বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনচিত্র by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুর্দশা অন্তহীন। এই পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্ট নয়। বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোতে কর্মরত দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ নিয়ে জিইয়ে থাকা নানা রকম প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। সরকারের তরফে যথাযথ প্রতিকারের চিত্র নিকট-অতীত পর্যন্ত তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে, তা বলার অবকাশও খুব কম। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে এ ক্ষেত্রে।
বর্তমান মহাজোট সরকার ইতিমধ্যে তাদের শাসনকালের প্রায় অর্ধেক সময় অতিক্রম করেছে। এ সরকার এ ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বটে; কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। প্রবাসে কর্মরত এ দেশের শ্রমিকদের হাড়ভাঙা শ্রমে অর্জিত অর্থে গতিশীল প্রবাহের ওপর আমাদের অর্থনীতির হৃষ্টপুষ্টতা নির্ভর করে_এমন কথা সরকারসহ প্রায় সব মহলের তরফেই অহরহ উচ্চারিত হয় বটে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে আন্তরিকতা কতটা রয়েছে কিংবা এ পথটা মসৃণ করতে যতটা যা করা দরকার তা হচ্ছে কি না_এমন প্রশ্নও বিদ্যমান প্রেক্ষাপটের কারণে দাঁড়ায়। যাঁরা বিদেশে শ্রমিক পরিচয়ে যান তাঁদের কতটা কাঠখড় পুড়িয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে হয় অবর্ণনীয় পরিস্থিতিতে নিজেদের সঁপে দিয়ে, তা কম-বেশি সচেতন মহল মাত্রেরই জানা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁদের বঞ্চনা যেন ঘুচতে চায় না। তাঁদের বান্ধব হিসেবে যাঁদের দাঁড়ানোর কথা তাঁদেরও তাঁরা পাশে পান না। এমন তথ্যও অসত্য নয়, বিদেশে অবস্থিত একেকটি দেশে আমাদের অনেক দূতাবাসের কর্তাও জানেন না প্রকৃতপক্ষে নিজ দেশের কত শ্রমিক সেখানে আছেন। পাশাপাশি এসব সাধারণ মানুষের জন্য যাঁদের দরজা থাকে কণ্টকাকীর্ণ এবং তাঁরা বরাবরই নাক উঁচু ভাব নিয়ে চলেন_এমন অভিযোগও বিস্তর এবং পুরনো।
নিকট একটি জাতীয় দৈনিকে উদ্বেগজনক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক মাসে বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে ৬৩৫ জন বাংলাদেশি লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন। এর আগে প্রায় এক বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে এভাবে লাশ হয়ে ফিরেছেন দুই হাজার ২৩৭ শ্রমিক। দেখা যাচ্ছে, গড়ে প্রতিদিন ছয়জনের বেশি মৃত্যুবরণ করেছেন, যে মৃত্যু অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবোধক। লাশ হয়ে দেশে আসাদের সিংহভাগের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ১৭ এপ্রিল এসেছে আরো ৪১ প্রবাসী শ্রমিকের লাশ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ব্যাখ্যা, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগ ও নানা রকম দুর্ঘটনায়। কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটতেই পারে; কিন্তু এ রকম তরুণ বয়স্করা, যাঁরা যথেষ্ট কর্মক্ষম তাঁদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি কি প্রশ্নবোধক ঠেকে না? প্রশ্ন হচ্ছে, দায়িত্বশীল মহলের তরফে এই প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে সোজাসাপ্টা যে মন্তব্য করা হলো কিংবা বক্তব্য দেওয়া হলো তা কি যথেষ্ট অনুসন্ধানক্রমে? যেখানে অনেক দূতাবাসের কর্তারা এসব মানুষের খবরই রাখেন না, তাঁরা এ সম্পর্কে কতটা সঠিক তথ্যচিত্র দিতে পারেন? যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে তা তো নিশ্চয়ই তাঁদের অর্থাৎ দূতাবাসে কর্মরতদের তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই। কাজেই এমন বক্তব্য নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
