সপ্তাহের হালচাল-সংঘাতের পথ থেকে সরে আসুন by আব্দুল কাইয়ুম
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন না করা এবং দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে না দেওয়ার ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ়প্রত্যয় ঘোষণার পর এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে আরেকটা পাল্টা উত্তর আসছে। ঘটনা ঠিক। দুই দিন না যেতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জোর দিয়ে বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, হতেই হবে। শুধু তা-ই নয়, বিএনপিকেও সেই নির্বাচনে আসতে হবে বলে তিনি দাবি করেন। বেগম জিয়া নির্বাচনকে তিনবার ‘না’ করেছিলেন।
এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনবার ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছেন। নির্বাচন এখনো প্রায় আড়াই বছর দূরে। অথচ এখন থেকেই পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেগম জিয়াই তো একসময় বলেছিলেন ‘পাগল ও শিশু’ ছাড়া নিরপেক্ষ বলে কেউ থাকতে পারে না, তাহলে আজ কেন তিনি সেই ব্যবস্থার জন্য এত অধীর? এই যুক্তি খুব দুর্বল। কারণ, কথাটা তো তাঁর নিজের বেলায়ও খাটে। ১৯৯৪-৯৬ সালে তিনিও তো বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না। দিনের পর দিন সমাবেশ, ঘেরাও, হরতাল তো তাঁরাই করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জনও করেছিলেন। তার পর থেকে দাবি করে আসছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁদেরই অবদান। তাহলে আজ কেন তাঁরা সেই ব্যবস্থা বাতিল করলেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ফাঁকফোকরের জন্য এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকার ও জরুরি আইন এসেছিল বলে তিনি যে যুক্তি দিচ্ছেন, তারও কোনো শক্ত ভিত্তি নেই। কারণ, অতীতে বেয়নেটের মুখে নির্বাচিত সরকারকে অপসারণ করে দুবার সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। জরুরি আইনও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই তুলনায় বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ভালো দেখিয়েছে। তাদের আমলে সেনাসমর্থিত সরকার এসেছিল বটে, কিন্তু পুরোদস্তুর সেনাশাসন আসতে পারেনি। এর কৃতিত্ব অবশ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই দিতে হয়। সেনা নেতৃত্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেও তা আর বাস্তবায়িত হতে পারেনি, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য পরিস্থিতির চাপের কাছে তাদের পিছু হটতে হয়েছে। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দোষ কোথায়?
প্রধানমন্ত্রী এখন আদালতের রায়ের কথা বলছেন। কিন্তু রায়ের তো আরেকটা দিকও রয়েছে। আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে বলেও তো রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতকেই যদি সাক্ষী মানবেন, তাহলে খণ্ডিতভাবে কেন? পুরোটা মানতে অসুবিধা কোথায়? সরকার যদি দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের বিধান করত, তাহলে হয়তো এত না-হ্যাঁ-এর গোলচক্করে পড়তে হতো না।
প্রধানমন্ত্রী সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু তা-ই যদি হবে, তাহলে সরকার কেন উদ্যোগ নেয় না? দলনিরপেক্ষ সার্চ কমিটি গঠন করলেও হয়তো বিরোধী দল কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারে। সে রকম কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায় না। বরং সরকার বিরোধী দলকে সংসদে এসে আলোচনা করার পরামর্শ দিচ্ছে, যা অবাস্তব। পরিস্থিতি যেখানে চলে গেছে, তাতে বিরোধী দলের সংসদে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। সব জেনেশুনেই সরকার এসব কথা বলছে। এতে মানুষের চোখে সরকারের ভাবমূর্তি দ্রুত পড়ে যাচ্ছে।
মনে রাখা দরকার, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মানুষ চায় না। এ ব্যাপারে এখনো মানুষের আস্থার অভাব রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পেছনে বিপুল জনগণের সক্রিয় সমর্থন ছিল এবং আছে। এই ব্যবস্থা জনগণের সম্পদ। বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ব্যাপারে সরকারের অন্তত বোঝানো উচিত ছিল যে এর পেছনে তাদের কোনো দলীয় স্বার্থ নেই। গণতন্ত্রের স্বার্থে ব্যবস্থাটি বাতিল করতে হলে সংশোধনীর সঙ্গে একটা কথা জুড়ে দেওয়া উচিত ছিল। বলতে হতো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিধানটি ‘বর্তমান মেয়াদে নয়, পরবর্তী সরকারের আমল থেকে’ কার্যকর হবে। বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ রকমই করা হয়।
