জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত মানুষ বনাম কম খাওয়ার পরামর্শ by ডা. এম এ করীম
দুজন মন্ত্রীর উপদেশবাণীতে জনগণের শ্রদ্ধা ও আস্থা হারাতে বসেছে এ সরকার। জনগণ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ যখন জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত ও অসহায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যাদের নাভিশ্বাস, তখনই অর্থমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর উপহাসমূলক উপদেশে জনগণ ত্যক্ত-বিরক্ত। জীবন যেন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে তারা সব ইচ্ছা ও সামাজিক সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে মাত্র।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে তিন বেলা নয়, দুই বেলা খাবার জোগাড়, স্কুল ও কলেজের মানের তোয়াক্কা না করে ছেলেমেয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা করা আর মাথা গোঁজার মতো একটা ঘর ভাড়ার টাকা জোগাড় করতেই মাসের টাকা ফুরিয়ে যায় তাদের। তাদের চোখের সামনে সুন্দর কোনো স্বপ্নের হাতছানি নেই, নেই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আশা-জাগানিয়া উদ্যোগ। তাদের বেঁচে থাকাই যেন দিনগত পাপক্ষয়ের শামিল। ঠিক সেই সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর উপদেশ 'কম খাওয়ার'। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বাণিজ্যমন্ত্রী কম খেয়ে দীর্ঘদিন বাঁচার উপদেশ দিয়েছেন এ দেশের জনগণকে। তবে আমার মনে হয়, বাণিজ্যমন্ত্রী চিকিৎসক হলে হয়তো আরো বলতেন, কত ক্যালরি খেলে মানুষ ভালোভাবে বাঁচতে পারে। কিন্তু বিধি বাম! তিনি ক্যালরির হিসাবটা হয়তো জানেন না, তাই সেই উপহাসটুকু করতে পারেননি। সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু তাদের অভ্যাস বদলায় না। এর আগে নির্দলীয় সরকার (ফখরুদ্দীন) আলুর বিভিন্ন রকম খাদ্য খাওয়ার উপদেশ দিয়েছিল। সরকার ও সরকারি দলের কাছে যা রাজনীতি, আমাদের কাছে তা প্রহসন। আবার আমরা যা মনে করি রাজনীতি, রাজনীতিবিদরা মনে করেন তা ফালতু। এসব বিষয় নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা অতীতেও দেখেছি, ক্ষমতাসীনরা সাধারণ জনগণকে পরীক্ষাগারের গিনিপিগ ভাবেন। কিন্তু তাতে কী দেখা যাচ্ছে, মহাজোট ক্ষমতায় এসেছে দুই বছরেরও বেশি। এই আড়াই বছরে সরকারের অর্জন কম নয়। কিন্তু যেসব বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন, সেদিকে সরকারের নজর তেমন কোনো অর্থবহ নয়। সাধারণ মানুষ (আমরা যারা কিছু লেখালেখি করি) মনে করি, লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে থাক, চিনি উধাও হবে কেন? কাঁচামরিচের কেজি ৮০ টাকা কেন হবে? যানজট রাজধানীর এক সীমাহীন দুর্ভোগের নাম। দ্রব্যমূল্য অসহনীয় কেন? অপরাধ, নিষ্ঠুরতা ও দুর্ঘটনা এত বেশি বাড়ছে কেন? আইনশৃঙ্খলার এত অবনতি কেন? নিজ হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কেন? নারী নির্যাতনের অসংখ্য লজ্জাকর ঘটনা আমাদের ব্যথিত ও বিচলিত করে। প্রশ্ন জাগে, সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে? কোনো রাষ্ট্রের জন্যই এ অবস্থা মোটেই স্বস্তিকর নয়। এসব কেন হচ্ছে, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। সরকারকে এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তা না দিয়ে সরকার যদি মনে করে এসব ফালতু বিষয়, যদি মনে করে চিনি বেশি খেলে বহুমূত্র রোগ হবে, তাই চিনি খাওয়ার দরকার নেই, বিদ্যুৎ না থাকলে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। সরকারের মন্ত্রীদের কাছ থেকে পাচ্ছি অসংখ্য উপদেশ। অর্থমন্ত্রী বলছেন বাজারে যাওয়া কমিয়ে দিতে, অর্থাৎ সপ্তাহে এক দিন বাজারে যাবেন না (সিয়াম করবেন), আর বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন কম খেতে। এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর শুধু বলতে বাকি আছে মাথাব্যথার রোগীদের মাথা কেটে ফেলতে (বলা বাহুল্য, স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেহেতু পেশায় চিকিৎসক, সে কারণে এ উপদেশ দিতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করবেন)। আবার বস্ত্রমন্ত্রী হয়তো কবে কখন বলে বসবেন যে কাপড়ের দাম বেড়েছে, কাপড় কম পরেন_উলঙ্গ থাকেন! মানুষের মনে অসন্তোষ ও ক্ষোভ বাড়ছে। আমি আগেই বলেছি, এ সরকারের সাফল্য কম নেই। কিন্তু সেই ফিরিস্তির দিকে আমি যাচ্ছি না। হঠাৎ করে একের পর এক যে ভয়াবহ অপরাধমূলক ঘটনা, যেমন_পিটিয়ে মানুষ হত্যা, ডাকাত ঘোষণা দিয়ে একজন ছাত্রের ওপর অমানুষিক পুলিশি নির্যাতন, একের পর এক পৈশাচিক নারী নির্যাতন, রমজান মাস এলেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চিনি উধাও, হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও তা পালন না হওয়া_এসবের দিকে সরকারের কঠিন দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। তা না করে মন্ত্রীরা দায়িত্বজ্ঞানহীন উপদেশ বিলি করে চলছেন। চিনি উধাও হলো, ব্যবসায়ীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বসলেন। ব্যবসায়ীরা ওয়াদা দিলেন, ন্যায্যমূল্যে চিনি বিক্রি হবে। কিছুদিন মূল্য স্বাভাবিক থাকল। আবার বেড়ে গেছে। মনে রাখা প্রয়োজন, শুধু মুনাফার জন্য ব্যবসায়ীরা এ সংকট সৃষ্টি করেছেন_এটা মনে করা বালখিল্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ১৯৭৪ সালে হঠাৎ লবণ উধাও হয়েছিল। সে সময় ব্যবসায়ীদের সাহস জোগানো হয়েছিল অন্যখান থেকে। তাই এবারের এ সাহসের উৎস কোথায় তা গভীরভাবে সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। পৃথিবীর উন্নয়নশীল সব দেশেই কিন্তু এ ধরনের বাজার অস্থিতিশীলতার সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির যোগসাজশ থাকে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে এটা আরো বেশি থাকে। তাই সরকার যদি মনে করে, বাজারে যে পণ্যসংকট তৈরি করা হচ্ছে এটা কৃত্রিম, তাহলে সরকার গুরুতর ভুল করবে। অনেকে মনে করেন, বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। কারণ বেশির ভাগ পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সেটা ডলারের মূল্য বেড়েই যাক বা কমেই যাক, তাতে বাজারমূল্য স্থিতিশীল থাকার অবকাশ নেই। তাহলে এর প্রভাব কাটবে কিভাবে তাও সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। বিশ্বজুড়ে যখন ডলারের দাম কমছে, তখন বাংলাদেশে প্রতিদিন সেটা বাড়ছে। এটা কোন ধরনের 'অর্থবাজার নিয়ন্ত্রণ' আমার মাথায় আসে না। চিনি উধাও যেমন স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তেমনি ডলারের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিও স্বাভাবিক নয়। সরকারের মনে রাখা উচিত, পৌর নির্বাচনের সময়ই কিন্তু শেয়ারবাজারের ধস। ধসের কারণ এখনো অন্ধকারে। মনে রাখা প্রয়োজন, এ সরকার রাজনৈতিক সরকার। জনগণের কাছে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। সুতরাং চোখ-কান খোলা রাখা প্রয়োজন। সরকারের ওয়াদাগুলো যাতে সফল হতে না পারে, সে জন্য দলের বাহির ও ভিতর (উভয় দিক) থেকেই ষড়যন্ত্র চলছে। তবে সাধারণ মানুষ যারা এ সরকারের ভালো চায়, যারা চায় দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকুক, তারা দেখতে পাচ্ছে, তেমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যা সরকারের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। জনগণের ক্ষোভ দিন দিন বেড়েই চলছে এবং ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। মানুষের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, যে আবেগ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, তাদের মনে যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে, যে আস্থাবোধের অভাব ঘটেছে, যে অসহায়ত্ববোধের জন্ম হয়েছে মানুষের মনে, তা দূর করার জন্য এই মুহূর্তেই ত্বরিত ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে, সমুচিত বিচার ও কঠিন দণ্ড দিতে হবে। তাহলেই সাধারণ মানুষের মন থেকে দূর হবে এই অসন্তোষ, ক্ষোভ ও ক্ষত। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক জনগণের সরকারের দায়িত্ব ও পরম কর্তব্য হলো জনগণের পাশে দাঁড়ানো। সত্যদর্শীর ভাষায়, "অরাজকতা, নৈরাজ্য, অপরাধ_কোনো কিছুই আদর্শ রাষ্ট্রের কর্তব্যবোধের সুউচ্চ আদর্শের কাছে দাঁড়াতে পারবে না। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মানুষের যে কাম্য প্রত্যাশা_'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির' তাও নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত হবে।" যে কথা শুরু করেছিলাম আমি আবার সেদিকে পাঠকদের নিয়ে যেতে চাই। বাণিজ্যমন্ত্রীর বাণী জনগণের উদ্দেশে_'কম খান, লালসা কমান।' মন্ত্রী মহোদয়, লালসা কাদের থাকে? যাদের স্বাস্থ্যগত অনেক সমস্যা থাকে, তাদের লালসা থাকে। কোটিপতিদের স্বাস্থ্যগত অনেক সমস্যা থাকে, যার জন্য তাঁরা খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকেন, খেতে পারেন না। জনগণ কতটুকু ক্যালরিযুক্ত খাবার খাবে তা দেখার বিষয় পুষ্টিবিদদের, আপনার নয়। আপনার কাজ পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা। কারো স্বাস্থ্যগত কারণ থাকলে চিকিৎসকের উপদেশ নেবে, প্রয়োজন হলে উপোস থাকবে। আপনার এ উপহাসপূর্ণ উপদেশ শোনার জন্য শেখ হাসিনাকে জনগণ ভোট দেয়নি। মুনতাসীর মামুনের কথায়, 'প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় মন্ত্রীরা নিরাপত্তা ছাড়া ঢাকার রাস্তায় এখন হেঁটে যেতে পারবেন কি না সন্দেহ।' এসব উপদেশ মানুষকে এক ধরনের অপমান; এবং এ অধিকার মানুষ আওয়ামী লীগকে দেয়নি। আমি নৈরাশ্যবাদী নই, আমি আশাবাদী। দেশে অনেক সমস্যা আছে, সংকট আছে, তার সামাধানও কঠিন এবং দুরূহ হতে পারে; কিন্তু তা কখনোই অসম্ভব নয়। যোগ্য ব্যবস্থাপনার কাজই হলো সমস্যা দূর করা। যারা ব্যবস্থাপনায় অযোগ্য, তাদের বর্জন করা একান্ত অপরিহার্য। কোনো সমাজই স্থবির নয়, সমাজের নিজের মধ্যেও একটি গতিবেগ আছে। সমাজের সেই অন্তর্নিহিত শক্তি ও গতিবেগই তাকে এগিয়ে নেবে। এখনো গণতন্ত্রের শত্রুরা নানাভাবে সক্রিয়। তাদের লক্ষ্যই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের অর্জিত সাফল্য নস্যাৎ করা। এ জন্য তাদের অশুভ তৎপরতার শেষ নেই। তাই বলে আমরা ভয় করব না ভাই করব না। ভয় হতে অভয় পথেই আমাদের যাত্রা। আমি মনে করি, এসব বালখিল্য কথাবার্তা বন্ধ করে সমাজে বেড়ে ওঠা অন্যায়, অবিচার (নৈরাজ্যকর না হলেও) ও অপরাধগুলো দমনে সরকারকে আরো কঠোর ও সক্রিয় হতে হবে। মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণে সচেষ্ট হতে হবে এবং জনগণের মনে সৃষ্টি করতে হবে আস্থা ও আশা। পরিহাসের বদলে এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা। এই সব প্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা। সব অন্ধকার ভেদ করে নতুন সূর্যোদয়ে আলোকিত হোক আমাদের এ সমাজ_এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, পরমাণু চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও কলামিস্ট
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, পরমাণু চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও কলামিস্ট
No comments