আমাদের দেশের সিংহভাগ রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মকাণ্ডও সচেতন মহলের অজানা নয়। মিডিয়ায় প্রায়ই এ সম্পর্কিত উদ্বেগজনক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাবলির সমাধান করা যায়নি। অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি এখনো তুঘলকি কাণ্ড দাপটের সঙ্গেই অব্যাহত রেখেছে। বিদেশগামীদের এখনো নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। এ ক্ষেত্রে যে ব্যতিক্রম নেই কিংবা সৎ জনশক্তি রপ্তানিকারক নেই তা নয়। কিন্তু এ প্রশ্নও দাঁড়ায়, সে সংখ্যা কত? প্রশ্নটির জবাব সুখকর নয়। এমন প্রেক্ষাপট যেখানে বিদ্যমান সেখানে এসব রিক্রুটিং এজেন্সি হতভাগ্যদের খোঁজখবর রাখবে, তাঁদের প্রতি দায়িত্ব পালন করবে সে প্রত্যাশা অমূলক। জীবনের সমৃদ্ধির জন্য এই যুদ্ধরতরা মরল কি বাঁচল তাতে তাদের কী আসে-যায়। তারা নিজেদের পকেট স্ফীত করতেই মরিয়া। অবস্থা যেন সেই ঠাট্টার মতো 'মুর্দা বেহেশতে কিংবা দোজখে যাক তাতে আমার কী, আমি গোশ-রুটি চাই।' বেশকিছু দূতাবাসে কর্মরত দূতাবাস কর্মকর্তাসহ অন্যদের দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ নিয়ে নতুন করে আর প্রশ্ন না-ইবা তুললাম। এই হতভাগ্যরা অর্থাৎ প্রবাসী শ্রমিকরা শর্ত মোতাবেক বেতন-ভাতা পান কি না, জীবনযাপন নির্বিঘ্নে করতে পারছেন কি না, তাঁদের কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হচ্ছে কি না এসব দেখভাল করা তাঁদের দায়-দায়িত্ব হলেও তাঁরা আছেন সাক্ষীগোপাল হয়ে। একেকটি দেশের দূতাবাসে কর্মরতরা নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ক্ষেত্রেও কত রকম ব্যর্থতা-উদাসীনতা-স্বেচ্ছাচারিতার নজির রয়েছে তাও মিডিয়ার কল্যাণে সচেতন মহলের অজানা নয়। নিশ্চয়ই অভিযোগ ঢালাও নয়, ব্যতিক্রমও আছে; কিন্তু সে সংখ্যাও যে নগণ্য তাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রায় নিত্য বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের যে হারে মৃত্যুর মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটছে তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া কঠিন। এসব মৃত্যুর পেছনে কোনো না কোনো 'কিন্তু' আছে, এই সন্দেহ দূর করার অবকাশও ক্ষীণ। যদি সঠিকভাবে এসব মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের অনুসন্ধান চালানো হয়, তবে এই 'কিন্তু' বেরিয়ে আসবে বলেই ধারণা। প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুসম্পর্কিত যেসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সরকারি তরফে শোনা গেল তাও এক ধরনের পরিহাস বললে অত্যুক্তি হয় না। একই সঙ্গে এ কথাও বলা প্রাসঙ্গিক, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের লাশের মিছিল যেভাবে দীর্ঘ হচ্ছে এর পরও সংশ্লিষ্ট মহলের নীরবতা বা তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেন অনাকাঙ্ক্ষিত লাশের তালিকা ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে, তা অবশ্যই তলিয়ে দেখতে হবে এবং যত দ্রুত তা সম্ভব ততই মঙ্গল।