১৯৯২ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২৭তম সংশোধনীতে পরিষ্কার বলা হয়, সিনেটরদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত (কংগ্রেশনাল স্যালারিজ) কোনো বিধান পাস করা হলে তা সব সময় পরবর্তী মেয়াদ থেকে কার্যকর হবে। যেহেতু কংগ্রেসম্যানদের বেতন-ভাতা আসে জনগণের টাকা থেকে, তাই তাদের টাকা যেন কোনো ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহূত না হয়, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। আমাদের দেশে এ রকম কথা ভাবা হয় না। যেদিন থেকে বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব পাস, সেদিন থেকেই কার্যকর! এই ধারা বদলানো দরকার। সংসদে দলীয় স্বার্থে কিছু করা উচিত নয়।
আজ প্রধানমন্ত্রী হাজার মাথা কুটলেও কাউকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পেছনে কোনো দলীয় স্বার্থ নেই। বরং সবাই বলবে, যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার জন্যই এটা বাতিল করা হয়েছে। যদি বলা হতো এই সংশোধনী পরবর্তী মেয়াদ থেকে কার্যকর করা হবে, তাহলে আর কেউ প্রশ্ন তুলত না। সবাই বলত, দেশের স্বার্থেই ও রকম করা হয়েছে, সরকারি দলের কোনো স্বার্থ নেই।
এখন যেভাবে সংশোধনী করা হয়েছে, তাতে না-না আর হ্যাঁ-হ্যাঁ-এর মধ্যে সংঘাত অনিবার্য। দেশবাসী চায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, আর দুই নেত্রী চলেছেন সংঘাতের পথে। এসব বাদ দিয়ে এখন সরকার ও বিরোধী দলের বৈঠকে বসা দরকার। প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যের ভিত্তিতে অন্তত দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করা হোক। এতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের লঙ্ঘন হবে না।
সরকারকে এসব অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক বিরোধ মিটিয়ে ফেলে বরং মানুষের সমস্যা লাঘবে মনোযোগ দেওয়া দরকার। মানুষ যে কষ্টে আছে, এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। বাজারে আগুন। পকেট শূন্য। রাস্তায় যানজট। গণপরিবহনে নৈরাজ্য। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান স্বয়ং বলছেন, মানুষ গুম হচ্ছে, লাশ পড়ে থাকছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ ব্লগারকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আর কত উদাহরণ লাগবে?
মালয়েশিয়ায় একটি আইন আছে—ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (আইএসএ)। এই আইনে সন্দেহভাজন কাউকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখার ঢালাও ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। ১৯৬০ সাল থেকে চলছে আইনটি। বিরোধী রাজনীতিক, বিভিন্ন সমিতির আন্দোলনকামী নেতা, ছাত্র ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনটি সাধারণত প্রয়োগ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ আইন বাতিলের দাবি করে আসছিল মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠন। পার্শ্ববর্তী সিঙ্গাপুরেও এ রকম আইন আছে এবং তা বাতিলের দাবি উঠেছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সরকার ঘোষণা করেছে, তারা আইনটি বাতিল করবে। আরও কিছু নিবর্তনমূলক আইন বাতিলের চিন্তা করছে মালয়েশিয়া। যেমন—১৯৬৯ সাল থেকে জারি করা জরুরি আইন বাতিল করা হবে, সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য প্রতিবছর অনুমতির পরিবর্তে একবার অনুমতি গ্রহণের বিধান চালু করা হবে, প্রভৃতি (দেখুন, দি ইকোনমিস্ট, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১)। ধারণা করা হয়, ‘আরব বসন্তের’ সম্ভাব্য জোয়ার ঠেকাতে এসব পদক্ষেপ।
মালয়েশিয়া আর বাংলাদেশ এক নয়। বাংলাদেশের আছে গণতন্ত্রের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। মালয়েশিয়ায় তা নেই। কিন্তু সেখানে আছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, যা আমাদের নেই। এ অবস্থায় মালয়েশিয়া উন্নতির উঁচু সোপানে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সংস্কার করছে, আর বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকার হয়তো ভাবছে, বাংলাদেশ ‘আরব বসন্ত’ থেকে দূরে আছে। কিন্তু কত দূরে?
