সহজ-সরল-ঈদে জামা চাই না by কনকচাঁপা
'এবার আর ঈদের জামা চাই না' অতীত সর্বদাই মধুর স্মৃতিসম্পন্ন হয়ে থাকে। স্কুলের পড়া পড়তে পড়তে হঠাৎ শিক্ষক বললেন ছুটি কি? না_এক মাসের ছুটি, রোজা ও ঈদের ছুটি। আহ্, এর চেয়ে পরম শান্তির কী হতে পারে। আবার এক মাস সহপাঠীদের দেখব না অথবা মোটামুটি অনেকখানি হোমওয়ার্ক_এগুলো একটু অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াত।
বড়দের সঙ্গে আমিও রোজা থাকব। বাড়ির অন্য সবাই আপত্তি করলেও মা আপত্তি করতেন না। ভোররাতে গরম ভাত রেঁধে গরম গরম সেহরি। আর সারা দিন হোমওয়ার্ক করি না, করি ইফতারির জন্য অতি আবশ্যক অপেক্ষা। সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গেই শান্তি। ঈদে বাড়তি পাওনা ছিল বাবার হাতে সেলাই করা জামা। ডিজাইনও তাঁর করা। তাঁর মেশিন, তাঁর স্কেল-ইস্ত্রি, চক, সঙ্গে টেবিলল্যাম্প_মনে হতো একটা নিঝুম স্টেশনের প্লাটফর্ম। জামা সেলাই হচ্ছে তো ট্রেন কাছে আসছে_আসছে তো আসছে_থামছে না। ও আব্বা তাড়াতাড়ি করেন_প্লিজ। না, ট্রেন আর চলবে না_কেন? তেল চাই। রং চা। কমলা সোনালি চা যেন তরল সোনা। তার বিনিময়ে আব্বা আবার চলেন। জামার হাত জুড়তে থাকা_সূক্ষ্ম চাঁদের রূপালী জালে হেম-রান। এই তো_বোতামটাও জুড়ে গেল। শুধু গায়ে গলিয়ে দিলেই আমাকে_আমার আর দুই বোনকে পায় কে? আমাদেরই তো ঈদ। জামার বাড়তি কাপড়ের টুকরোগুলো ভীষণ সাবধানে লুকিয়ে রাখাটাও বাড়তি আনন্দ। আমার জামা ও আমি একসঙ্গে উদ্ভাসিত হব_রেডি ওয়ান-টু-থ্রি। আহা_সেখানেই যদি থেমে যেতাম! থামা যায় না। জীবন চলতেই থাকে। জীবন যে সিন্দাবাদের বুড়োর মতো গলায় ক্রস এঁটে ঘাড়ে বসে, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জো-ই নেই, যদি কোনো দুর্ঘটনায় না পড়া যায়। যাক্। রোজ বছর রোজা আসে। ঈদ হয়। বড় হই। একটু একটু বুঝতে পারি। মধ্যবিত্ত সংসারের সৎ সরকারি কর্মকর্তার কন্যাকে অল্প বয়সেই অনেক কিছু বুঝতে হয়। আব্বা বলেন মাগো ঈদ তো আমার জন্য অভিশাপ। থমকে যাই। এত বড় রহমতের মাস_পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েমরত বাবা আমার এত বড় বেরহমতের কথা বললেন! কিন্তু সমাজ ও ধর্ম যে মেলানো যায় না। এখানে সারা মাস বাড়তি ইফতারি, সেহরি ও বাড়তি ঈদ একই খরচে চালাতে হয়। যা বোনাস হয় তা পিঁপড়ায় খায়। বিষপিঁপড়া। আড়তদার ব্যবসায়ী। তাঁরা রোজা বুঝে দাম বাড়ান_সেই আশিকালের বাসি আমল থেকেই। তাতেই আমার ধর্মপ্রাণ মা-বাবা তাঁদের ওপর নাখোশ হয়েই এমন উক্তি করেন। আব্বা-আম্মাকে বলি_থাক ঈদের জামা লাগবে না। এবার না হয় শুধু ছোট ভাইটাকেই দেন। মা-বাবার কি তাতে মন মানে! সংগতি রেখে কমদামি কাপড় কেনা হয়। পাশের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে মেজ বোনের ক্রন্দন_কি? ও বাড়ির বালিশের ওয়ারের কাপড় আর আমাদের ঈদের জামার কাপড় এক। হায় দুঃখ। এই রকম দুঃখ-আনন্দ মেলাতে মেলাতেই জীবনের ৮২টা ঈদ পার করে দিলাম। এখন আর আব্বার সেই জামা নেই_আব্বা সব কিছুর ঊধর্ে্ব। ওপারে তো সমাজ দুর্নীতি-মূল্যবৃদ্ধি এসব নেই। কিন্তু আমি পড়ে আছি এই পূতিগন্ধময় একটা প্লাটফর্মে। যেখানে জীবন নামের ট্রেন পরীর পাখাওয়ালা লাল-নীল-বেগুনি ঈদের জামা নিয়ে এসে আমার স্টেশনে থামে না। আবার চলে যাওয়ার জন্য তরল সোনালি জ্বালানি চেয়ে নেয় না। বাবা তো স্বার্থপরের মতো তাঁর মাটির বিছানাতে বা কোথায় কোন বালাখানায় ঘুমাচ্ছেন। আর আমরা_১৪ কোটি মানুষ এই রহমতের মাসে বিষময় দিন যাপন করছি। এ ঈদে আমার জামা নেই_রতনাপার জামা নেই_পারুলাপার জামা নেই_আমার মায়ের শাড়ি নেই_হেনার ইজ্জত নেই_ইয়াসমিনের প্রাণ নেই_রুমানার চোখ নেই_লিমনের পা নেই। শহরের কোথাও কোথাও পানি নেই_কোথাও গ্যাস নেই_মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথে নিরাপত্তা নেই। দ্রব্যমূল্যের এমন অবস্থা যে ভদ্রলোকদের চুরি করতে হবে। আব্বা_আপনি ঠিকই বলেছিলেন এই দেশে রোজা ও ঈদ এক রকম অভিশাপই। এ ঈদে আমরা কেউ-ই জামা চাই না। শুধু চারটে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে চাই। এই রহমতের মাসে স্রষ্টা নাকি সব চাওয়া পূরণ করেন। আমরা বাংলাদেশিরা কি এতই পাপী যে এই রহমতের মাসেও কোনো রহমত পাব না। হে আল্লাহ_দামি ইফতারি, জরিবুটির জামা-জড়োয়া ঝুমকা চাই না_সাধারণ ডাল-ভাত, একটু বিদ্যুৎ, একটু গ্যাস, পানি দিয়েই না হয় এই ১৪ কোটি মানুষকে এ আনন্দময় ঈদটা পার করিয়ে দাও। আমাদের জীবন এত কঠিন করে দিও না হে স্রষ্টা!
লেখক : সংগীতশিল্পী
লেখক : সংগীতশিল্পী
No comments