যারা সর্বস্বান্ত হয়ে কায়িক পরিশ্রম করে উপার্জনের আশায় নানা রকম স্বপ্ন লালন করে প্রবাসে যান তাঁদের ব্যাপারে দায়বদ্ধহীনতার এমন চিত্র বিস্ময়কর, যুগপৎ জিজ্ঞাসাসূচক। মনে রাখা উচিত, তাঁরা শুধু নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতেই যান না, অমানুষিক পরিশ্রম ও নানা রকম প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে দেশের অর্থনীতিতেও রক্ত সঞ্চার করেন। অথচ তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে অকালে মৃত্যুবরণ-পূর্বক লাশ হয়ে নিজ নিজ পরিবারে ফিরে এসেছেন। তাঁদের একেকজনের জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই পরিবারগুলোও চরম বিপন্ন হয়ে পড়ছে। তাদেরও বাঁচা-মরা সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পরও এ ব্যাপারে সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে না, তা তো কোনোভাবেই হতে পারে না।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দূতাবাস, রিক্রুটিং এজেন্সি সর্বোপরি সরকার কেউ-ই এ ব্যাপারে তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারে না। যেখানে আমরা প্রায় নিত্য এ ক্ষেত্রে প্রতারণার অভিযোগ শুনি, মর্মন্তুদ ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট জানি তখন তো বিষয়টিকে আরো গুরুত্ব সহকারেই আমলে নেওয়া উচিত। ইতিমধ্যে স্বজন হারানো অনেক পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ শোনা গেছে, এসব মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এরপর তো অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের নড়েচড়ে বসা উচিত ছিল। মানুষের জীবন নিয়ে এমন ঔদাসীন্য, নির্মমতা নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত নয়। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিপতিত হয়ে ক্রমেই কেন মৃত্যুহার বাড়ছে এই তথ্য উন্মোচন করা সম্ভব হবে না_তা কেন মেনে নিতে হবে?
কিছুদিন আগে জানা গিয়েছিল, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের নাজাফ কারাগারে প্রায় ২০০ বাংলাদেশি বন্দি হয়ে আছেন। তাঁদের দুবাইয়ে চাকরির কথা বলে পাঠানো হয়েছিল। পরে দুবাই থেকে কুয়েত হয়ে ইরাকের নাজাফে পাঠানো হয়। শেষে মার্কিন সেনারা ইরাকি পুলিশের মাধ্যমে তাঁদের কারাগারে পাঠায়। শেষ পর্যন্ত তাঁদের কপালে কী ঘটেছে তা আর জানি না।
দেশের বিদ্যমান বাস্তবতার কারণে প্রতিনিয়তই মানুষ প্রবাসে কর্মসংস্থানের জন্য ছুটছে। এ চিত্র নতুন কিছু নয়। দেশে যত মানুষ বাড়ছে কর্মসংস্থানের অভাব তত প্রকট হচ্ছে। এত বেশি মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থানে বিদেশ যাওয়ার তাগিদ তীব্র হচ্ছে। কর্মসংস্থানের আশায় ভিটেমাটি বিক্রি করে সব কিছু পেছনে ফেলে মানুষ ছুটছে বিদেশবিভুঁইয়ে কাজের সন্ধানে। আর এই বিদেশ গমনেচ্ছু সহজসরল মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিনিয়ত হচ্ছে প্রতারণার শিকার। অভিনব সব প্রতারণার খবর প্রকাশ পাচ্ছে পত্রপত্রিকায়। সম্প্রতি এমনই একটি সংবাদ পুনর্বার বিস্ময় জাগিয়েছে। খবরে প্রকাশ, ইউরোপ বা অন্যত্র চাকরির প্রলোভন দিয়ে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিদেশ গমনেচ্ছুদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে নেপাল ও ভুটানে! কয়েক দিন আগে জাপান বাংলাদেশ থেকে সরকারি বেসরকারি লোক নিয়ে সেখানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজে লাগানোর কথা ভাবছে এমন সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতারকরা প্রতারণার ফাঁদ পাততে শুরু করে দিয়েছে! এ প্রক্রিয়া চলছেই।
ভাগ্যহতরা জীবনের চাকা সচল করতে গিয়ে যাঁদের কারণে তাঁরা জীবন হারাচ্ছেন, দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন কিংবা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন_সে মহলটি কিন্তু অচিহ্নিত নয়। জীবন নিয়ে জুয়া খেলে তাঁরা নিজেদের উদর ভরছেন অথচ বিস্ময়কর, তাদের কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারছে না প্রশাসন। কী বিস্ময়কর কাণ্ড! এই নৈরাজ্যের শেষ কোথায়_এ প্রশ্নটি ইতিমধ্যে বহুবার উত্থাপিত হলেও এর কোনো সদুত্তর মিলছে না। রিক্রুটিং এজেন্সির অসাধুদের হাত কি এতই লম্বা যে আইনের হাতও তাদের স্পর্শ করতে পারে না? সৎ ও দায়িত্বশীল জনশক্তি রপ্তানিকারকদের উচিত এই অশুভ শক্তিকে রুখে দিতে সম্মিলিতভাবে দাঁড়ানো। সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বিদ্যমান নেতিবাচক চিত্রের অবসানকল্পের পাশাপাশি প্রবাসী শ্রমিকদের পাশে অবিলম্বে দাঁড়ানো। সব কিছু খতিয়ে দেখে সরকারের করণীয়গুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলেই মঙ্গল। দেশের অভ্যন্তরেও কর্মসংস্থানের বাজার সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে কালক্ষেপণ না করে। পথ আছে অনেক, চাই শুধু দূরদর্শী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সদিচ্ছা। ক্ষুধার পেট তো বচনে ভরবে না। জীবন পণ্য নয়, অমূল্য সম্পদ_নিশ্চয়ই এই বাণী দায়িত্বশীলদের অজ্ঞাত নয়।
লেখক : সাংবাদিক, deba_bishnu@yahoo.com
নিকট একটি জাতীয় দৈনিকে উদ্বেগজনক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক মাসে বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে ৬৩৫ জন বাংলাদেশি লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন। এর আগে প্রায় এক বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে এভাবে লাশ হয়ে ফিরেছেন দুই হাজার ২৩৭ শ্রমিক। দেখা যাচ্ছে, গড়ে প্রতিদিন ছয়জনের বেশি মৃত্যুবরণ করেছেন, যে মৃত্যু অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবোধক। লাশ হয়ে দেশে আসাদের সিংহভাগের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ১৭ এপ্রিল এসেছে আরো ৪১ প্রবাসী শ্রমিকের লাশ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ব্যাখ্যা, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগ ও নানা রকম দুর্ঘটনায়। কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটতেই পারে; কিন্তু এ রকম তরুণ বয়স্করা, যাঁরা যথেষ্ট কর্মক্ষম তাঁদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি কি প্রশ্নবোধক ঠেকে না? প্রশ্ন হচ্ছে, দায়িত্বশীল মহলের তরফে এই প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে সোজাসাপ্টা যে মন্তব্য করা হলো কিংবা বক্তব্য দেওয়া হলো তা কি যথেষ্ট অনুসন্ধানক্রমে? যেখানে অনেক দূতাবাসের কর্তারা এসব মানুষের খবরই রাখেন না, তাঁরা এ সম্পর্কে কতটা সঠিক তথ্যচিত্র দিতে পারেন? যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে তা তো নিশ্চয়ই তাঁদের অর্থাৎ দূতাবাসে কর্মরতদের তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই। কাজেই এমন বক্তব্য নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
আমাদের দেশের সিংহভাগ রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মকাণ্ডও সচেতন মহলের অজানা নয়। মিডিয়ায় প্রায়ই এ সম্পর্কিত উদ্বেগজনক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাবলির সমাধান করা যায়নি। অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি এখনো তুঘলকি কাণ্ড দাপটের সঙ্গেই অব্যাহত রেখেছে। বিদেশগামীদের এখনো নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। এ ক্ষেত্রে যে ব্যতিক্রম নেই কিংবা সৎ জনশক্তি রপ্তানিকারক নেই তা নয়। কিন্তু এ প্রশ্নও দাঁড়ায়, সে সংখ্যা কত? প্রশ্নটির জবাব সুখকর নয়। এমন প্রেক্ষাপট যেখানে বিদ্যমান সেখানে এসব রিক্রুটিং এজেন্সি হতভাগ্যদের খোঁজখবর রাখবে, তাঁদের প্রতি দায়িত্ব পালন করবে সে প্রত্যাশা অমূলক। জীবনের সমৃদ্ধির জন্য এই যুদ্ধরতরা মরল কি বাঁচল তাতে তাদের কী আসে-যায়। তারা নিজেদের পকেট স্ফীত করতেই মরিয়া। অবস্থা যেন সেই ঠাট্টার মতো 'মুর্দা বেহেশতে কিংবা দোজখে যাক তাতে আমার কী, আমি গোশ-রুটি চাই।' বেশকিছু দূতাবাসে কর্মরত দূতাবাস কর্মকর্তাসহ অন্যদের দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ নিয়ে নতুন করে আর প্রশ্ন না-ইবা তুললাম। এই হতভাগ্যরা অর্থাৎ প্রবাসী শ্রমিকরা শর্ত মোতাবেক বেতন-ভাতা পান কি না, জীবনযাপন নির্বিঘ্নে করতে পারছেন কি না, তাঁদের কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হচ্ছে কি না এসব দেখভাল করা তাঁদের দায়-দায়িত্ব হলেও তাঁরা আছেন সাক্ষীগোপাল হয়ে। একেকটি দেশের দূতাবাসে কর্মরতরা নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ক্ষেত্রেও কত রকম ব্যর্থতা-উদাসীনতা-স্বেচ্ছাচারিতার নজির রয়েছে তাও মিডিয়ার কল্যাণে সচেতন মহলের অজানা নয়। নিশ্চয়ই অভিযোগ ঢালাও নয়, ব্যতিক্রমও আছে; কিন্তু সে সংখ্যাও যে নগণ্য তাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রায় নিত্য বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের যে হারে মৃত্যুর মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটছে তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া কঠিন। এসব মৃত্যুর পেছনে কোনো না কোনো 'কিন্তু' আছে, এই সন্দেহ দূর করার অবকাশও ক্ষীণ। যদি সঠিকভাবে এসব মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের অনুসন্ধান চালানো হয়, তবে এই 'কিন্তু' বেরিয়ে আসবে বলেই ধারণা। প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুসম্পর্কিত যেসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সরকারি তরফে শোনা গেল তাও এক ধরনের পরিহাস বললে অত্যুক্তি হয় না। একই সঙ্গে এ কথাও বলা প্রাসঙ্গিক, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের লাশের মিছিল যেভাবে দীর্ঘ হচ্ছে এর পরও সংশ্লিষ্ট মহলের নীরবতা বা তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেন অনাকাঙ্ক্ষিত লাশের তালিকা ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে, তা অবশ্যই তলিয়ে দেখতে হবে এবং যত দ্রুত তা সম্ভব ততই মঙ্গল।
যারা সর্বস্বান্ত হয়ে কায়িক পরিশ্রম করে উপার্জনের আশায় নানা রকম স্বপ্ন লালন করে প্রবাসে যান তাঁদের ব্যাপারে দায়বদ্ধহীনতার এমন চিত্র বিস্ময়কর, যুগপৎ জিজ্ঞাসাসূচক। মনে রাখা উচিত, তাঁরা শুধু নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতেই যান না, অমানুষিক পরিশ্রম ও নানা রকম প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে দেশের অর্থনীতিতেও রক্ত সঞ্চার করেন। অথচ তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে অকালে মৃত্যুবরণ-পূর্বক লাশ হয়ে নিজ নিজ পরিবারে ফিরে এসেছেন। তাঁদের একেকজনের জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই পরিবারগুলোও চরম বিপন্ন হয়ে পড়ছে। তাদেরও বাঁচা-মরা সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পরও এ ব্যাপারে সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে না, তা তো কোনোভাবেই হতে পারে না।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দূতাবাস, রিক্রুটিং এজেন্সি সর্বোপরি সরকার কেউ-ই এ ব্যাপারে তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারে না। যেখানে আমরা প্রায় নিত্য এ ক্ষেত্রে প্রতারণার অভিযোগ শুনি, মর্মন্তুদ ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট জানি তখন তো বিষয়টিকে আরো গুরুত্ব সহকারেই আমলে নেওয়া উচিত। ইতিমধ্যে স্বজন হারানো অনেক পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ শোনা গেছে, এসব মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এরপর তো অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের নড়েচড়ে বসা উচিত ছিল। মানুষের জীবন নিয়ে এমন ঔদাসীন্য, নির্মমতা নিশ্চয়ই প্রত্যাশিত নয়। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিপতিত হয়ে ক্রমেই কেন মৃত্যুহার বাড়ছে এই তথ্য উন্মোচন করা সম্ভব হবে না_তা কেন মেনে নিতে হবে?
কিছুদিন আগে জানা গিয়েছিল, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের নাজাফ কারাগারে প্রায় ২০০ বাংলাদেশি বন্দি হয়ে আছেন। তাঁদের দুবাইয়ে চাকরির কথা বলে পাঠানো হয়েছিল। পরে দুবাই থেকে কুয়েত হয়ে ইরাকের নাজাফে পাঠানো হয়। শেষে মার্কিন সেনারা ইরাকি পুলিশের মাধ্যমে তাঁদের কারাগারে পাঠায়। শেষ পর্যন্ত তাঁদের কপালে কী ঘটেছে তা আর জানি না।
দেশের বিদ্যমান বাস্তবতার কারণে প্রতিনিয়তই মানুষ প্রবাসে কর্মসংস্থানের জন্য ছুটছে। এ চিত্র নতুন কিছু নয়। দেশে যত মানুষ বাড়ছে কর্মসংস্থানের অভাব তত প্রকট হচ্ছে। এত বেশি মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থানে বিদেশ যাওয়ার তাগিদ তীব্র হচ্ছে। কর্মসংস্থানের আশায় ভিটেমাটি বিক্রি করে সব কিছু পেছনে ফেলে মানুষ ছুটছে বিদেশবিভুঁইয়ে কাজের সন্ধানে। আর এই বিদেশ গমনেচ্ছু সহজসরল মানুষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিনিয়ত হচ্ছে প্রতারণার শিকার। অভিনব সব প্রতারণার খবর প্রকাশ পাচ্ছে পত্রপত্রিকায়। সম্প্রতি এমনই একটি সংবাদ পুনর্বার বিস্ময় জাগিয়েছে। খবরে প্রকাশ, ইউরোপ বা অন্যত্র চাকরির প্রলোভন দিয়ে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিদেশ গমনেচ্ছুদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে নেপাল ও ভুটানে! কয়েক দিন আগে জাপান বাংলাদেশ থেকে সরকারি বেসরকারি লোক নিয়ে সেখানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজে লাগানোর কথা ভাবছে এমন সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতারকরা প্রতারণার ফাঁদ পাততে শুরু করে দিয়েছে! এ প্রক্রিয়া চলছেই।
ভাগ্যহতরা জীবনের চাকা সচল করতে গিয়ে যাঁদের কারণে তাঁরা জীবন হারাচ্ছেন, দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন কিংবা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন_সে মহলটি কিন্তু অচিহ্নিত নয়। জীবন নিয়ে জুয়া খেলে তাঁরা নিজেদের উদর ভরছেন অথচ বিস্ময়কর, তাদের কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারছে না প্রশাসন। কী বিস্ময়কর কাণ্ড! এই নৈরাজ্যের শেষ কোথায়_এ প্রশ্নটি ইতিমধ্যে বহুবার উত্থাপিত হলেও এর কোনো সদুত্তর মিলছে না। রিক্রুটিং এজেন্সির অসাধুদের হাত কি এতই লম্বা যে আইনের হাতও তাদের স্পর্শ করতে পারে না? সৎ ও দায়িত্বশীল জনশক্তি রপ্তানিকারকদের উচিত এই অশুভ শক্তিকে রুখে দিতে সম্মিলিতভাবে দাঁড়ানো। সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বিদ্যমান নেতিবাচক চিত্রের অবসানকল্পের পাশাপাশি প্রবাসী শ্রমিকদের পাশে অবিলম্বে দাঁড়ানো। সব কিছু খতিয়ে দেখে সরকারের করণীয়গুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলেই মঙ্গল। দেশের অভ্যন্তরেও কর্মসংস্থানের বাজার সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে কালক্ষেপণ না করে। পথ আছে অনেক, চাই শুধু দূরদর্শী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সদিচ্ছা। ক্ষুধার পেট তো বচনে ভরবে না। জীবন পণ্য নয়, অমূল্য সম্পদ_নিশ্চয়ই এই বাণী দায়িত্বশীলদের অজ্ঞাত নয়।
লেখক : সাংবাদিক, deba_bishnu@yahoo.com
No comments