মনে রাখা দরকার, নিউইয়র্কের রাজপথও জনতার পদভারে প্রকম্পিত হচ্ছে। বাংলাদেশ হয়তো বেশি দিন বেশি দূরে থাকবে না।
সময়টা খারাপ। এখন রাজনৈতিক সংঘাত কমাতে যদি না পারেন, অন্তত বাড়তে দেবেন না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেগম জিয়াই তো একসময় বলেছিলেন ‘পাগল ও শিশু’ ছাড়া নিরপেক্ষ বলে কেউ থাকতে পারে না, তাহলে আজ কেন তিনি সেই ব্যবস্থার জন্য এত অধীর? এই যুক্তি খুব দুর্বল। কারণ, কথাটা তো তাঁর নিজের বেলায়ও খাটে। ১৯৯৪-৯৬ সালে তিনিও তো বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না। দিনের পর দিন সমাবেশ, ঘেরাও, হরতাল তো তাঁরাই করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জনও করেছিলেন। তার পর থেকে দাবি করে আসছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁদেরই অবদান। তাহলে আজ কেন তাঁরা সেই ব্যবস্থা বাতিল করলেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ফাঁকফোকরের জন্য এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকার ও জরুরি আইন এসেছিল বলে তিনি যে যুক্তি দিচ্ছেন, তারও কোনো শক্ত ভিত্তি নেই। কারণ, অতীতে বেয়নেটের মুখে নির্বাচিত সরকারকে অপসারণ করে দুবার সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। জরুরি আইনও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই তুলনায় বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ভালো দেখিয়েছে। তাদের আমলে সেনাসমর্থিত সরকার এসেছিল বটে, কিন্তু পুরোদস্তুর সেনাশাসন আসতে পারেনি। এর কৃতিত্ব অবশ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই দিতে হয়। সেনা নেতৃত্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেও তা আর বাস্তবায়িত হতে পারেনি, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য পরিস্থিতির চাপের কাছে তাদের পিছু হটতে হয়েছে। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দোষ কোথায়?
প্রধানমন্ত্রী এখন আদালতের রায়ের কথা বলছেন। কিন্তু রায়ের তো আরেকটা দিকও রয়েছে। আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে বলেও তো রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতকেই যদি সাক্ষী মানবেন, তাহলে খণ্ডিতভাবে কেন? পুরোটা মানতে অসুবিধা কোথায়? সরকার যদি দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের বিধান করত, তাহলে হয়তো এত না-হ্যাঁ-এর গোলচক্করে পড়তে হতো না।
প্রধানমন্ত্রী সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু তা-ই যদি হবে, তাহলে সরকার কেন উদ্যোগ নেয় না? দলনিরপেক্ষ সার্চ কমিটি গঠন করলেও হয়তো বিরোধী দল কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারে। সে রকম কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায় না। বরং সরকার বিরোধী দলকে সংসদে এসে আলোচনা করার পরামর্শ দিচ্ছে, যা অবাস্তব। পরিস্থিতি যেখানে চলে গেছে, তাতে বিরোধী দলের সংসদে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। সব জেনেশুনেই সরকার এসব কথা বলছে। এতে মানুষের চোখে সরকারের ভাবমূর্তি দ্রুত পড়ে যাচ্ছে।
মনে রাখা দরকার, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মানুষ চায় না। এ ব্যাপারে এখনো মানুষের আস্থার অভাব রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পেছনে বিপুল জনগণের সক্রিয় সমর্থন ছিল এবং আছে। এই ব্যবস্থা জনগণের সম্পদ। বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ব্যাপারে সরকারের অন্তত বোঝানো উচিত ছিল যে এর পেছনে তাদের কোনো দলীয় স্বার্থ নেই। গণতন্ত্রের স্বার্থে ব্যবস্থাটি বাতিল করতে হলে সংশোধনীর সঙ্গে একটা কথা জুড়ে দেওয়া উচিত ছিল। বলতে হতো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিধানটি ‘বর্তমান মেয়াদে নয়, পরবর্তী সরকারের আমল থেকে’ কার্যকর হবে। বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ রকমই করা হয়।
