গহন গহীন-তুরস্কের রাজনীতিতে বাঁকবদল! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

দ্বিমহাদেশীয় রাষ্ট্র তুরস্কের ৯৭ শতাংশ এশিয়ায়, আর মাত্র ৩ শতাংশ ইউরোপে অবস্থিত হলেও পোশাকে, আচার-আচরণে তুর্কিরা যতটা ইউরোপীয়, তার চেয়ে বেশি এশীয় নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর মিত্রশক্তি তুরস্কের বড় একটা অংশ দখল করে নিলে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক নামের তরুণ তুর্কি সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে একদল সেনা কর্মকর্তা মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং বিজয়ী হয়ে ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্র_তুর্কি জমহুরিয়া; এবং কামাল আতাতুর্ক প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।


তুরস্ক গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সাংবিধানিক প্রজতান্ত্র রাষ্ট্র, যার রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। ন্যাটো শক্তির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য দক্ষিণ আটলান্টিক জোটের সেনাবাহিনীতে সেনাসংখ্যার হিসাবে তুরস্কের অবস্থান দ্বিতীয়। ২০০৫ সালের শুরু থেকে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করার জন্য দেনদরবার করলেও এখন পর্যন্ত সহযোগী সদস্যপদ থেকে সদস্যপদে উন্নীত হতে পারেনি। এ জন্য অবশ্য ইউরোপীয় দেশগুলোর একগুঁয়েমিকে দায়ী করা হয়।
তুরস্কের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া নির্বাচিত সরকারের পক্ষেও ক্ষমতা গ্রহণ তুরস্কে অকল্পনীয়।
কিন্তু অতিসম্প্রতি ঘটে যাওয়া আকস্মিক এক ঘটনার ফলে তুরস্কের এতকালের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
গত ২৯ জুলাই তুরস্কের সেনাপ্রধান জেনারেল ইসাক কোসান এবং বিমান ও নৌবাহিনীপ্রধান একযোগে পদত্যাগ করলে দেশটিতে সংকটের আভাস পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়েছিল, এর ফলে দেশটিতে সেনাবাহিনী ও সরকার অনিবার্যভাবে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। তিন বাহিনীর ত্রয়ীর এই পদত্যাগের কারণও সংকটের ইঙ্গিতবহ। বেসামরিক সরকারকে উৎখাতের অভিযোগে একদল পদস্থ সেনা কর্মকর্তার বিচারের কারণেই এই পদত্যাগ।
একটি সেনা অভ্যুত্থান অত্যাসন্ন_এমন ধারণা যাঁরা পোষণ করতেন, তাঁরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলেন, প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান শক্ত হাতে ক্ষমতা ধরে আছেন এবং আধুনিক তুরস্কের সেনা নেতৃত্ব প্রথমবারের মতো বেসামরিক সরকারের কর্তৃত্বের কাছে নতি স্বীকার করেছে বলে মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যদি তেমনটাই হয়, তাহলে এর পুরো কৃতিত্ব পাবেন প্রধানমন্ত্রী এরদোগান, যিনি ১২ জুন তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ইতিমধ্যে কুর্দি, সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের সঙ্গে সমস্যার সমাধান করেছেন। তুরস্কের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান করার পর এখন তাঁর দৃষ্টি সামরিক বাহিনীর প্রতি।
এতকাল তুরস্কবাসী রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে মুখ্য ভাবলেও এখন মনে হয় দেশটির রাজনীতিতে বাঁকবদল ঘটেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার ফলে দেশবাসীর কাছে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি এখন উজ্জ্বল, তাঁর ক্ষমতাও অনেক সংহত। সেনানায়কদের সে কারণেই হয়তো এমন নমনীয় অবস্থান এবং সেনাপ্রধানের পদত্যাগের পরপরই কালবিলম্ব না করে নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে আধাসামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল নেজদেত ওজালের নিযুক্তি প্রধানমন্ত্রীর ঘটনাপ্রবাহের ওপরের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের পরিচায়ক।
২৯ জুলাইয়ের পদত্যাগ-পর্বকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল দেখেন তুরস্কে চলমান সমান্তরাল ক্ষমতা-ব্যবস্থার অবসান হিসেবে। ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সংক্ষেপে একেপির রাজনৈতিক অভীষ্ট এর দ্বারা অর্জিত হওয়ার পথে।
১৯৯০-এর দশকের শেষ ভাগে জনসাধারণের সামনে উচ্চৈঃস্বরে ইসলামী ভাবধারাসংবলিত কবিতা আবৃত্তি করার অপরাধে কারাভোগকারী এরদোগান ২০০২ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে কিংবা নিরপেক্ষ রাখতে প্রয়াসী হন।
প্রথমবার নির্বাচনে জয়ী এরদোগান ও তাঁর একেপি পার্টির অনেকটা সময় কেটেছে ক্ষমতার ভিত মজবুত করার কাজে। নির্বাচনের পর এক বছর তুরস্কের সর্বোচ্চ আইনি প্রতিষ্ঠান কনস্টিটিউশনাল কোর্টের রায়ে ক্ষমতার বাইরে তাঁকে ও তাঁর দলকে থাকতে হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারেননি তিনি। ২০০৭ সালে একই আদালত আবদুল্লাহ গুলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পথ রুদ্ধ করে দেন। এক বছর পর একই কোর্ট রায় দেন এই মর্মে যে একেপি পার্টি তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া থেকে বেঁচে যায়।
