বৈদেশিক খাত ব্যবস্থাপনাই প্রধান চ্যালেঞ্জ-বাংলাদেশ ব্যাংক by মামুন রশীদ
আমাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা ক্রমাগত বাড়ছে। তারা আরও সিনথেটিক ও আর্থিক প্রোডাক্ট চাইছেন। বাজার আরও খুলে যাবে_ এটাও তাদের বিবেচনায় অপরিহার্য। অন্যদিকে, জনসাধারণের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের প্রতি বেশি বেশি আগ্রহ। তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে।
আমাদের উন্নয়ন অংশীদাররা হয় গ্রহণ করো নতুবা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করো_ এ নীতি আঁকড়ে ধরে আছে। তারা বাজারের আকস্মিক পরিবর্তন মোকাবেলায় অপ্রচলিত
পথে চলতে দিতে নারাজ
স্কুলে পড়েছি_ শিশুরা বড়দের চেয়ে জ্ঞানী হতে পারে। রুশ লেখক লিও টলস্টয়ের এ শিরোনামে একটি গল্পও রয়েছে। জানুয়ারির শেষদিকে বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের জন্য ১২০ জন নতুন কর্মী নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তৃতীয় প্রজন্মের এ ব্যাংকটি সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সদ্য অবসর নেওয়া একজন ডেপুটি গভর্নরও ছিলেন আমাদের পরীক্ষক প্যানেলে। সাক্ষাৎকার দিতে আসা বেশিরভাগ প্রার্থী ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ের বিজনেস স্টাডিজ বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কয়েকজনকেও এ সময়ে আমরা পেয়েছি। ব্যাংকে এ ধরনের নিয়োগ পরীক্ষায় সাধারণত প্রার্থীদের ফিন্যান্স, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং, ব্যাংকিং, ম্যানেজমেন্ট, মানবসম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। এর বাইরেও আমরা 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ কী'_ এ প্রশ্নটি অনেকের কাছে রেখেছি। আরেকটি প্রশ্ন ছিল_ বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত? বেশিরভাগ পরীক্ষার্থী সঠিকভাবেই বলেছেন_ মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। কয়েকজন আরও যুক্ত করেছেন_ ব্যাংকিং খাতের সুরক্ষা কিংবা নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকগুলোর তদারকি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তাদান এবং কারেন্সি নোট ছাপা। এক নারী প্রার্থীর উত্তর আমাকে কিছুটা চমৎকৃত করেছে। তার ভাষ্য ছিল এরূপ_ বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবশ্যই বৈদেশিক খাত ফোকাসে থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সম্প্রতি তিনজন নতুন ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেকের প্রতি রয়েছে আমার ব্যক্তিগত উচ্চ ধারণা। তাদের আমি সম্মান করি। নতুন দায়িত্বে তারা সফল হবেন_ এ প্রত্যাশা থাকল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কমবেশি তিন দশক একটানা দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তারা এ মর্যাদার পদে আসীন হলেন। বাংলাদেশের ব্যাংকের করিডোরে কানাঘুষা ছিল যে, কেবল অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি থাকলেই এ পদের জন্য বিবেচনা করা হবে। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা দেখতে পেলাম অন্য চিত্র। নিয়োগদানের সঙ্গে যুক্তরা অন্তত দুটি পদের ক্ষেত্রে আরও আপস করেছেন। একজন নারী এই প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদে নিযুক্ত হলেন। আমরা একে স্বাগত জানাই। তবে নারীর ক্ষমতায়নে এ বিষয়টি কতটা ভূমিকা রাখবে_ তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জনে সরকারের আন্তরিকতা থাকা উচিত এবং তার লক্ষণও রয়েছে। কিন্তু এ জন্য ক্ষেত্র নির্বাচনে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। পাকিস্তানে কয়েক বছর আগে ড. শামসাদ আকতারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি সফল ছিলেন। তবে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে সেই তরুণীর বক্তব্য_ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে বৈদেশিক খাতের ব্যবস্থাপনা। এ খাতের গুরুত্ব নিয়ে বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন নেই। অর্থনীতিতে আমাদের পরনির্ভরতা রয়েছে। এর মধ্যেই দেশটি বেশি বেশি জড়িয়ে পড়ছে উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের অর্থনীতির সঙ্গে। বিশ্ব অর্থনীতি ভালো নাকি মন্দ পথে চলছে, সেটা শুধু ঢাকায় বসে নয়, সুদূর পল্লী এলকায় থেকেও টের পাওয়া যায়। আমার জানামতে, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে চারজন ডেপুটি গভর্নর রয়েছেন তাদের কারই মনিটরি প্লানিং, প্রোগ্রামিং কিংবা বৈদেশিক খাত ব্যবস্থাপনার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। তদুপরি, আমি নিজের কাছেই প্রশ্ন তুলি_ একটি পুরোদস্তুর পেশাদার প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র পদগুলোতে কোটা-সুবিধা অনুসরণের কোনো যুক্তি আছে কি-না। আমার শুভানুধ্যায়ীরা বলেন, নাক সিটকানো মনোভাবের জন্য আমি ইতিমধ্যেই 'প্রভাবশালী মহলের' বিরাগভাজন হয়ে পড়েছি। কেউ কেউ সম্ভবত ক্ষুব্ধও। অতএব, এ পথে আর না চলাই ভালো। বিগত চার দশকে আমাদের মাতৃভূমির বৈদেশিক সংযোগ বিপুলভাবে বেড়েছে। রফতানি খাত থেকে আয় বছরে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। আমদানির জন্য বছরে ব্যয় করতে হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি। প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি কাজ করেন তারা বছরে দেশে পাঠাচ্ছেন ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। সেবা খাতে পরিশোধ ২০০ কোটি ডলারের বেশি। জিডিপিতে বৈদেশিক খাতের হিস্যা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আমরা দ্রুত ভিয়েতনাম কিংবা ইন্দোনেশিয়ার মতো অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে চলেছি_ এমনটিই ভাবা হচ্ছে। এখন আমাদের নিয়ন্ত্রকরা নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে পূর্ব এশিয়ার সংকটের সময়ে যেভাবে সিরিয়াস হয়েছিলেন, তেমন তৎপর হলেও বাইরের অভিঘাত থেকে দেশ কিংবা অর্থনীতিকে পুরোপুরি রক্ষা করতে পারবেন না। এখানেই এড়িয়ে চলার মনোভাব পরিত্যাগ করার প্রশ্ন আসবে, দক্ষ ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকবে। আমাদের কেবল সমস্যা স্বীকার করলেই চলবে না, বরং অর্থনীতিতে তার প্রভাব যতটা কমিয়ে রাখা যায় সে জন্য সক্রিয় চেষ্টা চালাতে হবে। এ জন্য ভালোভাবে হোমওয়ার্ক করা চাই। থাকা চাই যথাযথ প্রস্তুতি। যেসব বিজনেস হাউস বা আমদানিকারক বছরে ১০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেন কিংবা যেসব বাংলাদেশি বছরে ২৫ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি করেন তারা সঙ্গতভাবেই বিশ্ববাজারে নিজের স্থান করে নেওয়ার জন্য আরও বেশি নীতিগত সমর্থন প্রত্যাশা করবেন। তারা অবশ্যই চাইবেন মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস কিংবা একই ধরনের দেশগুলোর মতো অর্থনীতি ও বাজারে সংস্কারের মাধ্যমে যে ধরনের সুবিধা ভোগ করছে তেমনটি বাংলাদেশের জন্যও অর্জন করতে।
আমাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা ক্রমাগত বাড়ছে। তারা আরও সিনথেটিক ও আর্থিক প্রোডাক্ট চাইছেন। বাজার আরও খুলে যাবে_ এটাও তাদের বিবেচনায় অপরিহার্য। অন্যদিকে, জনসাধারণের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের প্রতি বেশি বেশি আগ্রহ।
তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। আমাদের উন্নয়ন অংশীদাররা হয় গ্রহণ করো নতুবা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করো_ এ নীতি আঁকড়ে ধরে আছে। তারা বাজারের আকস্মিক পরিবর্তন মোকাবেলায় অপ্রচলিত পথে চলতে দিতে নারাজ। এমনকি তার অনুমোদন মিললেও ওষুধ যদি 'মেয়াদোত্তীর্ণ' হয়ে যায়, তাহলে সুফল মেলে না।
কেলগ স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের ডিন এবং আমার শিক্ষক দীপক জৈন বর্লেিছলেন, কেবল মধ্যমমানের লোকেরা অতীত আঁকড়ে থাকতে পছন্দ করে এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও নেতৃত্বগুণ যাদের রয়েছে তারা আস্থার সঙ্গে তাকায় ভবিষ্যৎপানে। সুতরাং আমরা কেবল অতীত নিয়ে বসে থাকতে পারি না। যারা অগ্রজ রয়েছেন এবং যাদের দ্বারা কাজের কাজটি হতে পারে, তাদের সবার প্রতি আবেদন কী কী জরুরি ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় তা চিহ্নিত করুন। নিয়ন্ত্রণমূলক যেসব কাজ করতে হবে তা স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করুন। অন্যথায় 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' কিংবা মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হওয়া আরও অনেক দিন অধরা থেকে যাবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যাব, শহীদদের স্বপ্নের পথে চলার প্রেরণা জোগাব, কিন্তু সামনে চলার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে না পারলে অর্জনের খাতা ভরবে না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এটাই দেখতে চায় যে, আমরা বিশ্বের বাস্তবতাকে বুদ্ধিমত্তার তীব্র ঘাটতি দিয়ে নয়, বরং প্রজ্ঞা, সাহস ও সৃজনশীলতার সঙ্গে মোকাবেলা করি।
মামুন রশীদ :ব্যাংকার ও কলাম লেখক
পথে চলতে দিতে নারাজ
স্কুলে পড়েছি_ শিশুরা বড়দের চেয়ে জ্ঞানী হতে পারে। রুশ লেখক লিও টলস্টয়ের এ শিরোনামে একটি গল্পও রয়েছে। জানুয়ারির শেষদিকে বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের জন্য ১২০ জন নতুন কর্মী নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তৃতীয় প্রজন্মের এ ব্যাংকটি সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সদ্য অবসর নেওয়া একজন ডেপুটি গভর্নরও ছিলেন আমাদের পরীক্ষক প্যানেলে। সাক্ষাৎকার দিতে আসা বেশিরভাগ প্রার্থী ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ের বিজনেস স্টাডিজ বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কয়েকজনকেও এ সময়ে আমরা পেয়েছি। ব্যাংকে এ ধরনের নিয়োগ পরীক্ষায় সাধারণত প্রার্থীদের ফিন্যান্স, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং, ব্যাংকিং, ম্যানেজমেন্ট, মানবসম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। এর বাইরেও আমরা 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ কী'_ এ প্রশ্নটি অনেকের কাছে রেখেছি। আরেকটি প্রশ্ন ছিল_ বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত? বেশিরভাগ পরীক্ষার্থী সঠিকভাবেই বলেছেন_ মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। কয়েকজন আরও যুক্ত করেছেন_ ব্যাংকিং খাতের সুরক্ষা কিংবা নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকগুলোর তদারকি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তাদান এবং কারেন্সি নোট ছাপা। এক নারী প্রার্থীর উত্তর আমাকে কিছুটা চমৎকৃত করেছে। তার ভাষ্য ছিল এরূপ_ বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবশ্যই বৈদেশিক খাত ফোকাসে থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে সম্প্রতি তিনজন নতুন ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেকের প্রতি রয়েছে আমার ব্যক্তিগত উচ্চ ধারণা। তাদের আমি সম্মান করি। নতুন দায়িত্বে তারা সফল হবেন_ এ প্রত্যাশা থাকল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কমবেশি তিন দশক একটানা দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তারা এ মর্যাদার পদে আসীন হলেন। বাংলাদেশের ব্যাংকের করিডোরে কানাঘুষা ছিল যে, কেবল অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি থাকলেই এ পদের জন্য বিবেচনা করা হবে। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা দেখতে পেলাম অন্য চিত্র। নিয়োগদানের সঙ্গে যুক্তরা অন্তত দুটি পদের ক্ষেত্রে আরও আপস করেছেন। একজন নারী এই প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদে নিযুক্ত হলেন। আমরা একে স্বাগত জানাই। তবে নারীর ক্ষমতায়নে এ বিষয়টি কতটা ভূমিকা রাখবে_ তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জনে সরকারের আন্তরিকতা থাকা উচিত এবং তার লক্ষণও রয়েছে। কিন্তু এ জন্য ক্ষেত্র নির্বাচনে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। পাকিস্তানে কয়েক বছর আগে ড. শামসাদ আকতারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি সফল ছিলেন। তবে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে সেই তরুণীর বক্তব্য_ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে বৈদেশিক খাতের ব্যবস্থাপনা। এ খাতের গুরুত্ব নিয়ে বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন নেই। অর্থনীতিতে আমাদের পরনির্ভরতা রয়েছে। এর মধ্যেই দেশটি বেশি বেশি জড়িয়ে পড়ছে উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের অর্থনীতির সঙ্গে। বিশ্ব অর্থনীতি ভালো নাকি মন্দ পথে চলছে, সেটা শুধু ঢাকায় বসে নয়, সুদূর পল্লী এলকায় থেকেও টের পাওয়া যায়। আমার জানামতে, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে চারজন ডেপুটি গভর্নর রয়েছেন তাদের কারই মনিটরি প্লানিং, প্রোগ্রামিং কিংবা বৈদেশিক খাত ব্যবস্থাপনার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। তদুপরি, আমি নিজের কাছেই প্রশ্ন তুলি_ একটি পুরোদস্তুর পেশাদার প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র পদগুলোতে কোটা-সুবিধা অনুসরণের কোনো যুক্তি আছে কি-না। আমার শুভানুধ্যায়ীরা বলেন, নাক সিটকানো মনোভাবের জন্য আমি ইতিমধ্যেই 'প্রভাবশালী মহলের' বিরাগভাজন হয়ে পড়েছি। কেউ কেউ সম্ভবত ক্ষুব্ধও। অতএব, এ পথে আর না চলাই ভালো। বিগত চার দশকে আমাদের মাতৃভূমির বৈদেশিক সংযোগ বিপুলভাবে বেড়েছে। রফতানি খাত থেকে আয় বছরে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। আমদানির জন্য বছরে ব্যয় করতে হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি। প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি কাজ করেন তারা বছরে দেশে পাঠাচ্ছেন ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। সেবা খাতে পরিশোধ ২০০ কোটি ডলারের বেশি। জিডিপিতে বৈদেশিক খাতের হিস্যা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আমরা দ্রুত ভিয়েতনাম কিংবা ইন্দোনেশিয়ার মতো অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে চলেছি_ এমনটিই ভাবা হচ্ছে। এখন আমাদের নিয়ন্ত্রকরা নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে পূর্ব এশিয়ার সংকটের সময়ে যেভাবে সিরিয়াস হয়েছিলেন, তেমন তৎপর হলেও বাইরের অভিঘাত থেকে দেশ কিংবা অর্থনীতিকে পুরোপুরি রক্ষা করতে পারবেন না। এখানেই এড়িয়ে চলার মনোভাব পরিত্যাগ করার প্রশ্ন আসবে, দক্ষ ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকবে। আমাদের কেবল সমস্যা স্বীকার করলেই চলবে না, বরং অর্থনীতিতে তার প্রভাব যতটা কমিয়ে রাখা যায় সে জন্য সক্রিয় চেষ্টা চালাতে হবে। এ জন্য ভালোভাবে হোমওয়ার্ক করা চাই। থাকা চাই যথাযথ প্রস্তুতি। যেসব বিজনেস হাউস বা আমদানিকারক বছরে ১০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেন কিংবা যেসব বাংলাদেশি বছরে ২৫ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি করেন তারা সঙ্গতভাবেই বিশ্ববাজারে নিজের স্থান করে নেওয়ার জন্য আরও বেশি নীতিগত সমর্থন প্রত্যাশা করবেন। তারা অবশ্যই চাইবেন মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস কিংবা একই ধরনের দেশগুলোর মতো অর্থনীতি ও বাজারে সংস্কারের মাধ্যমে যে ধরনের সুবিধা ভোগ করছে তেমনটি বাংলাদেশের জন্যও অর্জন করতে।
আমাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা ক্রমাগত বাড়ছে। তারা আরও সিনথেটিক ও আর্থিক প্রোডাক্ট চাইছেন। বাজার আরও খুলে যাবে_ এটাও তাদের বিবেচনায় অপরিহার্য। অন্যদিকে, জনসাধারণের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের প্রতি বেশি বেশি আগ্রহ।
তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। আমাদের উন্নয়ন অংশীদাররা হয় গ্রহণ করো নতুবা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করো_ এ নীতি আঁকড়ে ধরে আছে। তারা বাজারের আকস্মিক পরিবর্তন মোকাবেলায় অপ্রচলিত পথে চলতে দিতে নারাজ। এমনকি তার অনুমোদন মিললেও ওষুধ যদি 'মেয়াদোত্তীর্ণ' হয়ে যায়, তাহলে সুফল মেলে না।
কেলগ স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের ডিন এবং আমার শিক্ষক দীপক জৈন বর্লেিছলেন, কেবল মধ্যমমানের লোকেরা অতীত আঁকড়ে থাকতে পছন্দ করে এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও নেতৃত্বগুণ যাদের রয়েছে তারা আস্থার সঙ্গে তাকায় ভবিষ্যৎপানে। সুতরাং আমরা কেবল অতীত নিয়ে বসে থাকতে পারি না। যারা অগ্রজ রয়েছেন এবং যাদের দ্বারা কাজের কাজটি হতে পারে, তাদের সবার প্রতি আবেদন কী কী জরুরি ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় তা চিহ্নিত করুন। নিয়ন্ত্রণমূলক যেসব কাজ করতে হবে তা স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করুন। অন্যথায় 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' কিংবা মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হওয়া আরও অনেক দিন অধরা থেকে যাবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যাব, শহীদদের স্বপ্নের পথে চলার প্রেরণা জোগাব, কিন্তু সামনে চলার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করতে না পারলে অর্জনের খাতা ভরবে না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এটাই দেখতে চায় যে, আমরা বিশ্বের বাস্তবতাকে বুদ্ধিমত্তার তীব্র ঘাটতি দিয়ে নয়, বরং প্রজ্ঞা, সাহস ও সৃজনশীলতার সঙ্গে মোকাবেলা করি।
মামুন রশীদ :ব্যাংকার ও কলাম লেখক
No comments