১৯৯২ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২৭তম সংশোধনীতে পরিষ্কার বলা হয়, সিনেটরদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত (কংগ্রেশনাল স্যালারিজ) কোনো বিধান পাস করা হলে তা সব সময় পরবর্তী মেয়াদ থেকে কার্যকর হবে। যেহেতু কংগ্রেসম্যানদের বেতন-ভাতা আসে জনগণের টাকা থেকে, তাই তাদের টাকা যেন কোনো ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহূত না হয়, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। আমাদের দেশে এ রকম কথা ভাবা হয় না। যেদিন থেকে বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব পাস, সেদিন থেকেই কার্যকর! এই ধারা বদলানো দরকার। সংসদে দলীয় স্বার্থে কিছু করা উচিত নয়।
আজ প্রধানমন্ত্রী হাজার মাথা কুটলেও কাউকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পেছনে কোনো দলীয় স্বার্থ নেই। বরং সবাই বলবে, যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার জন্যই এটা বাতিল করা হয়েছে। যদি বলা হতো এই সংশোধনী পরবর্তী মেয়াদ থেকে কার্যকর করা হবে, তাহলে আর কেউ প্রশ্ন তুলত না। সবাই বলত, দেশের স্বার্থেই ও রকম করা হয়েছে, সরকারি দলের কোনো স্বার্থ নেই।
এখন যেভাবে সংশোধনী করা হয়েছে, তাতে না-না আর হ্যাঁ-হ্যাঁ-এর মধ্যে সংঘাত অনিবার্য। দেশবাসী চায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, আর দুই নেত্রী চলেছেন সংঘাতের পথে। এসব বাদ দিয়ে এখন সরকার ও বিরোধী দলের বৈঠকে বসা দরকার। প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যের ভিত্তিতে অন্তত দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করা হোক। এতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের লঙ্ঘন হবে না।
সরকারকে এসব অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক বিরোধ মিটিয়ে ফেলে বরং মানুষের সমস্যা লাঘবে মনোযোগ দেওয়া দরকার। মানুষ যে কষ্টে আছে, এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। বাজারে আগুন। পকেট শূন্য। রাস্তায় যানজট। গণপরিবহনে নৈরাজ্য। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান স্বয়ং বলছেন, মানুষ গুম হচ্ছে, লাশ পড়ে থাকছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ ব্লগারকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আর কত উদাহরণ লাগবে?
মালয়েশিয়ায় একটি আইন আছে—ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (আইএসএ)। এই আইনে সন্দেহভাজন কাউকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখার ঢালাও ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। ১৯৬০ সাল থেকে চলছে আইনটি। বিরোধী রাজনীতিক, বিভিন্ন সমিতির আন্দোলনকামী নেতা, ছাত্র ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনটি সাধারণত প্রয়োগ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ আইন বাতিলের দাবি করে আসছিল মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠন। পার্শ্ববর্তী সিঙ্গাপুরেও এ রকম আইন আছে এবং তা বাতিলের দাবি উঠেছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সরকার ঘোষণা করেছে, তারা আইনটি বাতিল করবে। আরও কিছু নিবর্তনমূলক আইন বাতিলের চিন্তা করছে মালয়েশিয়া। যেমন—১৯৬৯ সাল থেকে জারি করা জরুরি আইন বাতিল করা হবে, সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য প্রতিবছর অনুমতির পরিবর্তে একবার অনুমতি গ্রহণের বিধান চালু করা হবে, প্রভৃতি (দেখুন, দি ইকোনমিস্ট, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১)। ধারণা করা হয়, ‘আরব বসন্তের’ সম্ভাব্য জোয়ার ঠেকাতে এসব পদক্ষেপ।
মালয়েশিয়া আর বাংলাদেশ এক নয়। বাংলাদেশের আছে গণতন্ত্রের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। মালয়েশিয়ায় তা নেই। কিন্তু সেখানে আছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, যা আমাদের নেই। এ অবস্থায় মালয়েশিয়া উন্নতির উঁচু সোপানে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সংস্কার করছে, আর বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকার হয়তো ভাবছে, বাংলাদেশ ‘আরব বসন্ত’ থেকে দূরে আছে। কিন্তু কত দূরে?
মনে রাখা দরকার, নিউইয়র্কের রাজপথও জনতার পদভারে প্রকম্পিত হচ্ছে। বাংলাদেশ হয়তো বেশি দিন বেশি দূরে থাকবে না।
সময়টা খারাপ। এখন রাজনৈতিক সংঘাত কমাতে যদি না পারেন, অন্তত বাড়তে দেবেন না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments