ধর্ম-ইসলামে শিশুর মৌলিক অধিকার by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানবসন্তানের জীবনই অত্যন্ত মূল্যবান। শিশুরা মা-বাবার হূদয়ের ফুল এবং মানব উদ্যানের হূদয়কাড়া সৌন্দর্য। তাই অন্তরের সত্যিকার মায়া-মমতা দিয়ে শিশুদের লালন-পালন করা এবং তাদের আদর্শ জীবন গঠন করা সবার কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে ইসলামের অনুপম শিক্ষা ও নীতিমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া শিশুদের প্রকৃত আদর্শ জীবন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। শিশু আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত উত্তম নিয়ামত।


এ জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশপূর্বক তাদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া প্রতিটি শিশুর মা-বাবার পবিত্র দায়িত্ব। আজকের শিশুদের মধ্যে লুকিয়ে আছে আগামী দিনের সুন্দর পৃথিবী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি বা শিশুরা পার্থিব জীবনের শোভা এবং স্থ্থায়ী সৎকর্ম তোমার প্রতিপালকের কাছে পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং বাঞ্ছিত হিসেবেও উৎকৃষ্ট।’ (সূরা আল-কাহ্ফ, আয়াত: ৪৬)
শিশুর জন্মে মানুষ স্বভাবগত কারণে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস করতে চায়, তা প্রকাশার্থে ইসলাম আকিকার বিধান দিয়েছে। ‘আকিকা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নবজাতকের মাথার চুল। শরিয়তের পরিভাষায় নবজাতকের সেই চুল ফেলার দিনে বিশেষ শর্তাবলির প্রতি লক্ষ রেখে যে পশু জবাই করা হয়, এটিকে ‘আকিকা’ বলে। এ আকিকা ইসলামের একটি তাৎপর্যমণ্ডিত সুন্নত। সাধ্য সাপেক্ষে পালন করা মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব। শিশুর উত্তম আদর্শময় নিরাপদ জীবন আকিকার দায়ে আবদ্ধ থাকে। আকিকার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রতিটি শিশু তার আকিকার দায়ে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে পশু জবাই করা হবে, তার নাম রাখা হবে এবং তার মাথা মুণ্ডিত করা হবে।’ (তিরমিজি, আহমাদ ও নাসায়ী)
শিশুর মননে আধ্যাত্মিক বিকাশের প্রাথমিক ক্ষেত্র হচ্ছে পরিবার। একটি শিশু সুন্দর মহৎ মানব হওয়ার পেছনে পরিবারের প্রভাব অতীব গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা জন্ম থেকে ছয়-সাত বছর পর্যন্ত যা শোনে, যা দেখে, তা-ই তার মানসিক বিকাশের প্রাথমিক ভিত্তি। প্রতিটি মুসলিম পরিবার যদি শিশুর শারীরিক সুস্থতা ও বৃদ্ধির দিকটার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বিকাশের দিকটা গুরুত্ব না দেয়, তাহলে শিশুরা মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত হবে না। একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য জাতিসংঘ ‘শিশু অধিকার সনদ’-এর ২৭ নম্বর ধারায় প্রতিটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, সামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে তাদের পর্যাপ্ত মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব বিষয়ে সবার বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন, ‘যে ছোটকে স্নেহ-মমতা করে না এবং বড়কে শ্রদ্ধা করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বুখারি, তিরমিজি)
আধুনিক যুগে পরিবারই শিশুর মূল শিক্ষাকেন্দ্র হওয়া উচিত। মা-বাবাই শিশুর জন্য জগতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, আর ঘর হলো শ্রেষ্ঠ পাঠশালা। শিশুদের মনের মতো করে গড়ে তোলা খুবই কঠিন। শান্ত হলেও শিশু শিশুই। তারা অনুভূতিপ্রবণ ও অনুকরণপ্রিয়। শিশুর সামনে যা কিছুই বলা হবে বা করা হবে, এর একটা চিত্র তার মনে অঙ্কিত হয়ে যায়; যা ভবিষ্যতে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই যে সংসারে মা-বাবা নিজেদের মধ্যে ভালো ব্যবহার করে, ভদ্রভাবে চলে, সুন্দর কথা বলে, সে সংসারের শিশুরাও ভালো হয়। যে সমাজসংসারে স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য, ঝগড়া-বিবাদ, পারিবারিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা লেগে থাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, সেসব সংসারের শিশুরা হয় অবাধ্য ও দুর্বিনীত। তারা বড় হয়ে মাদকাসক্ত ও সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লেখায়। এ জন্য মা-বাবাকে শিশুদের সামনে সংযত হয়ে চলা বা কথা বলা উচিত; যাতে পরিবারে শিশুরা সুশিক্ষা পায়। শিশুদের শারীরিক নির্যাতন না করে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষাদানের বিষয়ে নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা সন্তানদের (শিশুদের) স্নেহ কোরো, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার কোরো এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (তিরমিজি)
ইসলামে শিশুর অধিকারের বিষয়টিকে মৌলিক নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। শিশুর আদর, স্নেহ, তার সঙ্গে কথা বলা, খেলাধুলা করা, গান-ছড়া-গল্প শোনানো, তার সঙ্গে সদাচরণ করা, আনন্দ দান ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটে। পক্ষান্তরে তাকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া, ভয় দেখানো, ধমক দেওয়া বা তাকে অবহেলা করা হলে তার আবেগিক, সামাজিক ও মেধাগত দক্ষতার বিকাশ ব্যাহত হয়। শিশুদের কোমল ও পবিত্র মনে যদি একবার কোনো খারাপ ধারণা প্রবেশ করতে পারে, তবে তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে থেকে যায়। তাই নবী করিম (সা.) শিশু-কিশোরদের সঙ্গে খেলাচ্ছলেও মিথ্যা বা প্রতারণা করতে নিষেধ করেছেন।
মা-বাবার অন্তরে স্বভাবগতভাবেই শিশুর প্রতি গভীর মমত্ববোধ থাকা সত্ত্বেও আল্লাহপাক নানাভাবে তাদের কল্যাণ সাধনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। কেননা, শিশুরা শুধু মানুষেরই হূদয়ের ধন নয়, বরং তারও অত্যন্ত প্রিয় সৃষ্টি। এ জন্য শিশুদের একটি অনন্ত কল্যাণের পথে গড়ে তুলতে হবে। শিশুরা যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত এক হূদয় ভোলানো উপহার, তাই তাদের অন্যায় আবদার ও অসংগত মর্জির পরিপ্রেক্ষিতে আদর ও স্নেহের আবেগে তাদের ভুল পথে পরিচালনার সুযোগ না দেওয়া এবং আদর্শের পথে গড়ে তুলতে ত্রুটি না করার জন্য মহান আল্লাহ পূর্বাহ্নেই মানুষকে সাবধান করেছেন। ইসলাম শিশুদের ব্যাপারে মুসলমানদের অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় কল্যাণ ও সাফল্যের পথনির্দেশনা প্রদান করেছে, যা প্রাত্যহিক অনুশীলন ও বাস্তবায়ন
করে পারিবারিক জীবনকে পুণ্যোদ্যানে পরিণত করা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিকল্পিত পরিবার ও আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমে অনন্ত কল্যাণ-সমৃদ্ধি লাভ করা যায়।
 ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.