মানুষের তৈরি মরণফাঁদ by মহসীন হাবিব
In high seas or in low seas
I'm going to be your friend.
In high tide or in low tide
I'll be on your side...
I'm going to be your friend.
In high tide or in low tide
I'll be on your side...
I said I heard my mother,
She was crying, yeah!
And the tears that she shed
They still linger in my head
সত্তরের দশকের সাড়া জাগানো পপসংগীতশিল্পী বব মার্লিন এভাবেই দুস্থ মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন। অসাধারণ মেধাবী এবং মানবদরদী এ শিল্পী বলেছিলেন, 'কেউ বৃষ্টি অনুভব করে, আর বাকিরা সে বৃষ্টিতে ভেজে।' দরিদ্র দক্ষিণ এশিয়া (বিশেষ করে একসময়ের পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ বাংলাদেশ) এবং আফ্রিকার দিকে দৃষ্টি রেখে আমেরিকা ও ইউরোপের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিন্তাবিদরা পশ্চিমা সভ্যতাকে দিক নির্দেশনা দিতে চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর ক্ষুধার্ত মানুষের কথা বলতে শিখিয়েছেন। অ্যালেন গিন্সবার্গ, ম্যারি ম্যাককার্থি, টেড হিউজ, আলেকজান্ডার করডেল, রিচার্ড ক্রিচফিল্ডসহ অসংখ্য লেখক, ঔপন্যাসিক চেষ্টা করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দারিদ্র্য ও সংকট তুলে ধরতে। তাঁদের দ্বারা প্রভাবান্বিত পশ্চিমা সমাজ আজ মানবতার কথা বলছে। শুধুই কি মানবতার কথা? একটি বন্য পাখি বাঁচাতে, একটি হরিণ পাহাড়ের খাদে পড়লে বা তিমি মাছ বরফে আটকে গেলে বড়সড় উদ্ধারকারী দল ছুটে যাচ্ছে, একাধিক হেলিকপ্টার গিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নিচ্ছে। গণমাধ্যমে সে উদ্ধার অভিযান লাইভ দেখানো হচ্ছে।
এসব দেখে আমার একটি ধারণা জন্মেছিল যে এখন আর কোনো দেশে হঠাৎ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে কেউ না খেয়ে মরবে না। যোগাযোগব্যবস্থা আধুনিক হয়েছে, প্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয়। এখন একটি দেশ থেকে খাবার ভর্তি জাহাজ অন্য আরেকটি দেশে যেতে তিন মাস সময় লাগে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কয়েক শ টন খাবার এনে আফ্রিকা বা এশিয়ার কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে দিনে দিনে সরবরাহ করা সম্ভব। অন্যদিকে মানবাধিকারসংগঠনগুলো শক্তিশালী; দেশে দেশে মানবদরদীরা সোচ্চার। সুতরাং ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের মতো কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই কোথাও। কিন্তু বাস্তব চিত্র দেখে সে ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনের সময় তা কতটা পর্যাপ্ত ,সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমনিভাবে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে অসংগতিগুলো সন্দিহান করে তোলে_মানুষ বাঁচানোর সদিচ্ছা অন্তরের ভেতর থেকে কতটা তৈরি হয়েছে?