সেটাই ছিল তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তাদের শেষ শক্তি প্রদর্শনের নজির। ইসলামপন্থী দল হিসেবে বিবেচিত একেপি পার্টির তুরস্কের রাজনীতিতে সর্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের শুরু এই বছর_২০০৭ সাল থেকেই।
মি. গুল প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর একেপি পার্টি দুইবার নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে অনেক সেনা কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক, আইনজীবী কারারুদ্ধ হয়ে বিচারের অপেক্ষায় আছেন।
জনগণের ধারণা, প্রধানমন্ত্রী এরদোগান বর্তমানে এমনই ক্ষমতাশালী হয়েছেন যে দেশকে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ থেকে সরিয়ে ধর্মভিত্তিক আদর্শের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। মদ্যপানের ওপর আরোপিত সাম্প্রতিক কড়াকড়ি ব্যবস্থাকে অনেকেই দেখেন এই পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের হিজাব পরার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল দেশকে ইসলামীকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।
মি. এরদোগান ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি দেশটিকে আরো বেশি গণতান্ত্রিক করার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করার পদক্ষেপ নেবেন। তবে এই পরিবর্তন অবশ্যই আনা হবে বিরোধী দলের সমর্থন ও সহায়তায়।
বিরোধী দল শাসনতন্ত্র সংশোধনের ব্যাপারে কতটা সহায়তা করবে, তা এক প্রশ্ন। কারণ ইতিমধ্যে তুরস্কে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের একক সিদ্ধান্তে।
যাঁরা তুরস্কের বর্তমান রাজনৈতিক বাঁকবদলের ব্যাপারে উৎসাহী, তাঁরা সাম্প্রতিককালে দেশটির বিভিন্ন সময়ের ঘটনাপঞ্জির প্রতি দৃষ্টি দিতে পারেন।
দেশের শাসনব্যবস্থার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভের ক্ষেত্রে এই ঘটনাগুলো মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে :
* ২০০২ সালে ইসলামপন্থী জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি_একেপির নির্বাচনে জয়লাভ।
* ২০০৭, এপ্রিল : সেনাবাহিনী 'ই-মেমোরেন্ডাম' জারির মাধ্যমে হুঁশিয়ার করে দেয়, প্রেসিডেন্ট পদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের কোনো ব্যত্যয় ঘটলে তারা হস্তক্ষেপ করবে।
* ২০০৭, মে : একেপি পার্টির আবদুল্লাহ গুলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পার্লামেন্টের অনুমোদন লাভের প্রয়াসকে রুদ্ধ করে রায় দেন কনস্টিটিউশনাল কোর্ট।
* ২০০৮, জুলাই : তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি হুমকি মনে করে একেপি পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে কনস্টিটিউশনাল কোর্টের ব্যর্থ প্রয়াস।
* ২০০৮, জুলাই : সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের তরফে গণহারে মামলা দায়ের।
* ২০১০ : কনস্টিটিউশনাল কোর্টের এখতিয়ার পরিবর্তন করতে গণভোটে একেপি পার্টির জয়লাভ।
* ২০১১ : সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে তিন বাহিনীর প্রধানের পদত্যাগপত্র পেশ।
তুরস্কের রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তা আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হবে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যা লক্ষণীয় তা হলো, সরকার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার আগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কিছু সমস্যার সমাধান করেছে, যার ফলে জনসমর্থন পেতে তার সুবিধা হয়েছে এবং যেখানে সমর্থন সরাসরি পাওয়া যায়নি, সেখানেও বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি সরকারকে।
সর্বশেষ যা লক্ষণীয় তা হলো, তিন বাহিনী প্রধানের ইস্তফাপত্র দাখিল করার সময় নির্বাচন, যা তাঁদের দেশপ্রেমের পরিচায়ক। তাঁরা পদত্যাগপত্র পেশ করেছেন শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই। ফলে তুরস্কের মুদ্রামানে কোনো হেরফের ঘটেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে লিরা তার মুদ্রামান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এবং পরবর্তী সোমবার সাপ্তাহিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার আগেই নতুন সেনাপ্রধানের নিযুক্তির ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আগের সপ্তাহের ঘটনাবলির কোনো প্রভাবই পড়ল না।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

No comments

Powered by Blogger.