মত ও মন্তব্য-আর কতকাল এই স্তব্ধ, ভাষারুদ্ধ মৃত্যুর যাতনা? by হারুন হাবীব
কিছু কিছু শোক ভাষারুদ্ধ করে, কণ্ঠ চেপে ধরে আদিম বন্যতার অপ্রতিরোদ্ধ শক্তিতে, অবাক-নিথর চোখে শুধুই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চারপাশ তাকিয়ে শব্দহীন, ব্যঞ্জনাহীন, অনুভূতিহীন অব্যক্ত যন্ত্রণার সাগরে ডুবিয়ে মারে। এ যেন আরেক মৃত্যু, আরেক মরণ, যার শোক জানানোর ভাষা জানা নেই। ক্যাথরিনের সঙ্গে আমার কখনো কথা হয়নি।
কিন্তু তারেক মাসুদ_যে নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক সম্ভাবনা, অনেক প্রতিশ্রুতি, অনেক খ্যাতি, ওর মৃত্যু নিয়ে লিখতে হবে কখনো ভাবিনি। কিন্তু মৃত্যুর নির্মম কালো থাবা থামিয়ে দিল এ সময়ের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল, সবচেয়ে সৃষ্টিশীল এই চলচ্চিত্রকারের জীবন। কে যেন কথাটা বললেন, আমারও তা-ই মনে হলো_সত্যিই তো, এ যেন ভোরের আলোয় হারিয়ে যাওয়া শিশিরবিন্দুর মুছে যাওয়া রংধনু আঁকা স্বপ্ন। এর কী শোক, কী মাতম_আমার জানা নেই। মিশুক মুনীরকে ব্যক্তিগতভাবে জানার সুযোগ আমার হয়নি। কিন্তু শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তান মিশুকের বেশ কিছু কীর্তি জানার সুযোগ হয়েছিল। প্রবল সৃষ্টিশীল, গুরুগম্ভীর মুনীর সাংবাদিকতায় নিজের স্পষ্ট পদভার রেখে অতি-সম্প্রতি এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী হয়েছিল। কিন্তু না, সবই শেষ। বাংলাদেশের সড়কগুলোয় নিত্য যে নরবলি ঘটে, প্রকাশ্যে, অপ্রতিরোদ্ধভাবে, ক্রমাগতভাবে_তারই সর্বশেষ বলি তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ আরো কয়েকজন।
তারেকের সর্বশেষ ছবি 'রানওয়ে' দেখতে ওরই ডাকে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। মুগ্ধ হয়ে, নবপ্রজন্মের অহংকার এই সৃজনশীল শিল্পীর নির্মাণ দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। আমাদের সমাজের সংকট, সীমাবদ্ধতা, বিপদ ও সম্ভাবনা নিয়ে এতটা সাহস ও যোগ্যতায়, এতটা সৃজনশীলতায়, এতটা গ্রহণযোগ্যভাবে তারেক মাসুদের মতো আর কোনো চলচ্চিত্রকার সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিলেন বলে আমার জানা নেই। রানওয়ে দেখে গাড়িতে ফিরতে ফিরতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম মোবাইল ফোনের টেক্টস মেসেজে। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয়নি তারেক। পরে রাতে ফোনে ওর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, চেষ্টা করে যাচ্ছি হারুন ভাই, দেখি কতটা পারি। অনেকক্ষণ কথা হলো সে রাতে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার সর্বশেষ উপন্যাস 'সোনালি ঈগল ও উদ্বাস্তু সময়' নিয়ে ওর বিশেষ এক পরিকল্পনার কথা জানাল। বলল, মনোযোগের সঙ্গে পড়ছি, কিছু একটা ভাবছি। আপনাকে জানাব।
কিন্তু সে জানানোর সুযোগ তারেক যেমন পাবে না, পাব না আমিও কখনো। বয়সে ছোট সে আমার। মুক্তিযুদ্ধে ছোট বয়সে অংশ নিতে পারেনি বলে প্রবল এক দুঃখবোধ ছিল ওর। কিন্তু সেই দুঃখ সে দূর করেছে 'মুক্তির গান' নির্মাণ করে। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের 'মুক্তির গান' আমাদের সমাজকে এক বড় দুর্দিনে জাগিয়ে দিয়েছে, গা ঝাড়া দিয়ে চমকে তুলে ফিরিয়ে দিয়েছে একাত্তরের দিনগুলোয়। নিজেদের চলচ্চিত্রমাধ্যম সৃজনে তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন অন্তরঙ্গভাবে বাংলাদেশ নিয়ে ভেবেছে। স্বপ্ন দেখেছে দিন বদলের, কালের বদ্ধতাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দুয়ারে পেঁৗছে দিয়ে জন্মভূমির কাছে ঋণ শোধের চেষ্টা করেছে তারেক। কিন্তু এ দুর্ভাগা স্বদেশভূমি তাকে ধরে রাখতে পারল না। তারেক মাসুদের স্বপ্ন ভেঙে গেল। বাংলাদেশের যে সড়ক নিত্যদিন নির্বিচারে মানুষ নিধন করে চলেছে, অকাতরে খুন করে চলেছে নারী, শিশু, যুবা ও বৃদ্ধ; যে মৃত্যুর কোনো প্রবোধ নেই, সেই সড়কেই পড়ে থাকল আমাদের শ্লাঘার এই শিল্পীর দুমড়ানো-মোচড়ানো শরীর। আমাদের প্রিয় তারেক স্মৃতি হয়ে গেল চোখের পলকে। এভাবে, এতটা অকালে, মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তারেক মাসুদ চলে যাবে, কে তা ভাবতে পেরেছিল? শুধু দেশ নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের অঙ্গনকেও সজাগ করেছিল তারেক তার 'মাটির ময়না' প্রদর্শন করে। কিন্তু তার যাত্রা থেমে গেল। যে মানুষটি তার অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে অসীমের পথে হাঁটার শক্তি ধারণ করেছিল, জাতি ও বিশ্বকে যে অনেক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এই বাংলাদেশে জন্মেছিল, তাকে পড়ে থাকতে হলো মানিকগঞ্জের হাইওয়েতে ১৩ আগস্টের দুপুরে। তারেক মাদ্রাসায় পড়েছিল। বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ, তখন সে ওই বয়সেই এ সমাজের ভয়ংকর বিপন্নতার ছবি গেঁথে নিয়েছিল মনে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ। এরপর চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশে ফিরেই হাতে নেয় ছবি বানানোর কাজ। এ দেশে অনেক গুণী চলচ্চিত্রকার আছেন, ভবিষ্যতে জন্ম নেবে আরো অনেকে; কিন্তু তার সময়ে তারেক মাসুদ ছিল অসামান্য। আশির দশকে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবন নিয়ে তৈরি 'আদম সুরত' দিয়ে শুরু করে চলচ্চিত্রকারের জীবন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকায়নি। ওর স্ত্রী ক্যাথরিন ও মাসুদ যৌথভাবে, দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে গেছে সামনে। মাটির ময়না, মুক্তির কথা, ইন দ্য নেম অব সেফটি, ভয়েসেস অব চিলড্রেন, মুক্তির গান, ইউনিসন, সোনার বেড়ি, নরসুন্দর, সে, অন্তর্যাত্রা ও রানওয়ে। বলতে কারো দ্বিধা থাকা উচিত হবে না যে বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং বিকল্পধারার চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্র সংগঠক হিসেবে তারেকের অবদান অসামান্য। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার নানা দেশে, নানা বোদ্ধা সমাজে তারেক এতটাই জায়গা করে নিতে পেরেছিল যে সে তার স্বদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত করেছিল। ওর সৃষ্টি বিশিষ্টতা অর্জন করে নেয় দেশ ও বিদেশে শুধু নির্মাণশৈলীর জন্য নয়, একই সঙ্গে সমাজমনস্কতা ও দার্শনিক বক্তব্যের জন্য, বাংলাদেশের সমাজের মৌল প্রশ্ন ও দাম্ভিকতা তুলে ধরার ব্যতিক্রমী প্রয়াসের কারণে। তারেক ও ক্যাথরিনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'মাটির ময়না' কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে, প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কার প্রতিযোগিতায় বিদেশি ভাষার বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এডিনবার্গ, মন্ট্রিল, কায়রো উৎসবে বিস্ময়কর এ ছবি প্রদর্শিত হয়। মারাকেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার লাভ করে। জেনেছি, ২০০৩ সালে করাচি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও সেরা ছবির পুরস্কার লাভ করে। ২০০৪ সালে ছবিটি ব্রিটেনের ডিরেক্টরস গিল্ড পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তারেক ও ক্যাথরিন নতুন যে ছবিতে মনোনিবেশ করেছিল, তার নাম 'কাগজের ফুল'_ যার নির্মাণ আর কখনো শেষ হওয়ার নয়।
সবাই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে তারেক মাসুদ তার ছবিতে উন্মুক্ত, রাহুমুক্ত সমাজের পথে ঐক্যের স্বপ্ন দেখতে উদগ্রীব ছিল। এ ছিল তার অহংকার, প্রতিশ্রুতি ও প্রতিবাদ। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এতটা স্পষ্টভাবে, এতটা সফলতায় বাংলাদেশের আর কোনো চলচ্চিত্রকার ছবি তৈরিতে মনোনিবেশ করেননি আগে। মৃত্যু জীবনের ছেদ টানে জানি, কিন্তু মৃত্যুকেও জয় করে এ মানুষই। সীমিতকালের জন্য পৃথিবীতে আসাকে অর্থহীন করার মধ্যে আদৌ কোনো গৌরব নেই। কিন্তু যেভাবে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর চলে গেল, যেভাবে নিত্যদিন এই বাংলাদেশে পথে-ঘাটে শত শত মানুষ কীটপতঙ্গের মতো বিদায় নিচ্ছে, সে মরণের প্রতিকার কী? সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের প্রতিদিনের সহচর। কে না জনেন, এর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে চালকের অদক্ষতা ও অসতর্কতা মূল কারণ। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষ, পঙ্গুত্ববরণ করে লক্ষাধিক। এর পরও কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিকার নেই বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। অবৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স, আইন প্রয়োগকারীদের দুর্নীতি, যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত গাড়ি_ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি সড়কে অবাধে চলছে, মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাচ্ছে না। আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে গত ১৭ বছরে দুর্ঘটনায় প্রায় ৭০ হাজার ৬০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে ৭০ হাজার ৫০৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। মহাসড়কগুলোয় চালকরা নিজের ইচ্ছামতো গাড়ি চালায়_এমনকি ঢাকা শহরেও, যা পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে হওয়ার নয়। রবিবার সকালে মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের লাশ রাখা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সহস্র শোকবিহ্বল মানুষ চোখের পানিতে শ্রদ্ধা জানান এই দুই কৃতী সন্তানকে। অনেকেই কাঁদতে পারেননি, নিঃশব্দ ও বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শহীদ মিনারের বেদিতে। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের নিথর দেহের ওপর লাইন বেঁধে ফুল রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। না, কিছুই বলার নেই। বাংলাদেশের আইন, এ দেশের নিয়মনীতি, জনপ্রশাসন, রাজনীতি_সব যেন দ্রুত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পতনের এ অপ্রতিরোদ্ধ যাত্রা কে ঠেকাবে? কে ঠেকাবে এমন নিষ্ঠুর মৃত্যু, এমন নিষ্ঠুর পরিহাস?
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক
hh1971@gmail.com
তারেকের সর্বশেষ ছবি 'রানওয়ে' দেখতে ওরই ডাকে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। মুগ্ধ হয়ে, নবপ্রজন্মের অহংকার এই সৃজনশীল শিল্পীর নির্মাণ দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। আমাদের সমাজের সংকট, সীমাবদ্ধতা, বিপদ ও সম্ভাবনা নিয়ে এতটা সাহস ও যোগ্যতায়, এতটা সৃজনশীলতায়, এতটা গ্রহণযোগ্যভাবে তারেক মাসুদের মতো আর কোনো চলচ্চিত্রকার সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিলেন বলে আমার জানা নেই। রানওয়ে দেখে গাড়িতে ফিরতে ফিরতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম মোবাইল ফোনের টেক্টস মেসেজে। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয়নি তারেক। পরে রাতে ফোনে ওর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, চেষ্টা করে যাচ্ছি হারুন ভাই, দেখি কতটা পারি। অনেকক্ষণ কথা হলো সে রাতে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার সর্বশেষ উপন্যাস 'সোনালি ঈগল ও উদ্বাস্তু সময়' নিয়ে ওর বিশেষ এক পরিকল্পনার কথা জানাল। বলল, মনোযোগের সঙ্গে পড়ছি, কিছু একটা ভাবছি। আপনাকে জানাব।
কিন্তু সে জানানোর সুযোগ তারেক যেমন পাবে না, পাব না আমিও কখনো। বয়সে ছোট সে আমার। মুক্তিযুদ্ধে ছোট বয়সে অংশ নিতে পারেনি বলে প্রবল এক দুঃখবোধ ছিল ওর। কিন্তু সেই দুঃখ সে দূর করেছে 'মুক্তির গান' নির্মাণ করে। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের 'মুক্তির গান' আমাদের সমাজকে এক বড় দুর্দিনে জাগিয়ে দিয়েছে, গা ঝাড়া দিয়ে চমকে তুলে ফিরিয়ে দিয়েছে একাত্তরের দিনগুলোয়। নিজেদের চলচ্চিত্রমাধ্যম সৃজনে তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন অন্তরঙ্গভাবে বাংলাদেশ নিয়ে ভেবেছে। স্বপ্ন দেখেছে দিন বদলের, কালের বদ্ধতাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দুয়ারে পেঁৗছে দিয়ে জন্মভূমির কাছে ঋণ শোধের চেষ্টা করেছে তারেক। কিন্তু এ দুর্ভাগা স্বদেশভূমি তাকে ধরে রাখতে পারল না। তারেক মাসুদের স্বপ্ন ভেঙে গেল। বাংলাদেশের যে সড়ক নিত্যদিন নির্বিচারে মানুষ নিধন করে চলেছে, অকাতরে খুন করে চলেছে নারী, শিশু, যুবা ও বৃদ্ধ; যে মৃত্যুর কোনো প্রবোধ নেই, সেই সড়কেই পড়ে থাকল আমাদের শ্লাঘার এই শিল্পীর দুমড়ানো-মোচড়ানো শরীর। আমাদের প্রিয় তারেক স্মৃতি হয়ে গেল চোখের পলকে। এভাবে, এতটা অকালে, মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তারেক মাসুদ চলে যাবে, কে তা ভাবতে পেরেছিল? শুধু দেশ নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের অঙ্গনকেও সজাগ করেছিল তারেক তার 'মাটির ময়না' প্রদর্শন করে। কিন্তু তার যাত্রা থেমে গেল। যে মানুষটি তার অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে অসীমের পথে হাঁটার শক্তি ধারণ করেছিল, জাতি ও বিশ্বকে যে অনেক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এই বাংলাদেশে জন্মেছিল, তাকে পড়ে থাকতে হলো মানিকগঞ্জের হাইওয়েতে ১৩ আগস্টের দুপুরে। তারেক মাদ্রাসায় পড়েছিল। বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ, তখন সে ওই বয়সেই এ সমাজের ভয়ংকর বিপন্নতার ছবি গেঁথে নিয়েছিল মনে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ। এরপর চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশে ফিরেই হাতে নেয় ছবি বানানোর কাজ। এ দেশে অনেক গুণী চলচ্চিত্রকার আছেন, ভবিষ্যতে জন্ম নেবে আরো অনেকে; কিন্তু তার সময়ে তারেক মাসুদ ছিল অসামান্য। আশির দশকে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবন নিয়ে তৈরি 'আদম সুরত' দিয়ে শুরু করে চলচ্চিত্রকারের জীবন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকায়নি। ওর স্ত্রী ক্যাথরিন ও মাসুদ যৌথভাবে, দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে গেছে সামনে। মাটির ময়না, মুক্তির কথা, ইন দ্য নেম অব সেফটি, ভয়েসেস অব চিলড্রেন, মুক্তির গান, ইউনিসন, সোনার বেড়ি, নরসুন্দর, সে, অন্তর্যাত্রা ও রানওয়ে। বলতে কারো দ্বিধা থাকা উচিত হবে না যে বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং বিকল্পধারার চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্র সংগঠক হিসেবে তারেকের অবদান অসামান্য। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার নানা দেশে, নানা বোদ্ধা সমাজে তারেক এতটাই জায়গা করে নিতে পেরেছিল যে সে তার স্বদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত করেছিল। ওর সৃষ্টি বিশিষ্টতা অর্জন করে নেয় দেশ ও বিদেশে শুধু নির্মাণশৈলীর জন্য নয়, একই সঙ্গে সমাজমনস্কতা ও দার্শনিক বক্তব্যের জন্য, বাংলাদেশের সমাজের মৌল প্রশ্ন ও দাম্ভিকতা তুলে ধরার ব্যতিক্রমী প্রয়াসের কারণে। তারেক ও ক্যাথরিনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'মাটির ময়না' কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে, প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কার প্রতিযোগিতায় বিদেশি ভাষার বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এডিনবার্গ, মন্ট্রিল, কায়রো উৎসবে বিস্ময়কর এ ছবি প্রদর্শিত হয়। মারাকেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার লাভ করে। জেনেছি, ২০০৩ সালে করাচি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও সেরা ছবির পুরস্কার লাভ করে। ২০০৪ সালে ছবিটি ব্রিটেনের ডিরেক্টরস গিল্ড পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তারেক ও ক্যাথরিন নতুন যে ছবিতে মনোনিবেশ করেছিল, তার নাম 'কাগজের ফুল'_ যার নির্মাণ আর কখনো শেষ হওয়ার নয়।
সবাই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে তারেক মাসুদ তার ছবিতে উন্মুক্ত, রাহুমুক্ত সমাজের পথে ঐক্যের স্বপ্ন দেখতে উদগ্রীব ছিল। এ ছিল তার অহংকার, প্রতিশ্রুতি ও প্রতিবাদ। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এতটা স্পষ্টভাবে, এতটা সফলতায় বাংলাদেশের আর কোনো চলচ্চিত্রকার ছবি তৈরিতে মনোনিবেশ করেননি আগে। মৃত্যু জীবনের ছেদ টানে জানি, কিন্তু মৃত্যুকেও জয় করে এ মানুষই। সীমিতকালের জন্য পৃথিবীতে আসাকে অর্থহীন করার মধ্যে আদৌ কোনো গৌরব নেই। কিন্তু যেভাবে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর চলে গেল, যেভাবে নিত্যদিন এই বাংলাদেশে পথে-ঘাটে শত শত মানুষ কীটপতঙ্গের মতো বিদায় নিচ্ছে, সে মরণের প্রতিকার কী? সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের প্রতিদিনের সহচর। কে না জনেন, এর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে চালকের অদক্ষতা ও অসতর্কতা মূল কারণ। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষ, পঙ্গুত্ববরণ করে লক্ষাধিক। এর পরও কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিকার নেই বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। অবৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স, আইন প্রয়োগকারীদের দুর্নীতি, যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত গাড়ি_ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি সড়কে অবাধে চলছে, মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাচ্ছে না। আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে গত ১৭ বছরে দুর্ঘটনায় প্রায় ৭০ হাজার ৬০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে ৭০ হাজার ৫০৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। মহাসড়কগুলোয় চালকরা নিজের ইচ্ছামতো গাড়ি চালায়_এমনকি ঢাকা শহরেও, যা পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে হওয়ার নয়। রবিবার সকালে মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের লাশ রাখা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সহস্র শোকবিহ্বল মানুষ চোখের পানিতে শ্রদ্ধা জানান এই দুই কৃতী সন্তানকে। অনেকেই কাঁদতে পারেননি, নিঃশব্দ ও বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শহীদ মিনারের বেদিতে। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের নিথর দেহের ওপর লাইন বেঁধে ফুল রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। না, কিছুই বলার নেই। বাংলাদেশের আইন, এ দেশের নিয়মনীতি, জনপ্রশাসন, রাজনীতি_সব যেন দ্রুত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পতনের এ অপ্রতিরোদ্ধ যাত্রা কে ঠেকাবে? কে ঠেকাবে এমন নিষ্ঠুর মৃত্যু, এমন নিষ্ঠুর পরিহাস?
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক
hh1971@gmail.com
No comments