এই দিনে-মাসিক বাড়িভাড়া ১০০ টাকা
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকার অদূরে এক কলেজে তখন শিক্ষকতা করি। একদিন ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েছি। অমনি পেছন থেকে একজন ডাকলেন। ফিরে তাকালাম। তিনি সালাম দিয়ে বললেন, ‘আমি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের (...) কমিউনিটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। আমার একমাত্র মেয়ের গুরুতর অসুখ। তার চিকিৎ সার জন্য সাহায্য চাই।’
আমি হতবাক। শিক্ষক এসেছেন সাহায্য চাইতে! বললাম, ছি, লজ্জা করে না শিক্ষক হয়ে ভিক্ষা করতে? দারিদ্র্যে অকালবৃদ্ধ শিক্ষক নিরুত্তর। আমি ঘৃণায় ফিরে যেতেই লক্ষ করলাম, তাঁর চোখ অশ্রুপূর্ণ।
আমি ওই পবিত্র জলের কাছে আত্মসমর্পণ করে বললাম, আপনি যা বেতন পান বা টিউশনি করে যা পান, তা দিয়ে কি চিকিৎ সা করাতে পারেন না? তিনি বললেন, ‘বেতন এক হাজার ২০০ টাকা। গরিব মানুষের গ্রাম। টিউশনিতে ছাত্রপ্রতি ১০ টাকা। সব মিলিয়ে মাসে ৭০-৮০ টাকা।’ বললাম, আর কী করেন। তিনি বললেন, ‘দুই গ্রাম দূরে সন্ধ্যার পরে রিকশা চালাই। এ দিয়েই সংসার চলে। মেয়ের চিকিৎ সার টাকা নিজ এলাকায় তুলতে লজ্জা লাগে। তাই এখানে এসেছি। এখানে তো কেউ চেনে না।’
রোগাক্রান্ত কন্যার অসহায় দরিদ্র বাবার সামনে মাথা নিচু করে বললাম, সপ্তাহ পরে আসবেন। সাধ্যমতো সহযোগিতা করব।
এরপর ওই শিক্ষকের মেয়ের চিকিৎ সার জন্য আমাদের কলেজে ছাত্রদের নিয়ে স্বল্প প্রস্তুতিতে বইমেলা করেছিলাম। এই মেলা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েছিলাম তাঁকে। সাহায্য চাইনি কারও কাছে। কারণ, শত হলেও শিক্ষক তো! ভিক্ষালব্ধ টাকায় তাঁর উপকার করলে শিক্ষকসমাজকে যে খুব ছোট করা হতো।
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বিশ্বের দেশে দেশে আজ আনন্দ শোভাযাত্রা হচ্ছে; সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক ও আলোচনা সভা হচ্ছে। আনন্দ উৎ সবে মেতেছেন বহু শিক্ষক। আপ্যায়ন ও অনুষ্ঠানের জন্য ব্যয় হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। এর মধ্যে আজ খুব মনে পড়ছে মির্জাপুরের ওই শিক্ষককে। তিনি কি জানেন, আজ বিশ্ব্ব শিক্ষক দিবস? তিনি কি জানেন, ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আন্তসরকার সম্মেলন। ওই সম্মেলনে শিক্ষকদের মর্যাদাসংক্রান্ত এক ঐতিহাসিক সুপারিশ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। চারটি বিশ্ব শিক্ষক সংগঠনের সার্বিক সহযোগিতায় ইউনেসকো ও আইএলওর যৌথ উদ্যোগে প্রণীত সুপারিশে শিক্ষকদের জন্য সাতটি নীতিনির্ধারণের দাবি উপস্থাপন করা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল—শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, পেশাগত অধিকার নিশ্চিত করা, কর্মজীবনে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, কাজের ঘণ্টা, ছুটি ও বেতন-ভাতা সুনির্দিষ্ট করা, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান ইত্যাদি। সম্মেলনে গৃহীত এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে স্বাক্ষর করেছিলেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। সেই থেকে শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার স্বীকৃতির এ ঐতিহাসিক দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে।
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ৪৫তম বার্ষিকী। এ দিবসে বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজের জীবনচিত্রটি কেমন? তাঁরা কেমন আছেন? এই তো কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরণ অনশন করেছিলেন কমিউনিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। তাঁরা দিনের পর দিন কাফনের কাপড় পরে থেকেছেন। তাঁদের দাবি ছিল বেতন বাড়ানোর। লজ্জার কথা, তাঁদের বেতন ছিল এক হাজার ২০০ টাকা। আরও লজ্জার কথা, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মাসিক বাড়িভাড়া দেওয়া হয় মাত্র ১০০ টাকা! বাংলাদেশের কোথাও কি ১০০ টাকায় কোনো ঘরভাড়া পাওয়া যায়? তাহলে এই পরিহাসের অর্থ কী? বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এক হওয়ার পরও বেসরকারি কলেজের সামান্য কয়েকজন শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। বাকিরা অবসরপূর্ব পর্যন্ত প্রভাষকই থেকে যান। বেসরকারি কলেজে বহু শিক্ষক প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে ৩০ বছর চাকরি করে একই পদে থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বিচিত্র পদ্ধতি! এ ছাড়া বেসরকারি স্কুল-কলেজে আছে পরিচালনা কমিটি। কোথাও কোথাও এ পরিচালনা কমিটি সিন্দাবাদের ভূত হয়ে শিক্ষকসমাজের কাঁধে চেপে বসেছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের অজস্র সমস্যা সমাধানের কথা কি ভাবা যায় না? এ কথা সত্যি, সরকারের সাধ্য সীমিত। তার পরও এ অভিযোগ অসত্য নয় যে বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজ প্রকৃত অর্থেই অবহেলিত। তাঁদের প্রতি যথার্থ মমতা ও শ্রদ্ধা সব সময় সবাই প্রদর্শন করেননি।
অভিযোগ আছে, আগের মতো নিবেদিত শিক্ষক নেই। সত্যি কথা। ডিরোজিও, বিদ্যাসাগরের মতো শিক্ষকের খুব অভাব। এ অভাব শিগগির মিটবে বলে মনে হয় না। অস্বীকার করার উপায় নেই দৃঢ়, নৈতিকতাসম্পন্ন, সৎ , কর্মনিষ্ঠ ও ত্যাগী শিক্ষক এখন পাওয়া যায় না। মেধাবীরা যৌক্তিক কারণে শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী নন। তা ছাড়া মাথা হেঁট করে দেওয়ার মতো নরপশু শিক্ষকও আছে। ছাত্রী ধর্ষক, লম্পট, প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ কারী, প্রশ্ন বিক্রেতা, স্কুলের ফ্যান চোরসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতিপয় নষ্টজনও আছে শিক্ষকদের মধ্যে।
তার পরও এ কথা সত্যি, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পরার্থপর পেশাজীবী যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য শিক্ষকসমাজ। বহু বিচিত্র অমাবস্যার মধ্যে যেন এখন ক্ষীণ নক্ষত্রের আলো। এই আলোকে দীপ্ত করা প্রয়োজন। নতুবা আঁধার গ্রাস করবে জাতির ভবিষ্যৎ ।
বিশ্বাস করি, বৃক্ষ যদি যথার্থ পরিচর্যাবঞ্চিত হয়, প্রত্যাশিত ফুল ও ফল হয় না। তেমনি শিক্ষকসমাজকে বঞ্চিত রেখে শিক্ষার্থী ও জাতির উন্নতি কল্পনা করা বোকামি। তাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে কামনা, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষকসমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন করা হোক।
রতন সিদ্দিকী
অধ্যাপক ও নাট্যকার।
No comments