বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা-বই-আলোচনা-গানে জমজমাট by আশীষ-উর-রহমান

সন্ধ্যায় ফুরফুরে হাওয়া। তাতে ভাসছে মরমি গানের সুর, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়’। মেলার মাঠে লোকজন যথেষ্ট। তবে ছুটির দিনের মতো অস্বস্তিকর ভিড় নেই। স্টলে স্টলে ঘুরে বইপুস্তকের পাতা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে ক্রেতা-দর্শক কান পেতে ছিলেন গানের সুরে। অনেকে আবার গান শুনতে আটকে থাকলেন মঞ্চের সামনে। এমনই ছিল গতকাল বুধবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার পরিবেশ।


প্রথম সপ্তাহ পার করে অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন বেচাকেনা, নতুন বইয়ের প্রকাশনা, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পারস্পরিক যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে জমজমাট হয়ে উঠেছে।
শিক্ষকেরা বিজ্ঞানবিষয়ক বই লেখেন না
ভিড় কম হলেও বিক্রির ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। বরাবরই শিশু-কিশোরদের বই বেশ ভালো বিক্রি হয়। এবারও তাই। কথা হলো বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান একাডেমীর প্রকাশক আবু মুসা সরকারের সঙ্গে। তাঁরা এবার ১৯টি নতুন বই এনেছেন। এর মধ্যে আছে স্কুল পর্যায়ে জাতীয় বিজ্ঞান মেলার বিশেষ ১০০ প্রজেক্ট নিয়ে বই। এ ছাড়া রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, মাধ্যাকর্ষণ, অণু, ভূমিকম্প, সমুদ্র, গণিত, পরিবেশ, ভূবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আলাদা বই; বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনী—এসব। আবু মুসা সরকার বললেন, স্কুলপড়ুয়ারাই বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের প্রধান ক্রেতা। তাঁর ভাষায়, ‘ক্লাস টেন পার করার পর শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বই পড়ার প্রয়োজন মনে করে না। নিজেদের বিজ্ঞানী মনে করে। আমার অধিকাংশ ক্রেতাই ১৬ বছরের কম বয়সী। নতুন প্রজন্মের এই বিজ্ঞানমনস্কতা দেশে ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই বইগুলোর লেখকেরা বিখ্যাত কেউ নন; বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাই এসব বই লিখে থাকেন। মূলত ইন্টারনেট থেকে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বইগুলো তাঁরা শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে লেখেন। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষকেরা শিশু-কিশোরদের উপযোগী বই লিখতে আগ্রহী হন না। আমাদের দেশে বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণা বা উদ্ভাবনও তেমন নেই। ফলে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিজ্ঞানের যে উন্নয়ন-অগ্রগতি হচ্ছে, তাকে শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে লিখেছেন। এতে করে বিজ্ঞানবিষয়ক মৌলিক বইয়ের ঘাটতি না মিটলেও শিশু-কিশোরদের বিজ্ঞানের নানাবিধ শাখার প্রাথমিক ও হালফিল নানা তত্ত্ব-তথ্য পাওয়ার চাহিদা পূরণ হচ্ছে।’
মোড়ক উন্মোচন
গতকাল বেশ কয়েকটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে নজরুল মঞ্চে। এর মধ্যে ছিল ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের ফরটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ ওয়ে ফরওয়ার্ড। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ছায়াবীথি থেকে প্রকাশিত অধ্যাপক এ কে এম নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ নারী ইত্যাদি।
নতুন বই
তথ্যকেন্দ্রে গতকাল জমা পড়েছে ৮৪টি নতুন বইয়ের নাম। প্রথমা প্রকাশন থেকে এসেছে কবি শামসুর রাহমানের অনুবাদ করা বিদেশি কবিদের কবিতা শামসুর রাহমানের অনুবাদ কবিতাসমগ্র। এ ছাড়া সিঁড়ি প্রকাশন থেকে এসেছে মো. আবদুল কাইউম ঠাকুরের ইতিহাসবিষয়কপলাশী থেকে বাংলাদেশ। অক্ষর থেকে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রবন্ধ বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলিম সমাজ। অন্যপ্রকাশ থেকে নাসরীন জাহানের উপন্যাস কবচকুণ্ডল। আগামী থেকে ড. মো. আনোয়ার হোসেনের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের। আফসার ব্রাদার্স থেকে বদরুদ্দীন উমরের প্রবন্ধ রাজনীতির আকাশে অশনি সংকেত। অনন্যা থেকে দাউদ হায়দারের কবিতাগ্রন্থ ধূসর গোধূলি ধূলিময়। জাগৃতি থেকে আবুল কাশেম ফজলুল হকের প্রবন্ধ উনিশ শতকের মধ্য শ্রেণী ও বাংলা সাহিত্য। অনিন্দ্য থেকে নুরুল আনোয়ারের প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথের গান: বাঙালী সংস্কৃতির শীর্ষ পরিণতি। শুদ্ধস্বর থেকে শওকত হোসেন মাসুমের রম্য রঙ্গরসে জীবনযাপন। অনুপম থেকে রাজীব সরকারের প্রবন্ধ নিহত রবীন্দ্রনাথ। অনন্যা থেকে ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহর স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্বাচিত কলাম।
মঞ্চে
গতকাল মেলার মূল মঞ্চে ভাষাসংগ্রামী শিল্পী ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রমেশ শীল ও আবদুল হককে নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কামাল লোহানী, মাহমুদ সেলিম ও সাইম রানা। আলোচক ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ও হরিশংকর জলদাস। সভাপতিত্ব করেন পণ্ডিত রামকানাই দাশ। পরে লোকগানে শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন লতিফ সাঁই, আরজ আলী বয়াতি, বাউল রণজিৎ দাস ও বাউল মমতা রানী দাসী, টুনটুন সাধুসহ অন্য লোকশিল্পীরা। সন্ধ্যায় বইয়ের সান্নিধ্যে আর গানের সুরে সময়টা কাটবে সারা মাস।

No comments

Powered by Blogger.