একজন বিদগ্ধ সংগ্রামী by ওয়াহিদ নবী
তার চিরবিদায়ের পর এই তার প্রথম জন্মবার্ষিকী। শোকের ছায়া মিলাবার আগেই তার জন্মোৎসব। তার মৃত্যুর মাত্র ৫৮ দিন পর তার ৮৯তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে সবাই আনন্দ করে। কিন্তু আজ আমরা এখনও শোকে মূহ্যমান। তিনি মেধাবী ছিলেন। শুধু এই পরিচয়েই তিনি অনেকের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি জ্ঞানের নিভৃত কুঞ্জে আশ্রয় নেননি।
আর দু'চারজন জ্ঞানতপস্বীর মতো নভোচারী হয়ে জ্ঞানের আশিস বারি সিঞ্চন করেননি। তিনি নিজের স্থান বেছে নিয়েছেন রাজপথে। যোগ দিয়েছিলেন জনতার কাতারে। একাত্ম হয়েছিলেন চলমান সংগ্রামে। মসিযুদ্ধ করেছিলেন নির্ভয়ে। জ্ঞানের সাধনা কখনোই ত্যাগ করেননি। তাই জ্ঞানের আলোকে পথ চিনে নিতে কষ্ট হয়নি তার সহযোদ্ধাদের।
মসিযুদ্ধ শুধু নয়। আদর্শের প্রয়োজনে বাগ্যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি এবং বাগ্যুদ্ধে নিয়োজিত থেকেছেন আজীবন। তিনি জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিয়েছেন সমাবেশ থেকে সমাবেশে। তিনি আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন যুক্তির মহান অস্ত্র হাতে নিয়ে। তিনি আজীবন বাগ্যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন মুখে হাসি নিয়ে। মুখে তিক্ততার আভাস তার ক্ষুরধার যুক্তিকে দুর্বল করে দিতে পারেনি। তার অমায়িক আচরণ তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তাকে মধুময় করেছে শুধু। তার অমায়িক আচরণ, তার অমলিন হাসি তার মেধার সঙ্গে মিশে তাকে সাহায্য করেছে সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথে দৃঢ় পদক্ষেপে চলতে। এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না সব সময়।
আমার জন্ম মফস্বল শহরে। বাংলাদেশে আমার লেখাপড়া মফস্বল শহরেই (আমার কর্মঠ বাবা-মার আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে)। তাই দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের সানি্নধ্য লাভ করার সৌভাগ্য বেশি হয়নি আমার। তাদের জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা শোনা থেকেও বঞ্চিত হয়েছি। তাদের লেখা যা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তাই পড়েছি শুধু। তাদের লেখা মূল্যবান বইপত্র যা কাছে পেয়েছি তাই পড়েছি। আমাদের কৃতী সন্তানদের কথা আর তাদের অবদানের কথা আমার চারপাশের মানুষদের কাছেও শুনেছি। অন্যের কাছে শোনা কথার সমস্যা হচ্ছে যে, বক্তার আবেগ মেশানো থাকে তাতে; এ আবেগ তার বিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে পারে। আমার এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, ছাত্রজীবনে (আমার সেই বন্ধু পরে একুশের পদকপ্রাপ্ত কবি হয়েছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক হয়েছিলেন) যে কবীর চৌধুরী ইংরেজির এমএ পরীক্ষায় বুদ্ধদেব বসুর রেকর্ড ভাঙতে পারেননি এই জন্য যে, শেষ প্রশ্নটির উত্তর দিতে তার একটু দেরি হয়েছিল, যদিও তিনি সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন। কবীর চৌধুরী নাকি বলেছিলেন, রেকর্ড ভাঙতে না পারার জন্য তার কোনো দুঃখ নেই, কারণ রেকর্ডটি রয়ে গেল যার হাতে, যাকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। বুদ্ধদেব বসু আমার কাছেও অত্যন্ত প্রিয় এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধার। কবি শামসুর রাহমান আক্ষেপ করেছিলেন যে, বুদ্ধদেব বসু সমালোচনায় মন দিয়েছিলেন। কিন্তু সাহিত্য আলোচনায় মন দেওয়ার জন্যই বুদ্ধদেব বসু আমার এত প্রিয়। এ প্রসঙ্গে মনে আসে যে, কবীর চৌধুরীর মতো বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ এবং অন্যরা ইংরেজির ছাত্র হয়েও বাংলা সাহিত্যকে সমুন্নত করেছেন।
তিনি শিক্ষকতা করেছেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ এবং ঢাকা কলেজে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন ১৯৭৪ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের কাছে শুনেছিলাম যে, এমএ পরীক্ষায় যিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত করা হয়। কবীর চৌধুরীর মতো অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রকে কেন বছর বছর অপেক্ষা করতে হলো? সরকারি চাকরিতে আকৃষ্ট হন অনেকে নানা কারণে। কিন্তু যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা পড়ালেখা করে এবং যেখানে সবচেয়ে উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা পড়ে, সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের চেয়ে আকর্ষণীয় চাকরি আর কিছু হওয়া উচিত নয়।
তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনে চাকরি করেছেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর পরিচালক পদে নিযুক্ত ছিলেন। ড. কুদরাত-ই-খোদার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সদস্য-সম্পাদকের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিযুক্ত ছিলেন। যেসব সংগঠনের দায়িত্বে তিনি নিযুক্ত ছিলেন সেসব সংগঠনকে তিনি আধুনিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার (সেক্যুলার) পথে পরিচালিত করেছেন। সংগঠনগুলোর আদর্শিক দিকগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলেও ব্যবস্থাপনার দিকগুলো তিনি উপযুক্ততার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন। একজন একাডেমিকের জন্য এটি একটি ব্যতিক্রম বলা চলে।
কবীর চৌধুরী নিরলসভাবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন অসাম্প্রদায়িক আদর্শের জন্য। বাংলাভাষার জন্য, বাংলা জাতীয়তাবাদের জন্য তিনি অবিরাম লিখে গেছেন। অবিরাম যুক্তির ক্ষুরধার তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন। ভাষার জন্য যুদ্ধ করতে করতে তিনি অসাম্প্রদায়িক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
অসাম্প্রদায়িক আদর্শের জন্য লড়ার কয়েকটি সমস্যা রয়েছে। যারা অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাসী তারা সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নন। ধর্মের অস্ত্র হাতে নিয়ে অসাম্প্রদায়িক আদর্শের বিরোধীরা যখন মারমুখী হয়ে ছুটে আসে, তখন অসাম্প্রদায়িক আদর্শের অনেক সমর্থক ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েন। কবীর চৌধুরীকে তাই অসম সাহসিকতার পরিচয় দিতে হয়েছিল। কবীর চৌধুরীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে জ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার নিয়ে। অজস্র প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন। ২৫০টির ওপর বই লিখেছেন। অনুবাদ কর্ম দিয়ে বিদেশ থেকে জ্ঞানের আশীর্বাদ নিজের দেশের মানুষদের জন্য নিয়ে এসেছেন। এসব কারণেই দেশ ও বিদেশের কৃতী সন্তানরা হয়েছিলেন তার সহযোদ্ধা। দীর্ঘ সংগ্রামের মানসিক প্রস্তুতি ছিল তার অসাধারণ ধীশক্তির কারণে। 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির' বুদ্ধিজীবী কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে যে দৃঢ়তা তিনি দেখিয়েছেন জাতি তা চিরদিন মনে রাখবে।
তার মেধা নিঃসৃত আশীর্বাদ থেকে জাতি উপকৃত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার ইতিহাস-চেতনা। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাঙালি জাতি যত সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে তার পুরোভাগে ছিলেন কবীর চৌধুরী। তার ছিল চারিত্রিক দৃঢ়তা আর নমনীয় আচরণ। ব্যক্তিত্বের দুটি বিরল গুণের সমাহার। জীবিতকালে তার সজীব উপস্থিতি তার সহযোগীদের অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি যা রেখে গেছেন ছাপার অক্ষরে তা আমাদের নিশ্চয়ই সঠিক পথের সন্ধান দেবে আগামীদিনে। অনুপ্রাণিত করবে জাতিকে।
তিনি নিদ্রার মাঝে চিরশান্তি লাভ করেছেন। তার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক। তার জন্মদিনে এই হোক আমাদের প্রার্থনা। মানুষের সংগ্রাম শেষ হয় না। সংগ্রাম কোনোদিন শেষ হবে না। আজীবন সংগ্রামী কবীর চৌধুরীর সংগ্রামও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তার সংগ্রামকে আমরা চালিয়ে নিয়ে যাব তার জন্মদিনে তার আত্মার কাছে_ এই হোক আমাদের শপথ।
ওয়াহিদ নবী : প্রবাসী চিকিৎসক ও প্রবন্ধকার
No comments