চমন লাল-ভগত সিংয়ের জেলজীবন এবং বিচারের দুষ্প্রাপ্য দলিল
ভারতের বিচারব্যবস্থার বিশেষ বিশেষ ঘটনা প্রদর্শনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট অব ইন্ডিয়া যখন একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে, তখন সেখানে কিছু ঐতিহাসিক বিচারকাজের দলিল প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথম আয়োজন করা হয় ভগত সিংয়ের বিচারের দলিল প্রদর্শনের।
২০০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের অন্যতম বীর, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও শহীদ ভগত সিংয়ের জন্মশতবার্ষিকীতে এই প্রদর্শনীর উন্মোচন করা হয়। জাদুঘরের কিউরেটর নূরুল হুদা এবং ন্যাশনাল আর্কাইভের রাজমণি শ্রীবাস্তব সেই মূল্যবান দলিল, ছবি এবং প্রকাশনাগুলো সংগ্রহ করেন, যা ছিল বোমশেলের মতো। সংগৃহীত সব দলিল প্রদর্শন করা যায়নি। ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই প্রদর্শনীকে ডিজিটালাইজ করে। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ রাজগুরু এবং সুখদেবের সঙ্গে লাহোর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের পর এই প্রথম ভগত সিংয়ের কিছু লেখা জনসমক্ষে প্রকাশ পেল। কিভাবে তরুণ তিন দেশপ্রেমিকের বিচার বিভাগীয় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, তা প্রকাশ পেয়েছে বিখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ এ জি নুরানীর 'দ্য ট্রায়াল অব ভগত সিং' গ্রন্থে।
১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল গ্রেপ্তারের পর থেকে ভগত সিং জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় জেলখানায় অতিবাহিত করেন। তিনি এবং বি কে দত্ত অ্যাসেম্বলিতে বোমা ছোড়ার দায়ে গ্রেপ্তার হন। তাঁদের দুটি বিচারের সম্মুখীন করা হয়। প্রথম মামলাটি হলো দিলি্ল বোমা মামলা। এই মামলা শুরু হয় ১৯২৯ সালের ৭ মে, ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের সেকশন ৩০৭ ধারায়, সেশন জজ আদালতে। দ্বিতীয়টি হলো বিস্ফোরক আইনে। এই বিচারটি শুরু হয় ৬ জুন। ভগত সিং এবং বি কে দত্ত একটি ঐতিহাসিক বিবৃতি দেন। দত্তের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন জাতীয়তাবাদী কেঁৗসুলি আসাফ আলী। ভগত সিং নিজের মামলা নিজেই লড়েন একজন আইন পরামর্শকের সহায়তায়। ১২ জুন এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তাঁদের অভিযুক্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৬ জুনের বিবৃতি থেকে শুরু করে ১৯৩১ সালে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৩১ সালের ২২ মার্চ, কমরেডদের কাছে লেখা তাঁর শেষ চিঠি পর্যন্ত সময়টায় তিনি অনেক লিখেছিলেন। যে কেউ তাঁর সেই লেখা থেকে ২১ বছর পার করা মানুষটির মেধার পরিচয় পেতে পারে। এই সময়ে তিনি পরিবারের কাছে, কারাগার ও আদালতের কর্মকর্তাদের কাছে অসংখ্য চিঠি লিখেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল 'কেন আমি নাস্তিক', 'তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে চিঠি' (লেটার টু ইয়ং পলিটিক্যাল ওয়ার্কার্স) এবং জেল নোটবুকের মতো নিবন্ধ।
দোষী সাব্যস্ত করার পর ১৪ জুন ভগত সিংকে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়াঁওয়ালি কারাগারে এবং দত্তকে লাহোর কারাগারে। জেলখানার এই অধ্যায়ের পুরো সময় তাঁদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল। প্রথমে ১৫ জুন থেকে রাজবন্দির মর্যাদা প্রদানের জন্য অনশন সংগ্রাম শুরু করেন দুজনই। এর কিছুদিন পর ভগত সিংকেও লাহোর জেলে নিয়ে আসা হয়। তাঁকে এবং বি কে দত্তকে সুখদেবের মতো লাহোর ষড়যন্ত্রের অন্য অভিযুক্তদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখা হয়। ১৯২৯ সালের ১০ জুলাই সোন্ডার হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। ১৫ জুলাই থেকে ভগত সিং এবং দত্ত_দুজনই ছিলেন অনশন ধর্মঘটে। তাঁদের স্ট্রেচারে করে আদালতে আনা হয়। ওইদিন অন্য কারাবন্দিরা জানতে পারে, তাঁরা দুজনই অনশন ধর্মঘট করছেন। তখন প্রায় সবাই অনশন ধর্মঘটে যোগ দেয়। ভগত সিং এবং তাঁর সহযোগীদের এই অনশনের ফলে ১৯২৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জিতেন্দ্র দাস শহীদ হন। ২ সেপ্টেম্বর ভগত সিং এবং তাঁর সহযোগীরা অনশন ধর্মঘট ভঙ্গ করেন ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদলের দাবি পূরণের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু ব্রিটিশরা ওয়াদা ভঙ্গ করলে তাঁরা আবার ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অনশন শুরু করেন। অবশেষে রাজবন্দির মর্যাদা না দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা ১১২ দিন অনশন চালিয়ে ৪ অক্টোবর তা ভঙ্গ করেন। তাঁদের অন্য কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়।
১৯২৯ সালের ২১ অক্টোবর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির সময় স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট সাহিব পণ্ডিত কিষান চন্দের আদালতে একটি ঘটনা ঘটে। জয়গোপালের মদদে প্রেম দত্ত নামে সবচেয়ে তরুণ অভিযুক্ত তাঁকে স্যান্ডেল ছুড়ে মারেন। এ ঘটনার সঙ্গে অন্য কোনো অভিযুক্ত সম্পৃক্ত না থাকলেও ম্যাজিস্ট্রেট সবাইকে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দেন। হাতকড়া পরতে অস্বীকার করায় ভগত সিং, শিব ভার্মা, বি কে দত্ত, বিজয় কুমার সিনহা, অজয় ঘোষ, প্রেম দত্ত এবং অন্যদের প্রচণ্ড লাঠিপেটা করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এবং কারাগারে এনে তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে পেটানো হয়। পুলিশের নির্যাতনে অজয় ঘোষ এবং শিব ভার্মা অচেতন হয়ে পড়েন। ভগত সিংকে পেটান রবার্ট নামক এক ব্রিটিশ অফিসার।
এই নিষ্ঠুর ঘটনার বিস্তারিত রেকর্ড করেন বিজয় কুমার সিনহা। ব্রিটিশরা দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে ভগত সিং আবার ১৫ দিন অনশন ধর্মঘট করেন ১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
এদিকে, বিপ্লবীদের ধর্মঘটের কথা ও আদালতের বিবৃতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্রিটিশদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে থাকে। বিশ্বের নজর পড়ে এ ঘটনার দিকে।
লেখক : জওয়াহের লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ভগত সিংয়ের দলিলের সম্পাদক, বর্তমানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
'দ্য হিন্দু' পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের প্রথমাংশ ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল গ্রেপ্তারের পর থেকে ভগত সিং জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় জেলখানায় অতিবাহিত করেন। তিনি এবং বি কে দত্ত অ্যাসেম্বলিতে বোমা ছোড়ার দায়ে গ্রেপ্তার হন। তাঁদের দুটি বিচারের সম্মুখীন করা হয়। প্রথম মামলাটি হলো দিলি্ল বোমা মামলা। এই মামলা শুরু হয় ১৯২৯ সালের ৭ মে, ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের সেকশন ৩০৭ ধারায়, সেশন জজ আদালতে। দ্বিতীয়টি হলো বিস্ফোরক আইনে। এই বিচারটি শুরু হয় ৬ জুন। ভগত সিং এবং বি কে দত্ত একটি ঐতিহাসিক বিবৃতি দেন। দত্তের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন জাতীয়তাবাদী কেঁৗসুলি আসাফ আলী। ভগত সিং নিজের মামলা নিজেই লড়েন একজন আইন পরামর্শকের সহায়তায়। ১২ জুন এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তাঁদের অভিযুক্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৬ জুনের বিবৃতি থেকে শুরু করে ১৯৩১ সালে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আগের দিন, অর্থাৎ ১৯৩১ সালের ২২ মার্চ, কমরেডদের কাছে লেখা তাঁর শেষ চিঠি পর্যন্ত সময়টায় তিনি অনেক লিখেছিলেন। যে কেউ তাঁর সেই লেখা থেকে ২১ বছর পার করা মানুষটির মেধার পরিচয় পেতে পারে। এই সময়ে তিনি পরিবারের কাছে, কারাগার ও আদালতের কর্মকর্তাদের কাছে অসংখ্য চিঠি লিখেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল 'কেন আমি নাস্তিক', 'তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে চিঠি' (লেটার টু ইয়ং পলিটিক্যাল ওয়ার্কার্স) এবং জেল নোটবুকের মতো নিবন্ধ।
দোষী সাব্যস্ত করার পর ১৪ জুন ভগত সিংকে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়াঁওয়ালি কারাগারে এবং দত্তকে লাহোর কারাগারে। জেলখানার এই অধ্যায়ের পুরো সময় তাঁদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল। প্রথমে ১৫ জুন থেকে রাজবন্দির মর্যাদা প্রদানের জন্য অনশন সংগ্রাম শুরু করেন দুজনই। এর কিছুদিন পর ভগত সিংকেও লাহোর জেলে নিয়ে আসা হয়। তাঁকে এবং বি কে দত্তকে সুখদেবের মতো লাহোর ষড়যন্ত্রের অন্য অভিযুক্তদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখা হয়। ১৯২৯ সালের ১০ জুলাই সোন্ডার হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। ১৫ জুলাই থেকে ভগত সিং এবং দত্ত_দুজনই ছিলেন অনশন ধর্মঘটে। তাঁদের স্ট্রেচারে করে আদালতে আনা হয়। ওইদিন অন্য কারাবন্দিরা জানতে পারে, তাঁরা দুজনই অনশন ধর্মঘট করছেন। তখন প্রায় সবাই অনশন ধর্মঘটে যোগ দেয়। ভগত সিং এবং তাঁর সহযোগীদের এই অনশনের ফলে ১৯২৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জিতেন্দ্র দাস শহীদ হন। ২ সেপ্টেম্বর ভগত সিং এবং তাঁর সহযোগীরা অনশন ধর্মঘট ভঙ্গ করেন ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদলের দাবি পূরণের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু ব্রিটিশরা ওয়াদা ভঙ্গ করলে তাঁরা আবার ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অনশন শুরু করেন। অবশেষে রাজবন্দির মর্যাদা না দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা ১১২ দিন অনশন চালিয়ে ৪ অক্টোবর তা ভঙ্গ করেন। তাঁদের অন্য কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়।
১৯২৯ সালের ২১ অক্টোবর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির সময় স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট সাহিব পণ্ডিত কিষান চন্দের আদালতে একটি ঘটনা ঘটে। জয়গোপালের মদদে প্রেম দত্ত নামে সবচেয়ে তরুণ অভিযুক্ত তাঁকে স্যান্ডেল ছুড়ে মারেন। এ ঘটনার সঙ্গে অন্য কোনো অভিযুক্ত সম্পৃক্ত না থাকলেও ম্যাজিস্ট্রেট সবাইকে হাতকড়া পরানোর নির্দেশ দেন। হাতকড়া পরতে অস্বীকার করায় ভগত সিং, শিব ভার্মা, বি কে দত্ত, বিজয় কুমার সিনহা, অজয় ঘোষ, প্রেম দত্ত এবং অন্যদের প্রচণ্ড লাঠিপেটা করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এবং কারাগারে এনে তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে পেটানো হয়। পুলিশের নির্যাতনে অজয় ঘোষ এবং শিব ভার্মা অচেতন হয়ে পড়েন। ভগত সিংকে পেটান রবার্ট নামক এক ব্রিটিশ অফিসার।
এই নিষ্ঠুর ঘটনার বিস্তারিত রেকর্ড করেন বিজয় কুমার সিনহা। ব্রিটিশরা দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে ভগত সিং আবার ১৫ দিন অনশন ধর্মঘট করেন ১৯৩০ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
এদিকে, বিপ্লবীদের ধর্মঘটের কথা ও আদালতের বিবৃতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্রিটিশদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে থাকে। বিশ্বের নজর পড়ে এ ঘটনার দিকে।
লেখক : জওয়াহের লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ভগত সিংয়ের দলিলের সম্পাদক, বর্তমানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
'দ্য হিন্দু' পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের প্রথমাংশ ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
No comments