নেটওয়ার্ক একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। আর তা-ই যদি হয়, সন্ত্রাসীদের যারা ছাতা ধরে আছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা হামলা এড়ায় কী করে?
ওবামা প্রশাসন অবশ্য ইতিমধ্যে জেনারেল মালেনের বক্তব্য থেকে নিজেদের কিছুটা হলেও তফাতে রেখেছে। দুই দেশের মধ্যে যাতে অবস্থার অবনতি না হয়, তার ব্যবস্থাও তারা নিচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের সব সেতু পুড়ে যাক, তা তারা চায় না। অন্যদিকে পাকিস্তানি নেতারা তড়িঘড়ি করে বিবৃতি দিয়েছেন, হাক্কানি গ্রুপ পাকিস্তানের মাটিতে নেই, তারা আফগানিস্তান সীমান্তের ওপারে তৎপর। হাক্কানি গ্রুপের একজন নেতাও বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত নন। এসবই যে যুক্তরাষ্ট্রের রোষ এড়ানোর ফন্দি-ফিকির, তাতে সন্দেহ নেই। তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা যে জেনারেল মালেনের কথায় ভয় পেয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে ভয় লুকাতে সরকার ও বিরোধী দল সবাই হাতে হাত মিলিয়েছে। গত সপ্তাহে ইসলামাবাদে সর্বদলীয় এক সভায় পাকিস্তানি রাজনীতিকেরা অঙ্গীকার করেছেন, পাকিস্তানের মাটিতে মার্কিন হামলা তাঁরা সহ্য করবেন না, এক হয়ে প্রতিরোধ করবেন। করাচি ও ইসলামাবাদে ওবামার কুশপুত্তলিকাও দাহ করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের পত্রপত্রিকা ও টিভির টক শোগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রীতিমতো বাগ্যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এক টিভি বিজ্ঞাপনে যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের ছবি দেখিয়ে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে, কোরআন-সুন্নায় বিশ্বাস করে এমন এক জাতিকে তোমরা চ্যালেঞ্জ করেছ। তোমাদের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে।
কে কার দাঁত ভাঙবে, সে কেবল ভবিতব্যই জানে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি যে আরও জটিল হয়ে আসছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তান কোণঠাসা হলে আমরা কেউ কেউ খুশি হই বটে, কিন্তু সত্যি যদি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রুজ মিসাইল সে দেশের মাটিতে আছড়ে পড়ে অথবা সীমান্ত ডিঙিয়ে মার্কিন সেনার বুট জুতো পাকিস্তানে পা রাখে, পরিস্থিতি তখন কোথায় গিয়ে ঠেকবে, বলা কঠিন। সেখানে যে আগুন জ্বলবে, তার হলকা থেকে আমরাও বাঁচব না।
৪ অক্টোবর ২০১১, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments