যুক্তি তর্ক গল্প-গণ-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে আওয়ামী লীগ? by আবুল মোমেন
মনে আছে নিশ্চয় অনেকের গতবার অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ প্রথম সাড়ে তিন বছর বেশ ভালোই চালিয়েছিল। কিন্তু পরের দেড় বছরে টেন্ডারবাজিসহ লুণ্ঠনবৃত্তির বাড়াবাড়ির ফলে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এর ফলে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হারতে হয় আওয়ামী লীগকে।
বিএনপি-জামায়াত জোট অবশ্য শুরু থেকেই সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গি তোষণ এবং লুটপাটের ধারা শুরু করে দেয়। এই সরকারের মেয়াদ শেষে পরবর্তী নির্বাচনের আগেকার ভয়ংকর রাজনৈতিক সংঘাত এবং ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ এখানে টানছি না। আজকের আলোচনার মূল বিষয় অন্য।
২০০৮-এর ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিশাল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এবারও প্রথম তিন বছর ভালোভাবে চালানোর পর আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, ছাত্রলীগ বা সেই নামধারীদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে। একে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষকে জীবন ধারণ নিয়েই বেশ চাপের মধ্যে পড়তে হয়েছে, তার ওপর যদি ক্ষমতাসীনদের চোটপাট ও লুটপাট বাড়তে থাকে তাতে তাদের মন তো বিরূপ হবেই। মানুষের মনের খবর ক্ষমতাসীন মহল রাখে কি না আমরা জানি না, তবে সমাজ জীবনের নানা স্তরে মানুষের আলাপ, মন্তব্য, কথাবার্তা শুনলে যে বারতা মেলে তাতে ক্ষোভ, উষ্মা ও বিরূপতার ভাবটা বাড়ছে বলে মনে হয়। প্রথম আলোর জরিপে এই আলামত অনেকটাই উঠে এসেছে, আর সম্প্রতি যুগান্তর পত্রিকা সরাসরি আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে যে জরিপ চালিয়েছে তাতেও কেবল পূর্ববর্তী নির্বাচনসমূহের ধারাবাহিকতায় সরকার পরিবর্তনের রায় এসেছে তা নয়, বিএনপির বিরাট বিজয় ও আওয়ামী লীগের বিশাল পরাজয়ের ইঙ্গিতই এসেছে।
নির্বাচনের আরও দুই বছর বাকি আছে। শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী হবে তা আমরা জানি না। কিন্তু এই সূত্রে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।
ক্ষমতায় বসে চোটপাট ও লুটপাট চালানোর ক্ষমতা ও প্রবণতা দুই বড় দলেরই প্রায় সমান। এ নিয়ে সচেতন মানুষের মনে আফসোস, উদ্বেগ, হতাশা এবং ক্ষোভের কোনো শেষ নেই। অসংখ্য গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশের মানুষ বারবার অপশক্তিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে জনগণের শক্তি তথা প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। কিন্তু চোটপাট ও লুটপাটের রাজনীতি বারবার এই সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করেছে। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গণমুখিতার মানের উন্নতি হয়নি, সেই সঙ্গে দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনাও একইভাবে চলছে। সংসদ অকার্যকর হয়ে থাকল, সংঘাতময় রাজনীতির ধারা অব্যাহত রইল। তবে সমাজ জীবনে নানা পরিবর্তন ও উন্নতি হয়েছে, উৎপাদন ও অর্থনীতিতেও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আছে। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংঘাত ও দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার পুরোনো খাতে প্রবাহিত হতে থাকায় দেশের আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না।
এখন একটি দেশের সার্বিক অগ্রগতির জন্য কেবল অর্থনীতি বা সামাজিক ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন হলে হবে না। তার রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তাভাবনায় অগ্রগতি হতে হবে। নয়তো যেকোনো ব্যবস্থাই যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। সম্প্রতি আরব বিশ্বে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে আমরা দেখি শক্ত স্বৈরাচার, সফল শাসক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মতো বাস্তবতাও যথাযথ রাজনৈতিক দর্শন বা লক্ষ্যাদর্শের শূন্যতার ফলে সৃষ্ট দুর্বলতা ঠেকাতে পারেনি। পশ্চিমারা কলকাঠি নেড়েছে অবশ্যই। কিন্তু তা নাড়ানোর সুযোগটা পায় রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে। ইরানে বা কিউবায় হাত দিতে সাম্রাজ্যবাদ ভয় পায়, কারণ সেসব দেশে সরকারের রয়েছে শক্ত দুটি ভিত্তি—রাজনৈতিক দর্শন এবং তার ভিত্তিতে জনগণের ঐক্য। ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম বা বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রুখতে পারেনি। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা নিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব বা বিএনপি-পন্থীদের অভিযোগ হলো এঁরা আওয়ামী পন্থী। আবার যাঁরা এই সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ হতে পারেন না যখন দেখেন বিএনপি কেবল ক্ষমতা নয় আদর্শিকভাবেও ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকেই সামনে নিয়ে আসছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল রাজনীতিকে কোণঠাসা করার জন্য কাজে লাগাতে চাইলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে। জামায়াতকে পুনর্বাসিত করলেন, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতার অংশীদার করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বেগম জিয়ার সরকার ইসলামি জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
দেশের রাজনীতিকে এই জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়া বা ফেরানোর যে রাজনীতি তা কোনোভাবেই দেশ ও মানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। এ দেশের সব আন্দোলনের মূল লক্ষ্য কিন্তু বরাবর একই। ভাষা আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনগুলোর লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচার এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও উদার মানবতার ধারাকে বিজয়ী করা, এগিয়ে নেওয়া। সেটা বায়ান্ন বলুন, একাত্তর বলুন, নব্বই বলুন বারবারই অর্জিত হয়েছে। কিন্তু আন্দোলন বা সংগ্রামের বিজয়কে জনগণের জীবনে সফল করে তুলতে চাই এই রাজনীতিকে ধারণ করে দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠন।
কিন্তু বিষয়টা ভুললেও চলবে না, রাজনীতি ও সরকারের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মানুষ অগ্রাধিকার নির্ণয়ে তারতম্য করে থাকে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন ইত্যাদি যত গুরুত্ব পায় সরকারের পারফরমেন্সের বিচারে তা পায় না। সেখানে দ্রব্যমূল্য, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, শেয়ারবাজার পরিস্থিতি এবং দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা, স্বজনতোষণ ইত্যাদি বেশি গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ রাজনীতি তখন মূল বিবেচ্য থাকে না, থাকে বাস্তবে কী পেলাম কী পাইনি তার হিসাব।
ফলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি মনে করে যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও লক্ষ্যাদর্শ ঠিক আছে, অতএব সচেতন দেশপ্রেমিক জনগণ ভোট দিয়ে তাদেরই জয়যুক্ত করবে, তাহলে সেটা হবে মস্ত বড় ভুল। অতীত থেকে এই শিক্ষা তাদের নেওয়া উচিত।
এদিকে যেসব বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মানুষ দেশ, গণতন্ত্র ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজনৈতিক আদর্শিক পট পরিবর্তনের বিপদটাকে মানতে পারেন না তাঁরা ক্ষোভ, রাগ, অভিমান সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে যান। তাতে তাঁরা দেশের বড় একটি অংশের মানুষের কাছে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েন ও সমাজ জীবনে কার্যকারিতা হারাতে থাকেন। এটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি এবং আখেরে আওয়ামী লীগের জন্যই ক্ষতিকর।
নব্বইয়ের পর থেকে সূচিত গণতান্ত্রিক পর্বে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুবার ক্ষমতায় গেল। কিন্তু ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যা দরকার তা ঠিকঠাকমতো করছে না। ক্ষমতায় বসে চোটপাট ও লুটপাটের ধারা জাঁকিয়ে বসছে এখন। সরকারের মূল্যায়নে মানুষ আগের মতো আচরণই করছে বলে মনে হয় সাম্প্রতিক জরিপগুলোর ফলাফলে।
আওয়ামী লীগ যদি মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও শুভবোধ এবং সরকারের জঙ্গিবিরোধী ভূমিকার জন্য প্রতিবেশী দেশ ও বৃহৎ শক্তির বাড়তি সহায়তায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখে থাকে তাহলেও ভুল করবে। কারণ দেখা যাচ্ছে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন আজকাল আর জনগণের রায় ওলটপালট করে দেওয়া সম্ভব নয়।
ইতিহাস এবং এ দেশের জনগণ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে এ দুঃখী বঞ্চিত বারবার প্রতারিত দেশ ও দেশবাসীকে উন্নতির সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার এক মহান দায়িত্ব দিয়েছিল। সব সংকীর্ণ দলীয় চিন্তা, সব রকম স্বার্থচিন্তাকে বাদ দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল মূল কাজ। তারপর সেই ঐক্যবদ্ধ উদ্বুদ্ধ জাতি যেন সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে বিশাল কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, সেই পরিবেশ ও কর্মসূচি সৃষ্টি ছিল তাঁদের দ্বিতীয় কাজ। এভাবে একদিন রাজনীতি এগিয়েছিল বলে গণবিরোধী পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক চিন্তার দল মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে পড়েছিল। প্রতিক্রিয়া ও পশ্চাৎপদতার শক্তিকে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় করে আনার এটাই প্রক্রিয়া।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এ বিষয়গুলো না বুঝলে এবং এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম না হলে দেশের ও মানুষের দুর্গতি সহজে ঘুচবে না। জাতিকে অপেক্ষা করতে হবে আওয়ামী লীগের রূপান্তর কিংবা নতুন রাজনৈতিক শুভশক্তির উত্থানের জন্য। আপাতত সে রকম কোনো আলামত দেশে তো দেখা যাচ্ছে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
২০০৮-এর ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিশাল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এবারও প্রথম তিন বছর ভালোভাবে চালানোর পর আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, ছাত্রলীগ বা সেই নামধারীদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে। একে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষকে জীবন ধারণ নিয়েই বেশ চাপের মধ্যে পড়তে হয়েছে, তার ওপর যদি ক্ষমতাসীনদের চোটপাট ও লুটপাট বাড়তে থাকে তাতে তাদের মন তো বিরূপ হবেই। মানুষের মনের খবর ক্ষমতাসীন মহল রাখে কি না আমরা জানি না, তবে সমাজ জীবনের নানা স্তরে মানুষের আলাপ, মন্তব্য, কথাবার্তা শুনলে যে বারতা মেলে তাতে ক্ষোভ, উষ্মা ও বিরূপতার ভাবটা বাড়ছে বলে মনে হয়। প্রথম আলোর জরিপে এই আলামত অনেকটাই উঠে এসেছে, আর সম্প্রতি যুগান্তর পত্রিকা সরাসরি আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে যে জরিপ চালিয়েছে তাতেও কেবল পূর্ববর্তী নির্বাচনসমূহের ধারাবাহিকতায় সরকার পরিবর্তনের রায় এসেছে তা নয়, বিএনপির বিরাট বিজয় ও আওয়ামী লীগের বিশাল পরাজয়ের ইঙ্গিতই এসেছে।
নির্বাচনের আরও দুই বছর বাকি আছে। শেষ পর্যন্ত ফলাফল কী হবে তা আমরা জানি না। কিন্তু এই সূত্রে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।
ক্ষমতায় বসে চোটপাট ও লুটপাট চালানোর ক্ষমতা ও প্রবণতা দুই বড় দলেরই প্রায় সমান। এ নিয়ে সচেতন মানুষের মনে আফসোস, উদ্বেগ, হতাশা এবং ক্ষোভের কোনো শেষ নেই। অসংখ্য গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশের মানুষ বারবার অপশক্তিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে জনগণের শক্তি তথা প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। কিন্তু চোটপাট ও লুটপাটের রাজনীতি বারবার এই সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করেছে। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গণমুখিতার মানের উন্নতি হয়নি, সেই সঙ্গে দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনাও একইভাবে চলছে। সংসদ অকার্যকর হয়ে থাকল, সংঘাতময় রাজনীতির ধারা অব্যাহত রইল। তবে সমাজ জীবনে নানা পরিবর্তন ও উন্নতি হয়েছে, উৎপাদন ও অর্থনীতিতেও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আছে। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংঘাত ও দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার পুরোনো খাতে প্রবাহিত হতে থাকায় দেশের আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না।
এখন একটি দেশের সার্বিক অগ্রগতির জন্য কেবল অর্থনীতি বা সামাজিক ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন হলে হবে না। তার রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তাভাবনায় অগ্রগতি হতে হবে। নয়তো যেকোনো ব্যবস্থাই যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। সম্প্রতি আরব বিশ্বে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে আমরা দেখি শক্ত স্বৈরাচার, সফল শাসক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মতো বাস্তবতাও যথাযথ রাজনৈতিক দর্শন বা লক্ষ্যাদর্শের শূন্যতার ফলে সৃষ্ট দুর্বলতা ঠেকাতে পারেনি। পশ্চিমারা কলকাঠি নেড়েছে অবশ্যই। কিন্তু তা নাড়ানোর সুযোগটা পায় রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে। ইরানে বা কিউবায় হাত দিতে সাম্রাজ্যবাদ ভয় পায়, কারণ সেসব দেশে সরকারের রয়েছে শক্ত দুটি ভিত্তি—রাজনৈতিক দর্শন এবং তার ভিত্তিতে জনগণের ঐক্য। ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনাম বা বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রুখতে পারেনি। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা নিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব বা বিএনপি-পন্থীদের অভিযোগ হলো এঁরা আওয়ামী পন্থী। আবার যাঁরা এই সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ হতে পারেন না যখন দেখেন বিএনপি কেবল ক্ষমতা নয় আদর্শিকভাবেও ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকেই সামনে নিয়ে আসছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল রাজনীতিকে কোণঠাসা করার জন্য কাজে লাগাতে চাইলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে। জামায়াতকে পুনর্বাসিত করলেন, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতার অংশীদার করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বেগম জিয়ার সরকার ইসলামি জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
দেশের রাজনীতিকে এই জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়া বা ফেরানোর যে রাজনীতি তা কোনোভাবেই দেশ ও মানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। এ দেশের সব আন্দোলনের মূল লক্ষ্য কিন্তু বরাবর একই। ভাষা আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনগুলোর লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচার এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও উদার মানবতার ধারাকে বিজয়ী করা, এগিয়ে নেওয়া। সেটা বায়ান্ন বলুন, একাত্তর বলুন, নব্বই বলুন বারবারই অর্জিত হয়েছে। কিন্তু আন্দোলন বা সংগ্রামের বিজয়কে জনগণের জীবনে সফল করে তুলতে চাই এই রাজনীতিকে ধারণ করে দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠন।
কিন্তু বিষয়টা ভুললেও চলবে না, রাজনীতি ও সরকারের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মানুষ অগ্রাধিকার নির্ণয়ে তারতম্য করে থাকে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন ইত্যাদি যত গুরুত্ব পায় সরকারের পারফরমেন্সের বিচারে তা পায় না। সেখানে দ্রব্যমূল্য, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, শেয়ারবাজার পরিস্থিতি এবং দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা, স্বজনতোষণ ইত্যাদি বেশি গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ রাজনীতি তখন মূল বিবেচ্য থাকে না, থাকে বাস্তবে কী পেলাম কী পাইনি তার হিসাব।
ফলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি মনে করে যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও লক্ষ্যাদর্শ ঠিক আছে, অতএব সচেতন দেশপ্রেমিক জনগণ ভোট দিয়ে তাদেরই জয়যুক্ত করবে, তাহলে সেটা হবে মস্ত বড় ভুল। অতীত থেকে এই শিক্ষা তাদের নেওয়া উচিত।
এদিকে যেসব বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মানুষ দেশ, গণতন্ত্র ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজনৈতিক আদর্শিক পট পরিবর্তনের বিপদটাকে মানতে পারেন না তাঁরা ক্ষোভ, রাগ, অভিমান সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে যান। তাতে তাঁরা দেশের বড় একটি অংশের মানুষের কাছে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েন ও সমাজ জীবনে কার্যকারিতা হারাতে থাকেন। এটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি এবং আখেরে আওয়ামী লীগের জন্যই ক্ষতিকর।
নব্বইয়ের পর থেকে সূচিত গণতান্ত্রিক পর্বে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুবার ক্ষমতায় গেল। কিন্তু ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যা দরকার তা ঠিকঠাকমতো করছে না। ক্ষমতায় বসে চোটপাট ও লুটপাটের ধারা জাঁকিয়ে বসছে এখন। সরকারের মূল্যায়নে মানুষ আগের মতো আচরণই করছে বলে মনে হয় সাম্প্রতিক জরিপগুলোর ফলাফলে।
আওয়ামী লীগ যদি মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও শুভবোধ এবং সরকারের জঙ্গিবিরোধী ভূমিকার জন্য প্রতিবেশী দেশ ও বৃহৎ শক্তির বাড়তি সহায়তায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখে থাকে তাহলেও ভুল করবে। কারণ দেখা যাচ্ছে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন আজকাল আর জনগণের রায় ওলটপালট করে দেওয়া সম্ভব নয়।
ইতিহাস এবং এ দেশের জনগণ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে এ দুঃখী বঞ্চিত বারবার প্রতারিত দেশ ও দেশবাসীকে উন্নতির সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার এক মহান দায়িত্ব দিয়েছিল। সব সংকীর্ণ দলীয় চিন্তা, সব রকম স্বার্থচিন্তাকে বাদ দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছিল মূল কাজ। তারপর সেই ঐক্যবদ্ধ উদ্বুদ্ধ জাতি যেন সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে বিশাল কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, সেই পরিবেশ ও কর্মসূচি সৃষ্টি ছিল তাঁদের দ্বিতীয় কাজ। এভাবে একদিন রাজনীতি এগিয়েছিল বলে গণবিরোধী পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক চিন্তার দল মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে পড়েছিল। প্রতিক্রিয়া ও পশ্চাৎপদতার শক্তিকে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় করে আনার এটাই প্রক্রিয়া।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এ বিষয়গুলো না বুঝলে এবং এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম না হলে দেশের ও মানুষের দুর্গতি সহজে ঘুচবে না। জাতিকে অপেক্ষা করতে হবে আওয়ামী লীগের রূপান্তর কিংবা নতুন রাজনৈতিক শুভশক্তির উত্থানের জন্য। আপাতত সে রকম কোনো আলামত দেশে তো দেখা যাচ্ছে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments