সৎ কর্মকর্তা ও সৎ ব্যক্তিকে সুরক্ষণ করবে কে? by এ কে এম এ বি সিদ্দিক

গত ২৮ জানুয়ারি কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ড. সা'দত হুসাইনের 'দুর্নীতিবিরোধী সৎ ব্যক্তি এবং কর্মকর্তাদের সুরক্ষণ' শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের সমাজ সচেতন এবং বিবেকবান মানুষকে লেখাটি নাড়া দেবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। লেখাটি সময়োপযোগী এবং সাহসী পদক্ষেপ। ড. সা'দতকে তাঁর লেখার জন্য ধন্যবাদ।


ড. সা'দত হুসাইন সরকারের একজন জাঁদরেল আমলা হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। সরকারের সর্বোচ্চ পদে অর্থাৎ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ক্যাবিনেট সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অবসরের পর তিনি আবার সাংবিধানিক পদ সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যানের পদে নিয়োজিত হন এবং সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন। ড. সা'দত তাঁর দীর্ঘদিনের চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি তাঁর লেখায় সৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট চিত্র এবং পার্থক্য তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য খণ্ডন করার কোনো যুক্তি আমার নেই। তিনি তাঁর লেখায় যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা প্রতিটি বিবেকবান সৎ মানুষকে নাড়া না দিয়ে পারে না। তাঁর এ কথা বাংলাদেশের সব সৎ, বিবেকবান ও সমাজ সচেতন মানুষেরই কথা। তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
ড. সা'দত তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন- 'দুর্নীতিমুক্ত স্বদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে দেশে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এসব সংস্থার উদ্যোক্তা এবং কর্মীরা সংগঠনের লক্ষ্য অর্জনের কাজ করে যাচ্ছেন।' এই সংস্থাগুলো কী কী? কবে গঠিত হয়েছে? লক্ষ্য অর্জনে তাদের সাফল্য কতটুকু? এ পর্যন্ত কতসংখ্যক দুর্নীতি তারা রোধ করতে পেরেছে? এতদসংক্রান্ত কোনো তথ্যাদি আছে কি না জানি না, ড. সা'দত তা উল্লেখ করেননি। এসব সংস্থার কাজের ইভালুয়েশন বা সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। তবে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে কোনো সংস্থার সাফল্য অর্জিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। প্রচলিত একটা কথা আছে, 'শর্ষেতে ভূত থাকলে ভূত তাড়াবে কে'- বাংলাদেশের অবস্থা তো এ রকমই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ শাখা প্রতিবছর দেশের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে থাকে। সরকারের কোন কোন বিভাগ বা সংস্থা অধিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা হয় এবং দুর্নীতির বিবরণ টিআইবি কর্তৃক উল্লেখ করা হয়। টিআইবিকে এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। গত বছর টিআইবি কর্মকর্তাদের উচ্চ আদালতে হাজির হয়ে শুনানি দিতে হয়েছিল। দেশে অন্য কোনো সংস্থা যদি দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে উদ্যোগী হয়, তাহলে তাদের যে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়- এ কথায় কি কোনো সন্দেহ আছে? পুলিশের দুর্নীতি ধরা হলে পুলিশ ক্ষিপ্ত হয় এবং অসহযোগিতা করে, ইনকাম ট্যাঙ্ ও কাস্টমসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির কথা দেশের কে না জানে। প্রতিদিন শিল্প মালিক, ব্যবসায়ীরা কাস্টমস, বন্ড কাস্টমস বিভাগের ঊর্ধ্বতন থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে থাকেন- এ কথা কোনো ব্যবসায়ী বা শিল্প মালিক কি অস্বীকার করবেন? এবং তাঁরা কখনো অভিযোগ করবেন না। কারণ তাঁদের ব্যবসা কিংবা শিল্পের উন্নতি বা সম্প্রসারণের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। যে পরিমাণ ঘুষ দিয়ে থাকেন, তার ১০ থেকে ১০০ গুণ তাঁরা লাভবান হচ্ছেন। শুধু সরকার বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে। শুনেছি, আয়কর বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ মহিলা কর্মকর্তা যুগ্ম কমিশনার পদে থাকাকালীন ঢাকায় দু-তিনটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক ছিলেন। নগদ টাকার পরিমাণ এবং আর কী কী সম্পদ ছিল তা তো জানা সম্ভব নয়। তবে আরো দুটি পদোন্নতির পর ঢাকা মহানগরীতে তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাত-আটটি। শুনেছি, তিনি তাঁর পিএ-কে একটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হতে সহায়তা করেছেন। পিএ সাহেবের কাছে তিনি যে ঋণী। পিএ সাহেবই তাঁকে অগাধ সম্পদের মালিক হতে সাহায্য করেছেন। শুধু এই মহিলা কর্মকর্তাই নন, আয়কর বিভাগ কিংবা শুল্ক বিভাগের পিয়ন বা চাপরাশি থেকে শুরু করে ইন্সপেক্টর, সুপারিনটেনডেন্ট, সহকারী কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত অধিকাংশ পুরুষ, মহিলা কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিদিন ঘুষের টাকা পেয়ে থাকেন- এ কথা আজ গোপন রাখার কোনো বিষয় নয়। তাঁরা সমাজে অত্যন্ত দাপটে চলেন এবং নিজেদের সরকারের ঘনিষ্ঠ লোক বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কে তাঁদের প্রতিরোধ করবে?
বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চাকরিতে নিয়োজিত হওয়ার পর পরই বেশির ভাগ কর্মকর্তা অতি উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠেন। নিজেদের আর্থিকভাবে সচ্ছল করার লক্ষ্যে তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। চাকরি পাওয়ার দু-তিন বছর পরই ঢাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ের ইচ্ছা জাগ্রত হয়। তারপর একটি নিজস্ব গাড়ি। বিবাহিত হলে স্ত্রীর অনেক শৌখিন খায়েশ তাঁকে মেটাতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর অর্থের। তাই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অন্য কোনো বিকল্প থাকে না। আর বাংলাদেশে ঘুষ দিয়ে কাজ করানো খুবই সহজ। মনে পড়ে, একবার এক বিদেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি বলেছিলেন, 'তোমাদের দেশে যেকোনো কাজ অর্থের বিনিময়ে করানো সম্ভব।' সুতরাং কাজ করতে কোথাও বেগ পেতে হয় না। বাস্তবে বিদেশির এই কথা শতভাগ সত্য। তা-ই নয় কি?
ঢাকা শহরে যে সুউচ্চ ভবন নির্মিত হচ্ছে, সেই ভবনের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ক্রেতা কারা? কোনো সংস্থা এর হিসাব নিয়ে কাজ করলে সঠিক চিত্র তুলে ধরা যায়। নতুন অ্যাপার্টমেন্টগুলোর বেশির ভাগের মালিক দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা, পাতিনেতা এবং কর্মী ও অসাধু ব্যবসায়ী- যাঁরা অসৎ ব্যবসার মাধ্যমে ফুলে-ফেঁপে কোটিপতি হয়েছেন তাঁরা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে পুলিশ, শুল্ক, আয়কর, জুডিশিয়াল এবং বন বিভাগের লোকই বেশি।
বিসিএস কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়। মৌখিক পরীক্ষায় এঙ্পার্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ করেছি, কোনো পরীক্ষার্থীকে তাঁর চয়েস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে কেউ কেউ পররাষ্ট্র এবং প্রশাসন ক্যাডারের কথা বলেন। তবে অধিকাংশ প্রার্থী তাঁদের প্রথম চয়েজ দিয়ে থাকেন পুলিশ অথবা কাস্টমস ক্যাডারের জন্য। এর কারণ জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে, তাঁরা সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে চান। পুলিশ বিভাগের সুনাম অর্জন এবং সেবামূলক কাজের জন্য তাঁরা নাকি আত্মনিয়োগ করবেন। উত্তর শুনে নিশ্চয়ই ভালো লাগে, তবে দেখ যায়, পুলিশের চাকরিতে নিয়োজিত হওয়ার পর সেসব কথা আর মনে থাকে না। নিজের আখের গোছানোর কাজে মাঠে নেমে পড়েন। এটাই হলো বর্তমান সমাজের চিত্র। এমনিভাবে সবচেয়ে ভালো ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য বুয়েটে ভর্তি হয়। বুয়েট থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর যখন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরিতে নিয়োজিত হয় এবং যখন দায়িত্ব পালন শুরু করে, তখন তার মূর্তি ভিন্নরূপ ধারণ করে। কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্মাণকাজের ব্যয় থেকে পার্সেন্টেজ আদায় করে থাকে। কন্ট্রাক্টর কাজের গুণগত মান বজায় না রেখে নিম্নমানের কাজ সম্পন্ন করে থাকে। এতে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কোনো অ্যাকশন বা ভ্রূক্ষেপ নেই। ভাবলে নিশ্চয়ই অবাক হতে হয়। লোভ-লালসা মানুষকে কত নিকৃষ্ট করে তুলতে পারে, এটা হলো তার দৃষ্টান্ত। নিম্নমানের কনস্ট্রাকশন, বিদ্যুৎ প্লান্ট বা অন্য কোনো স্থাপনা তৈরির কাজে দেশের যে ক্ষতি হলো, তা ভাবার কেউ থাকল না। দেশ রসাতলে যাক, তাতে কার কী। বিবেক-বিবেচনা অবৈধ অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে থাকে। কী ভয়াবহ চিত্র।
ড. সা'দত তাঁর লেখায় বলেন, 'সমাজ এবং সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, দেশের স্বার্থে সৎ কর্মকর্তা ও ব্যক্তিকে সহযোগিতা করা।' তিনি আরো বলেন, 'এর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সৎ লোকের পাশে দাঁড়ানো, দলবেঁধে পাশে দাঁড়ানো।' পরে তিনি সৎ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের সুরক্ষণের কথা বলেছেন। ড. সা'দতকে ধন্যবাদ তাঁর অকপট বক্তব্যের জন্য, তবে ড. সা'দতের মতো এত বড় একজন আমলা, সৎ কর্মকর্তা, বিবেকবান এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্যের পেছনে কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পাই না। তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দুর্নীতি কাছ থেকে দেখেছেন, কিন্তু কতটুকু প্রতিরোধ করতে পেরেছেন? দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন দলীয় মন্ত্রী, আমলা, তোষামোদকারী নেতাদের কতটুকু উপেক্ষা করতে পেরেছেন? নিশ্চয়ই পারেননি। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি থাকাকালীন তিনি তো সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কতজন কর্মকর্তাকে নিয়মনীতি মেনে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হয়েছে? উচ্চপর্যায় থেকে আসা তদবিরের কতগুলো এড়াতে পেরেছেন? এ ব্যাপারে তিনি নিজেকে জিজ্ঞেস করলেই এর উত্তর গেয়ে যাবেন। তিনি একজন নীতিবান, সৎ ও বলিষ্ঠ কর্মকর্তা- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দলীয় সরকারের নির্দেশনা ওভাররোল বা বাতিল করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই তাঁর ছিল না। অনেক সিদ্ধান্ত তাঁর মনঃপূত না হলেও তা মেনে নিতে তাঁকে বাধ্য থাকতে হতো। এটা কি সত্য নয়?
আমি সঠিক চিত্র শুধু তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। ড. সা'দত নিশ্চয়ই তা উপলব্ধি করবেন। সৎ কর্মকর্তা ও ব্যক্তিকে সুরক্ষণ করা উচিত- এর সঙ্গে আমি শতভাগ একমত। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, সৎ কর্মকর্তাকে সুরক্ষণ করবে কে? সুরক্ষণের প্রথম দায়িত্ব হলো সরকারের ওপর। সরকার কি তার দায়িত্ব পালনে আগ্রহী এবং নিষ্ঠাবান? সরকারের কি সত্যি সত্যি সদিচ্ছা আছে? সরকার যখন সৎ সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং স্বীকৃতি পাবে, তখনই কেবল সারা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এতদসঙ্গে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হবে, সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান হবেন, নিম্ন থেকে উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। সরকারের সব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বশীল, সৎ ও নিষ্ঠাবান হিসেবে তৈরি করা তখনই সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে। ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। আইনকানুন ও নিয়মনীতি মেনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিবেদিত হয়ে জাতীয় রাজস্ব আদায় করতে হবে, দেশ থেকে মুদ্রা পাচার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে এবং সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুন্দরভাবে জীবনযাপনের সব ব্যবস্থা গ্রহণসহ তাঁদের সুরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এমন ব্যবস্থা যখন দেশে কায়েম হবে, তখনই বোঝা যাবে দেশে সৎ সরকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
লেখক : সাবেক অতিরিক্ত সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়

No comments

Powered by Blogger.