উৎসব-অপেক্ষা: দুর্গাপূজা

‘অপেক্ষা’ শব্দটির ভেতরে একটা সহজ ব্যাকুলতা কাজ করে। যা নেই, যা আসবে কিংবা হয়তো আসবেও না, তার জন্য ব্যাকুলতা। এই ব্যাকুলতা কি বিষণ্নতাও? সব সময় হয়তো না। অন্তত যখন ছোটবেলার পূজার দিনগুলোর কথা মনে করি। অপেক্ষা সেখানে একটা আনন্দের সঙ্গেই মিশে থাকত। আশির দশকে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে পড়তাম।


প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে পুরান ঢাকার একটি প্রাইমারি স্কুলে প্রতিমা বানানোর কাজ দেখে আসতাম। কাঠামো হলো, আজ মাটি দেওয়া হবে, রংতুলি নিয়ে বসে গেছেন মৃৎশিল্পীরা, মাকে অলংকার পরানো হবে, চোখের সামনে একটা শিল্পকর্ম প্রাণ পেয়ে গেল। আর এই পরিবর্তনের পাশাপাশি চলত আমাদের দিন গোনার পালা। আর মাত্র দশ দিন, নয় দিন, আট দিন...
মহালয়া সেই অপেক্ষা আরেকটু বাড়িয়ে দিত। ভোরবেলা উঠে আকাশবাণী রেডিওতে মহালয়া শোনা, নতুন জামাকাপড় কেনার তাগিদ, বাবার সেই স্বভাবজাত কৌতুক: ‘নাহ, এবার পুজোর ছুটিতে আর ময়মনসিংহে যাওয়া হবে না।’ আর আমাদের কপালে চিন্তার রেখা: ‘বলে কী! না গেলে সব প্ল্যান মাটি।’ ঢাকায় থাকার সূত্রে ছোটবেলায় আমাদের অপেক্ষাটা এই শহর থেকে শুরু হলেও আমরা প্রতিবারই পূজায় চলে যেতাম ময়মনসিংহে; আমাদের মামার বাড়িতে। সারা বছর বাবা-মায়ের কঠোর অনুশাসনে থেকে দুর্গাপূজা আর ঈদের ছুটি অন্য এক স্বাধীনতার দরজা খুলে দিত। এখনো দুর্গাপূজার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে একান্নবর্তী মামার বাড়ি, আলোকসজ্জার ভেতরে সারি সারি পূজার মণ্ডপ, ঢাকের শব্দ, ভিড়, লোকসমাগম আর মা-বাবার সামাজিক ব্যস্ততার ভেতরে আমাদের সব ভাইবোনের অবারিত স্বাধীনতা। সারা বছর জমিয়ে রাখা দুষ্টুমি আইডিয়াগুলো পাখা মেলত এমনি সময়।
স্মৃতির কিছু অনুষঙ্গ থাকে। অনেক গান, অনেক কথায়, অনেক গল্পে এখনো ফিরে ফিরে আসে সেই সময়। আজও প্রবাসজীবনে পুরোনো দিনের অনেক বাংলা গান শুনি। তখন অবধারিতভাবে মনে পড়ে যায় দুর্গাপূজার সেই সন্ধ্যাগুলো, যখন পূজামণ্ডপের মাইকে এই গানগুলো বাজত। ঢাকের শব্দে মনে পড়ে আমাদের উত্তাল আরতি, অষ্টমী, নবমীর সন্ধ্যা; বিজয়া দশমীর শোভাযাত্রা। যেকোনো আনন্দের ভেতর এখনো মনে পড়ে অনেক হারিয়ে যাওয়া মুখ আর তাদের সঙ্গে দল বেঁধে পূজা দেখতে যাওয়া, লুকিয়ে সিনেমা দেখে মায়ের বকুনি আর দিদিমার স্নেহের প্রশ্রয়, প্রথমবারের মতো সিগারেট খেয়ে লেবুপাতা দিয়ে মুখ ঘষে বাড়ি ফিরে অপরাধবোধে ভোগা—এ রকম আরও কত কী।
স্যামুয়েল ব্রেখটের গোডোর জন্য প্রতীক্ষা নাটকটির কথা মনে আছে? দুজন লোক সেখানে অপেক্ষায় থাকে একজন গোডো আসবেন বলে, আর এর মাঝখানে ঘটে যায় অনেক বিচিত্র ঘটনা। প্রতীক্ষার প্রহর শেষে গোডো কখনো আসেনি; কিন্তু বাঙালি জীবনে অনেক ঘটনার পর শরৎ আর পূজার ছুটি এসেছে বারবার, শুধু একবার ছাড়া। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের কোথাও কোনো দুর্গাপূজা হয়নি। সেটা হওয়ার কোনো সুযোগও ছিল না। রমনার কালীমন্দির তো গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। শুনেছি, ময়মনসিংহে রশীদ নামের একজন মুসলিম মৃৎশিল্পী ছিলেন, যিনি প্রতিমা বানানোর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। আর তাঁর বানানো প্রতিমা এনে পূজা করা হতো বিভিন্ন মণ্ডপে। শুনেছি, একাত্তর সালে অনেকের মতো তিনিও শহীদ হন। দুর্গাপূজার এই আরেক চেহারা। আবহমান কাল ধরেই এটা একটা ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংখ্য পূজা সংগঠনের পেছনে জড়িয়ে থাকেন অনেক নাম-না-জানা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ। তাঁদের অবদান আর অংশগ্রহণে দুর্গাপূজা একটা ভিন্ন মাত্রা নেয়। এখনো বাংলাদেশে স্কুলগুলোতে একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে পূজার ছুটি। উৎসবপ্রিয় বাঙালির জন্য এ একটা বড় সম্মিলন।
পূজা শেষ, এবার ফেরার পালা। ফেরার দিন বুকে জমে থাকা একগাদা কষ্ট নিয়ে রিকশায় উঠছি রেলস্টেশনে যাব বলে। মা বারবার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। বাড়ির লোকজন বিদায় জানাতে চলে এসেছে সদর রাস্তা অবধি। বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছি, মণ্ডপগুলো ফাঁকা। দুর্গা মা ফিরে গেছেন কৈলাশে। আমার আবার পড়াশোনা আর নিয়মকানুনে ঢাকা জীবন। আবারও অপেক্ষা আগামী বছরের দুর্গাপূজার। তবু কেন জানি এ সময়ের অপেক্ষাটা আর আনন্দময় হয় না।
তবু এই অপেক্ষা মায়ের জন্য সন্তানের। ১৯৭১ সালে এ দেশে দুর্গাপূজা হতে পারেনি, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য এক আশ্চর্য সুন্দর অকালবোধন ছিল এই জাতির; ছিল সন্তানের জন্য মায়ের অপেক্ষা। ‘রুমীর এনলার্জ করা ফটোটা দোকান থেকে এনেছি। ... ফটোটা স্ট্যান্ডে লাগিয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম। কত দিন দেখিনি ওই প্রিয়মুখ। ...রুমী, রুমী। তুই কি কেবলই ছবি হয়ে রইবি আমার জীবনে?’ (১৯ নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭১; একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম)
 পার্থ সরকার
parthadhaka@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.