এখন থেকে দুই বছর আগে হলিউডের জনপ্রিয় চিত্রতারকা এবং জাতিসংঘের হাই কমিশনার ফর রিফিউজি অ্যানজেলিনা জুলি যখন কেনিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প দাবাব পরিদর্শন করেন তখন বলেছিলেন, এ অঞ্চলের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অ্যানজেলিনা জুলি মানবদরদের কারণে পশ্চিমাদের কাছে এখন সেন্ট জুলি বলে পরিচিতি পেয়েছেন। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সে সফরের সময় তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, দাবাবের অবস্থা যদি কিছুটা উন্নত বলা হয়, তাহলে সোমালিয়ার ভেতরের পরিস্থিতি কী? তাঁর সে উক্তির পর দুই বছর কেটে গেছে। সেই দাবাব ক্যাম্পে এখন প্রতিদিন সোমালিয়া থেকে ছুটে আসছে দেড় হাজার মানুষ প্রাণে বাঁচাতে। ক্যাম্পে আসার পথে মৃত্যুবরণ করছে ক্ষুধায় কাতর পুষ্টিহীন মা ও শিশু। ৫০ স্কয়ার মাইলের দাবাব ক্যাম্পে এখন চার লক্ষাধিক মানুষ রয়েছে। যেখানে ৯০ হাজার শরণার্থীর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সোমালিয়া ও কেনিয়ার পূর্বাঞ্চলে চলছে প্রচণ্ড খরা। ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, কেনিয়া, জিবুতি, সুদান ও সোমালিয়ায় ভয়ানক খরা দেখা দিয়েছে। এ অঞ্চলকে ডাকা হয় হর্ন অব আফ্রিকা নামে। মানুষ ও গবাদিপশুর কোনো খাবার অবশিষ্ট নেই। মায়ের কোলে হাড়সর্বস্ব শিশু প্রাণ দিচ্ছে। নিষ্ঠুর পরিস্থিতি কাকে বলে! দাবাব ক্যাম্পে আসতে গিয়ে সোমালিয়ার আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন আল শাবাব অধ্যুষিত এলাকা পার হওয়ার সময় কয়েক সপ্তাহ ধরে না খেয়ে থাকা মৃত্যুমুখে পতিত নারীরা গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কারণ আল শাবাব তাদের অর্থাৎ অমুসলমানদের খাবার নিতে দেবে না! অন্যদিকে কেনিয়ার ভেতরে দাবাব ক্যাম্পের বিস্তার নিয়ে সন্দেহ ঢুকে গেছে। অতিমাত্রায় জাতীয়তাবাদীরা ভাবছেন, আবার বুঝি ভালো মানুষির আড়ালে কেনিয়া হাতছাড়া হয়ে যায়!
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা কেনিয়ার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ফিরে গেছেন ওয়াশিংটন। তাঁরা শরণার্থী ক্যাম্পও পরিদর্শন করেছেন। তাঁদের সফরসঙ্গী ছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্ত্রী জিল বাইডেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ সহকারী গেইল স্মিথ বলেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় দাতা দেশ। আমরা ৬৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য (নতুন ঘোষিত ১০৫ মিলিয়ন ডলারসহ) দিয়েছি। আমরা আমাদের ত্রাণ সরবরাহ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। কিন্তু যে মাত্রায় সংকট দেখা দিয়েছে, তা আমরা একা মোকাবিলা করতে পারব না। আমাদের সঙ্গে অন্যান্য দেশকেও এগিয়ে আসতে হবে।' তিনি বলেছেন, 'সত্যি কথা বলতে কি, এখন নগদ অর্থের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।'
