বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্টের বিষোদ্গার by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
দি ইকোনমিস্ট একটি বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিষয়ক সাপ্তাহিক। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি বিচ্ছিন্ন নয়, তাই সে সম্পর্কেও প্রতিবেদন থাকে। পত্রিকাটি গত ৩০ জুলাই-৫ আগস্ট সংখ্যায় Indian and Bangladesh Embraceable You (পৃষ্ঠা-২১) শিরোনামে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলাদেশ তথা এর জনগণকে অপমান করে কিছু কথা বলেছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
বলা হয়েছে যে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আমাদের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভারত থেকে বস্তা বস্তা টাকা এবং উপদেশ এসেছে। আমি মোটামুটি এই পত্রিকার একজন নিয়মিত পাঠক। তাই গত নির্বাচনের আগে ও পরে এই পত্রিকায় কী মন্তব্য বেরিয়েছিল তা নজরে পড়েছিল। কিন্তু পত্রিকা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার বন্ধু ও সাবেক সচিব, কূটনীতিক, তুখোড় কলামিস্ট মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানলাম যে তাঁর কাছে ওই কপি রয়েছে। তিনি এর উদ্ধৃতি দিয়ে একটি দৈনিকে একটি শক্তিশালী নিবন্ধ লিখেছেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে ইকোনমিস্টের তখনকার মন্তব্য তুলে ধরছি। নির্বাচনের ১৮ দিন আগে তাদের মন্তব্য, 'গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কর্তৃক পরিচালিত জনমত জরিপে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ একটি ভূমিধস বিজয় অর্জন করবে।' নির্বাচনের পর তাদের প্রতিবেদনে অনেক কথার পর শেষ কথা হলো (অতীতের সব ধরনের অভিজ্ঞতার বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষজন একটি সদ্যঃসমাপ্ত পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ নির্বাচন এবং প্রশ্নাতীত ফলের পর একটু আশাবাদী হয়ে উঠেছে)। এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই সাধারণ নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার নির্বাচন হয়েছিল। সেখানেও আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। অথচ আড়াই বছর পর পত্রিকাটি ভারতীয় টাকা এবং উপদেশের বস্তা আবিষ্কার করল। বাংলার মানুষ কোনো ব্যাপারে উপলব্ধি করলে ব্যাপকভাবে ভোট দেয়, আবার তার দিক থেকে মুখও ফিরিয়ে নেয়। ১৯৪৩ সালে পাকিস্তান অর্জনের জন্য মুসলিম লীগকে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট দিয়েছিলেন বাংলার জনগণ। আবার ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সেই মুসলিম লীগকে ৩০০টির মধ্যে মাত্র ৯টি আসন দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়ী হয়েছিল। আগামী নির্বাচনে জনগণ যেটা ভালো মনে করবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন। কারো টাকার অপেক্ষায় তাঁরা থাকবেন না। তা ছাড়া গত নির্বাচনে বিএনপি ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকলে বিএনপি সংসদে ৯০টি আসন পেত। গণতন্ত্রের ফর্মুলার কারণে তারা আসন পেয়েছে ৩২টি। সরকারের ভুলভ্রান্তি, দুর্নীতি, অত্যাচার কিংবা অবিচারের সমালোচনা করার অধিকার সবারই রয়েছে। কিন্তু জনগণের মেধাকে অবমূল্যায়ন করার অধিকার কারো নেই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইকোনমিস্টের একই সংখ্যায় আরো দুটি প্রতিবেদন রয়েছে। প্রতিবেদন দুটি পড়লে বোঝা যায় যে ভারত এতদঞ্চলে একটি বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, যাকে বলা হয়েছে ঐবমবসড়হু বা আধিপত্যবাদ। এই আলোচনা করতে গিয়ে চীনের কথাও এসেছে। প্রতিবেদন দুটি যথাক্রমে ৯ ও ২৬ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে ভারতের চেয়ে চীন অনেকটা সংযত বলে দেখানো হয়েছে। যাক, সেটি আমাদের বিষয় নয়, তাদের যত ইচ্ছা ভারতের সমালোচনা করুক। আমরা আমাদের কথাই বলব। তবে রহস্যজনক হলো, ভারতের এই আধিপত্যবাদের সমালোচনার সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে, যখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক যোগাযোগটা একটু বেশি হচ্ছিল এবং ভারতও অনেকটা খোলা মনে কথা বলা শুরু করেছিল। ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী এবং দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এর সঙ্গে। অতএব, আমাদের নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সমঝোতায় আসতে হবে। আমরা অন্য প্রতিবেশী এবং নিকটবর্তী দেশ চীন ও মিয়ানমারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি। চীনের সঙ্গে তো ব্যাপক বাণিজ্যিক ও আর্থিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ এবার স্বাধীনতার ৪০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে অনেক বিদেশি, যাঁরা সে সময় আমাদের সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের সম্মাননা জানাচ্ছে। এখানে সর্বাগ্র ব্যক্তি হিসেবে নাম আসে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর। তাঁর স্থান এক ও অনন্য। অতএব, তাঁকে পৃথকভাবে এখন একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মাননা জানানো হলো। অন্যদের ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে জানানো হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনটি বৃহৎ শক্তি_মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, চীন ও সৌদি আরবের নেতৃত্বে প্রায় বেশির ভাগ মুসলিম রাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। ব্রিটিশ ও ফরাসি সরকার বিরোধিতা না করলেও ইতিবাচক তেমন কিছু করেনি। একমাত্র দেশে গিয়ে জনগণকে অবহিত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেই দুঃসময়ে শ্রীমতী গান্ধী শরণার্থীদের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াও আমাদের জন্য কূটনৈতিক যুদ্ধও করেছেন। অতএব, বাংলার মানুষ তাঁকে আজীবন স্মরণ রাখবে। এবার তাঁকে সম্মাননা প্রদর্শনের সময় দেশের আপামর জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন এবং উল্লাস লক্ষ করা গেছে। অতএব, বিষয়টিকে প্রতিবেদনের গ্যাঁড়াকলে ফেলে অন্যভাবে দেখার সুযোগ নেই। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করার জন্য।
এই মন্তব্য অত্যন্ত দায়িত্বহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যাঁদের বিচার হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, যা আদালতে উপস্থাপন করা হবে। ট্রাইবুন্যালে যথারীতি তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে বিচার করা হবে। উপরন্তু তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ পাবেন। ইতিমধ্যে বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছিল, সেসব বিবেচনায় এনে বিচারপ্রক্রিয়ায় অনেক সংশোধনী আনা হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য এখনো বিচার করা হচ্ছে। আর ১৯৭১ সালে যে ভয়াবহ গণহত্যা হলো তার জন্য বিচার করা যাবে না, এটা কোন শাস্ত্রে রয়েছে? ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, সেখানে ধর্মকে ভিত্তি করে রাজনীতি করা নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে সামরিক ফরবানবলে সেই বিধি-নিষেধ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ রেখে দিয়েছে। অতএব, জামায়াতকে ধ্বংস করার অভিযোগ অবান্তর। বিনয়ের সঙ্গে ইকোনমিস্ট কর্তৃপক্ষের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আপনাদের সব মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণ সঠিক হয় না। যেমন_এক-এগারোর পর এই পত্রিকার একাধিক সংখ্যায় লেখা হয়েছিল যে দুই মহিলা আর একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পাবেন না, কেননা তাঁদের দুজনকে মাইনাস করা হবে। যা থেকে সেই কুখ্যাত 'মাইনাস ২ ফর্মুলা' কথাটা চালু হলো। কিন্তু দুই নেত্রীর ব্যাপক জনসমর্থন থাকার ফলে এই ফর্মুলা ভেস্তে গেছে। কারা এটা আবিষ্কার ও প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন, তা আমরা সঠিকভাবে জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি যে এর ফলে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল, আর সেই বিভ্রান্তির শিকার হয়ে কয়েকজন রাজনীতিক তাঁদের রাজনৈতিক জীবন বিপন্ন করেছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কিছু পত্রিকা ইরাকের সাবেক শাসক সাদ্দামের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সন্ধান পেয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। এরপর আসে বঙ্গবন্ধু কাল্টের কথা। একই প্রতিবেদনে এর উল্লেখ রয়েছে। বিবিসি জরিপে প্রমাণিত হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। দ্বিতীয় স্থানে আছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু ভোটের পার্থক্য অনেক। আমরা যত দূর জানি, দি ইকোনমিস্ট পত্রিকাটি একই সঙ্গে একটি গবেষণাকেন্দ্র। একটি প্রতিবেদন প্রয়োজনবোধে গবেষণালগ্ধ তথ্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক কে_এ তথ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর বাংলাদেশের বাইরেও যেসব ইতিহাস কিংবা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তা পর্যালোচনা করলেই পাওয়া যাবে। অতএব, বাংলার মানুষের হৃদয়ে মুজিবের যে স্থান, তা কোনো কাল্ট সৃষ্টি করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয় না। বরং আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বক্তব্যে, আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধুকে তাঁদের অজ্ঞাতে হয়তো হেয় করেছেন। যেমন_আমাদের বিরোধীদলীয় নেতা ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করেন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা আবেদন জানিয়েছেন, তিনি যেন ওই দিন উৎসব না করেন। কোটি বাঙালির হৃদয়ে যাঁর স্থান, সেখানে দু-একজন আনন্দ-উল্লাস করলে কী এসে যায়? গণতন্ত্র, পত্রিকার স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মানবিক মূল্যবোধ_এসব কথা পশ্চিমা বিশ্ব বেশি জোর দিয়ে বলা হয় এবং আমাদের জ্ঞানদানও করা হয়। আমরা অস্বীকারও করছি না। কিন্তু আগের কথার সুর ধরেই বলব, সব সময় সব বিষয়ে সরলীকরণ করা বাঞ্ছনীয় নয় কিংবা তাদের মূল্যায়ন হিসেবে সব কিছু ঘটবে, এমন কোনো কথা নেই। ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ল, তখন আরেকটি বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক টাইম পত্রিকায় মার্কিন জেনারেল ওয়েস্ট মুরল্যান্ডের একটি প্রচ্ছদ সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, দক্ষিণ ভিয়েতনামের মুক্তিকামী মানুষ ওই ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পশ্চিমা সরকার এবং পত্রপত্রিকা ভিয়েতনাম কমিউনিস্টদের সংক্ষেপে বলত ভিয়েতকং। এই সাক্ষাৎকারে মার্কিন জেনারেল হিসাব দিলেন যে প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিয়েতকং হত হচ্ছে, তা মার্কিন সেনাবাহিনীর হতের চেয়ে অনেক বেশি। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ভিয়েতকং নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং মার্কিন সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকার টিকে যাবে। কী ফল হয়েছিল তা সবাই অবগত। নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আমরা দি ইকোনমিস্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব, আমাদের ভিত্তিহীন তথ্য এনে হেয় করবেন না।
লেখক : সাবেক ইপিসিএস
এই মন্তব্য অত্যন্ত দায়িত্বহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যাঁদের বিচার হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, যা আদালতে উপস্থাপন করা হবে। ট্রাইবুন্যালে যথারীতি তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে বিচার করা হবে। উপরন্তু তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ পাবেন। ইতিমধ্যে বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছিল, সেসব বিবেচনায় এনে বিচারপ্রক্রিয়ায় অনেক সংশোধনী আনা হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য এখনো বিচার করা হচ্ছে। আর ১৯৭১ সালে যে ভয়াবহ গণহত্যা হলো তার জন্য বিচার করা যাবে না, এটা কোন শাস্ত্রে রয়েছে? ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, সেখানে ধর্মকে ভিত্তি করে রাজনীতি করা নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে সামরিক ফরবানবলে সেই বিধি-নিষেধ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ রেখে দিয়েছে। অতএব, জামায়াতকে ধ্বংস করার অভিযোগ অবান্তর। বিনয়ের সঙ্গে ইকোনমিস্ট কর্তৃপক্ষের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আপনাদের সব মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণ সঠিক হয় না। যেমন_এক-এগারোর পর এই পত্রিকার একাধিক সংখ্যায় লেখা হয়েছিল যে দুই মহিলা আর একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পাবেন না, কেননা তাঁদের দুজনকে মাইনাস করা হবে। যা থেকে সেই কুখ্যাত 'মাইনাস ২ ফর্মুলা' কথাটা চালু হলো। কিন্তু দুই নেত্রীর ব্যাপক জনসমর্থন থাকার ফলে এই ফর্মুলা ভেস্তে গেছে। কারা এটা আবিষ্কার ও প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন, তা আমরা সঠিকভাবে জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি যে এর ফলে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল, আর সেই বিভ্রান্তির শিকার হয়ে কয়েকজন রাজনীতিক তাঁদের রাজনৈতিক জীবন বিপন্ন করেছিলেন। পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কিছু পত্রিকা ইরাকের সাবেক শাসক সাদ্দামের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সন্ধান পেয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। এরপর আসে বঙ্গবন্ধু কাল্টের কথা। একই প্রতিবেদনে এর উল্লেখ রয়েছে। বিবিসি জরিপে প্রমাণিত হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। দ্বিতীয় স্থানে আছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু ভোটের পার্থক্য অনেক। আমরা যত দূর জানি, দি ইকোনমিস্ট পত্রিকাটি একই সঙ্গে একটি গবেষণাকেন্দ্র। একটি প্রতিবেদন প্রয়োজনবোধে গবেষণালগ্ধ তথ্য সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক কে_এ তথ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর বাংলাদেশের বাইরেও যেসব ইতিহাস কিংবা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তা পর্যালোচনা করলেই পাওয়া যাবে। অতএব, বাংলার মানুষের হৃদয়ে মুজিবের যে স্থান, তা কোনো কাল্ট সৃষ্টি করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয় না। বরং আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বক্তব্যে, আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধুকে তাঁদের অজ্ঞাতে হয়তো হেয় করেছেন। যেমন_আমাদের বিরোধীদলীয় নেতা ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করেন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা আবেদন জানিয়েছেন, তিনি যেন ওই দিন উৎসব না করেন। কোটি বাঙালির হৃদয়ে যাঁর স্থান, সেখানে দু-একজন আনন্দ-উল্লাস করলে কী এসে যায়? গণতন্ত্র, পত্রিকার স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মানবিক মূল্যবোধ_এসব কথা পশ্চিমা বিশ্ব বেশি জোর দিয়ে বলা হয় এবং আমাদের জ্ঞানদানও করা হয়। আমরা অস্বীকারও করছি না। কিন্তু আগের কথার সুর ধরেই বলব, সব সময় সব বিষয়ে সরলীকরণ করা বাঞ্ছনীয় নয় কিংবা তাদের মূল্যায়ন হিসেবে সব কিছু ঘটবে, এমন কোনো কথা নেই। ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ল, তখন আরেকটি বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক টাইম পত্রিকায় মার্কিন জেনারেল ওয়েস্ট মুরল্যান্ডের একটি প্রচ্ছদ সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, দক্ষিণ ভিয়েতনামের মুক্তিকামী মানুষ ওই ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পশ্চিমা সরকার এবং পত্রপত্রিকা ভিয়েতনাম কমিউনিস্টদের সংক্ষেপে বলত ভিয়েতকং। এই সাক্ষাৎকারে মার্কিন জেনারেল হিসাব দিলেন যে প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিয়েতকং হত হচ্ছে, তা মার্কিন সেনাবাহিনীর হতের চেয়ে অনেক বেশি। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ভিয়েতকং নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং মার্কিন সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকার টিকে যাবে। কী ফল হয়েছিল তা সবাই অবগত। নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আমরা দি ইকোনমিস্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব, আমাদের ভিত্তিহীন তথ্য এনে হেয় করবেন না।
লেখক : সাবেক ইপিসিএস
No comments