এ কান্নাকাটির প্রয়োজন হচ্ছে কেন_সেটাই প্রশ্ন। বিশ্বমন্দার গল্প শুনিয়ে, ইমার্জিং ইন্ডিয়া-চায়নার গল্পে বিভোর ইউরোপ দ্রুতই হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। কোটি কোটি ডলার বাজেটের দেশগুলো সামান্য বেকারত্বে অস্থির হয়ে উঠছে। জুলাই মাসে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল গিয়েছিলেন দুর্ভিক্ষপীড়িত আফ্রিকায়। তিনি সাহায্য হিসেবে ১২ মিলিয়ন মানুষের জন্য মাত্র ১.৪ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্রিটেনে ২০০৪ সালের সুনামির সময় সাহায্য (ডোনেশন) উঠেছিল ৩৯৬ মিলিয়ন পাউন্ড, হাইতিতে ভূমিকম্পের সাহায্য উঠেছিল ১০৬ মিলিয়ন পাউন্ড এবং পাকিস্তানের প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য উঠেছে ৭১ মিলিয়ন পাউন্ড। কিন্তু হর্ন অব আফ্রিকার এতবড় মৃত্যুমুখী জনপদের জন্য এখন পর্যন্ত উঠেছে ৪৫ মিলিয়ন ডলার, যা ডিজাস্টার ইমার্জেন্সি কমিটির হাতে পেঁৗছেছে।
সত্যিই হিসাব মেলানো দায়। আফ্রিকায় এখন এক কোটি ২০ লাখ লোকের খাদ্যের সংকট রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চোখের সামনে এভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটছে, অথচ ট্রিলিয়ন ডলার হিসাবের বাজেটের দেশ যুক্তরাষ্ট্র বলছে, একা পারব না! ১৯৭১ সালে তৎকালীন দরিদ্র ভারত বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাবার দিয়েছিল মাসের পর মাস। তাতে ভারতের অর্থনীতির ওপর কতটাই বা চাপ পড়েছিল? ভারত কি সামলে নেয়নি? নিয়েছিল। কারণ ভারতের তখন সত্যিকার অর্থে এ দায় নেওয়ার মানসিকতা ছিল।
অমর্ত্য সেন মনে করেন, আধুনিক অর্থনীতিতে দুর্ভিক্ষ মানুষের তৈরি। অনাবৃষ্টি, খরার কারণে এখন কোথাও দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। হর্ন অব আফ্রিকার বর্তমান দুর্ভিক্ষ অমর্ত্য সেনের কথারই অকাট্য প্রমাণ।
অনেক খেলা আফ্রিকাজুড়ে। কিছু বুঝতে পারি না। সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে ৯ হাজার শক্তিশালী, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী রয়েছে। কিন্তু তার পরও মোগাদিসু আল শাবাবের হাত থেকে নিরাপদ নয়। আফগানিস্তানে যে আল-কায়েদাকে উৎখাত করেছে আমেরিকা, তার এক হাজার ভাগের এক ভাগ ক্ষমতা আল শাবাবের নেই। কেন আল শাবাবের অস্তিত্ব বিলোপ করা হচ্ছে না, এটা কি একটি রহস্য নয়? পশ্চিমারা মনে করছে, অথবা সত্যিই দেখা যাচ্ছে যে চীন হর্ন অব আফ্রিকার জমি দীর্ঘমেয়াদি লিজের মাধ্যমে হস্তগত করছে। পশ্চিমাদের কেউ কেউ আবার দুর্ভিক্ষের জন্য চীন দায়ী বলে উচ্চ কণ্ঠে বলতে শুরু করেছে। এতবড় পলিটিকস কী ক্ষুধার্ত ক্যাম্পের দিকে একটু খাবারের আশায় ছুটতে ছুটতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরা মানুষগুলো বোঝে?
ইরাকের কবি মুহাম্মদ মাহদি আল জাওয়াহিরিকে আমি আরবের ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বলে ভাবি। জাওয়াহিরির একটি কবিতার কয়েকটি চরণ আফ্রিকার ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য প্রযোজ্য_
ঘুমাও, হে ক্ষুধার্ত মানুষ, ঘুমাও
খাবারের দেবতারা তোমাদের দিকে নজর রাখছেন
যদি জেগে তৃপ্ত হতে না পার
তবে ঘুমই তোমাকে তৃপ্ত করবে
প্রতিশ্রুত মাখনের মতো নরম কল্পনা নিয়ে ঘুমাও
মধুর মতো মিষ্টি কথামালা নিয়ে ঘুমাও
ঘুমিয়েই তোমার স্বাস্থ্য উপভোগ কর...
(ইংরেজি থেকে নিবন্ধকারের অনূদিত)
বলার অপেক্ষা রাখে না, উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার মানুষদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ শিক্ষা বঞ্চনা এবং ধর্মীয় কুসংস্কার। যে কারণে দেশি ও বিদেশি শক্তি তাদের বুভুক্ষু অবস্থায় 'হত্যা' করছে। বাংলাদেশও এ দুই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়। ভয় হয়, আফ্রিকার এ পরিণতি একদিন বাংলাদেশে আসবে না, তার গ্যারান্টি কী?
লেখক : সাংবাদিক, mohshinhabib@yahoo.com
She was crying, yeah!
And the tears that she shed
They still linger in my head
সত্তরের দশকের সাড়া জাগানো পপসংগীতশিল্পী বব মার্লিন এভাবেই দুস্থ মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন। অসাধারণ মেধাবী এবং মানবদরদী এ শিল্পী বলেছিলেন, 'কেউ বৃষ্টি অনুভব করে, আর বাকিরা সে বৃষ্টিতে ভেজে।' দরিদ্র দক্ষিণ এশিয়া (বিশেষ করে একসময়ের পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ বাংলাদেশ) এবং আফ্রিকার দিকে দৃষ্টি রেখে আমেরিকা ও ইউরোপের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিন্তাবিদরা পশ্চিমা সভ্যতাকে দিক নির্দেশনা দিতে চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর ক্ষুধার্ত মানুষের কথা বলতে শিখিয়েছেন। অ্যালেন গিন্সবার্গ, ম্যারি ম্যাককার্থি, টেড হিউজ, আলেকজান্ডার করডেল, রিচার্ড ক্রিচফিল্ডসহ অসংখ্য লেখক, ঔপন্যাসিক চেষ্টা করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দারিদ্র্য ও সংকট তুলে ধরতে। তাঁদের দ্বারা প্রভাবান্বিত পশ্চিমা সমাজ আজ মানবতার কথা বলছে। শুধুই কি মানবতার কথা? একটি বন্য পাখি বাঁচাতে, একটি হরিণ পাহাড়ের খাদে পড়লে বা তিমি মাছ বরফে আটকে গেলে বড়সড় উদ্ধারকারী দল ছুটে যাচ্ছে, একাধিক হেলিকপ্টার গিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নিচ্ছে। গণমাধ্যমে সে উদ্ধার অভিযান লাইভ দেখানো হচ্ছে।
এসব দেখে আমার একটি ধারণা জন্মেছিল যে এখন আর কোনো দেশে হঠাৎ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে কেউ না খেয়ে মরবে না। যোগাযোগব্যবস্থা আধুনিক হয়েছে, প্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয়। এখন একটি দেশ থেকে খাবার ভর্তি জাহাজ অন্য আরেকটি দেশে যেতে তিন মাস সময় লাগে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কয়েক শ টন খাবার এনে আফ্রিকা বা এশিয়ার কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে দিনে দিনে সরবরাহ করা সম্ভব। অন্যদিকে মানবাধিকারসংগঠনগুলো শক্তিশালী; দেশে দেশে মানবদরদীরা সোচ্চার। সুতরাং ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের মতো কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই কোথাও। কিন্তু বাস্তব চিত্র দেখে সে ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনের সময় তা কতটা পর্যাপ্ত ,সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমনিভাবে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে অসংগতিগুলো সন্দিহান করে তোলে_মানুষ বাঁচানোর সদিচ্ছা অন্তরের ভেতর থেকে কতটা তৈরি হয়েছে?
এখন থেকে দুই বছর আগে হলিউডের জনপ্রিয় চিত্রতারকা এবং জাতিসংঘের হাই কমিশনার ফর রিফিউজি অ্যানজেলিনা জুলি যখন কেনিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প দাবাব পরিদর্শন করেন তখন বলেছিলেন, এ অঞ্চলের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অ্যানজেলিনা জুলি মানবদরদের কারণে পশ্চিমাদের কাছে এখন সেন্ট জুলি বলে পরিচিতি পেয়েছেন। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সে সফরের সময় তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, দাবাবের অবস্থা যদি কিছুটা উন্নত বলা হয়, তাহলে সোমালিয়ার ভেতরের পরিস্থিতি কী? তাঁর সে উক্তির পর দুই বছর কেটে গেছে। সেই দাবাব ক্যাম্পে এখন প্রতিদিন সোমালিয়া থেকে ছুটে আসছে দেড় হাজার মানুষ প্রাণে বাঁচাতে। ক্যাম্পে আসার পথে মৃত্যুবরণ করছে ক্ষুধায় কাতর পুষ্টিহীন মা ও শিশু। ৫০ স্কয়ার মাইলের দাবাব ক্যাম্পে এখন চার লক্ষাধিক মানুষ রয়েছে। যেখানে ৯০ হাজার শরণার্থীর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সোমালিয়া ও কেনিয়ার পূর্বাঞ্চলে চলছে প্রচণ্ড খরা। ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, কেনিয়া, জিবুতি, সুদান ও সোমালিয়ায় ভয়ানক খরা দেখা দিয়েছে। এ অঞ্চলকে ডাকা হয় হর্ন অব আফ্রিকা নামে। মানুষ ও গবাদিপশুর কোনো খাবার অবশিষ্ট নেই। মায়ের কোলে হাড়সর্বস্ব শিশু প্রাণ দিচ্ছে। নিষ্ঠুর পরিস্থিতি কাকে বলে! দাবাব ক্যাম্পে আসতে গিয়ে সোমালিয়ার আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন আল শাবাব অধ্যুষিত এলাকা পার হওয়ার সময় কয়েক সপ্তাহ ধরে না খেয়ে থাকা মৃত্যুমুখে পতিত নারীরা গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কারণ আল শাবাব তাদের অর্থাৎ অমুসলমানদের খাবার নিতে দেবে না! অন্যদিকে কেনিয়ার ভেতরে দাবাব ক্যাম্পের বিস্তার নিয়ে সন্দেহ ঢুকে গেছে। অতিমাত্রায় জাতীয়তাবাদীরা ভাবছেন, আবার বুঝি ভালো মানুষির আড়ালে কেনিয়া হাতছাড়া হয়ে যায়!
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা কেনিয়ার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ফিরে গেছেন ওয়াশিংটন। তাঁরা শরণার্থী ক্যাম্পও পরিদর্শন করেছেন। তাঁদের সফরসঙ্গী ছিলেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্ত্রী জিল বাইডেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ সহকারী গেইল স্মিথ বলেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় দাতা দেশ। আমরা ৬৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য (নতুন ঘোষিত ১০৫ মিলিয়ন ডলারসহ) দিয়েছি। আমরা আমাদের ত্রাণ সরবরাহ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। কিন্তু যে মাত্রায় সংকট দেখা দিয়েছে, তা আমরা একা মোকাবিলা করতে পারব না। আমাদের সঙ্গে অন্যান্য দেশকেও এগিয়ে আসতে হবে।' তিনি বলেছেন, 'সত্যি কথা বলতে কি, এখন নগদ অর্থের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।'
এ কান্নাকাটির প্রয়োজন হচ্ছে কেন_সেটাই প্রশ্ন। বিশ্বমন্দার গল্প শুনিয়ে, ইমার্জিং ইন্ডিয়া-চায়নার গল্পে বিভোর ইউরোপ দ্রুতই হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। কোটি কোটি ডলার বাজেটের দেশগুলো সামান্য বেকারত্বে অস্থির হয়ে উঠছে। জুলাই মাসে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল গিয়েছিলেন দুর্ভিক্ষপীড়িত আফ্রিকায়। তিনি সাহায্য হিসেবে ১২ মিলিয়ন মানুষের জন্য মাত্র ১.৪ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্রিটেনে ২০০৪ সালের সুনামির সময় সাহায্য (ডোনেশন) উঠেছিল ৩৯৬ মিলিয়ন পাউন্ড, হাইতিতে ভূমিকম্পের সাহায্য উঠেছিল ১০৬ মিলিয়ন পাউন্ড এবং পাকিস্তানের প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য উঠেছে ৭১ মিলিয়ন পাউন্ড। কিন্তু হর্ন অব আফ্রিকার এতবড় মৃত্যুমুখী জনপদের জন্য এখন পর্যন্ত উঠেছে ৪৫ মিলিয়ন ডলার, যা ডিজাস্টার ইমার্জেন্সি কমিটির হাতে পেঁৗছেছে।
সত্যিই হিসাব মেলানো দায়। আফ্রিকায় এখন এক কোটি ২০ লাখ লোকের খাদ্যের সংকট রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চোখের সামনে এভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটছে, অথচ ট্রিলিয়ন ডলার হিসাবের বাজেটের দেশ যুক্তরাষ্ট্র বলছে, একা পারব না! ১৯৭১ সালে তৎকালীন দরিদ্র ভারত বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাবার দিয়েছিল মাসের পর মাস। তাতে ভারতের অর্থনীতির ওপর কতটাই বা চাপ পড়েছিল? ভারত কি সামলে নেয়নি? নিয়েছিল। কারণ ভারতের তখন সত্যিকার অর্থে এ দায় নেওয়ার মানসিকতা ছিল।
অমর্ত্য সেন মনে করেন, আধুনিক অর্থনীতিতে দুর্ভিক্ষ মানুষের তৈরি। অনাবৃষ্টি, খরার কারণে এখন কোথাও দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। হর্ন অব আফ্রিকার বর্তমান দুর্ভিক্ষ অমর্ত্য সেনের কথারই অকাট্য প্রমাণ।
অনেক খেলা আফ্রিকাজুড়ে। কিছু বুঝতে পারি না। সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে ৯ হাজার শক্তিশালী, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী রয়েছে। কিন্তু তার পরও মোগাদিসু আল শাবাবের হাত থেকে নিরাপদ নয়। আফগানিস্তানে যে আল-কায়েদাকে উৎখাত করেছে আমেরিকা, তার এক হাজার ভাগের এক ভাগ ক্ষমতা আল শাবাবের নেই। কেন আল শাবাবের অস্তিত্ব বিলোপ করা হচ্ছে না, এটা কি একটি রহস্য নয়? পশ্চিমারা মনে করছে, অথবা সত্যিই দেখা যাচ্ছে যে চীন হর্ন অব আফ্রিকার জমি দীর্ঘমেয়াদি লিজের মাধ্যমে হস্তগত করছে। পশ্চিমাদের কেউ কেউ আবার দুর্ভিক্ষের জন্য চীন দায়ী বলে উচ্চ কণ্ঠে বলতে শুরু করেছে। এতবড় পলিটিকস কী ক্ষুধার্ত ক্যাম্পের দিকে একটু খাবারের আশায় ছুটতে ছুটতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরা মানুষগুলো বোঝে?
ইরাকের কবি মুহাম্মদ মাহদি আল জাওয়াহিরিকে আমি আরবের ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বলে ভাবি। জাওয়াহিরির একটি কবিতার কয়েকটি চরণ আফ্রিকার ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য প্রযোজ্য_
ঘুমাও, হে ক্ষুধার্ত মানুষ, ঘুমাও
খাবারের দেবতারা তোমাদের দিকে নজর রাখছেন
যদি জেগে তৃপ্ত হতে না পার
তবে ঘুমই তোমাকে তৃপ্ত করবে
প্রতিশ্রুত মাখনের মতো নরম কল্পনা নিয়ে ঘুমাও
মধুর মতো মিষ্টি কথামালা নিয়ে ঘুমাও
ঘুমিয়েই তোমার স্বাস্থ্য উপভোগ কর...
(ইংরেজি থেকে নিবন্ধকারের অনূদিত)
বলার অপেক্ষা রাখে না, উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার মানুষদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ শিক্ষা বঞ্চনা এবং ধর্মীয় কুসংস্কার। যে কারণে দেশি ও বিদেশি শক্তি তাদের বুভুক্ষু অবস্থায় 'হত্যা' করছে। বাংলাদেশও এ দুই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়। ভয় হয়, আফ্রিকার এ পরিণতি একদিন বাংলাদেশে আসবে না, তার গ্যারান্টি কী?
লেখক : সাংবাদিক, mohshinhabib@yahoo.com
No comments