ধর্ম- আর্তমানবতার সেবাই মানবধর্ম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ঋতুর পালাবদল ঘটে। কিন্তু কখনো কখনো প্রকৃতির বৈরী আচরণ মানুষের অসহায়ত্বকে আরও প্রকট করে তোলে। হিমেল হাওয়া ও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য হতদরিদ্র অনেক মানুষের নেই ন্যূনতম শীতবস্ত্র, নেই উপযুক্ত আশ্রয় বা বাসস্থান। হাড়কাঁপানো শীতে তাদের কাউকে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হয়। ছিন্নমূল অসহায় মানুষকে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত মোকাবিলা করার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালাতে দেখা যায়। তাই তো পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টিজগতের ওপর সমানভাবে দয়া প্রদর্শন করতে বলেছেন। যার অন্তরে দয়ামায়া আছে, যে পরোপকারী, তিনি তাকে ভালোবাসেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, আর্তমানবতা ও রুগ্ণ ব্যক্তির সেবা করো এবং বন্দীকে মুক্ত করো অথবা ঋণের দায়ে আবদ্ধ ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করো।’ (বুখারি)
চলমান তীব্র শীতের প্রকোপে দুঃখপীড়িত অভাবী শীতার্ত মানুষের প্রতি সমাজের সামর্থ্যবান ও বিত্তশালীদের সাহায্য ও সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করা অতীব প্রয়োজন। সর্বাপেক্ষা অধিক দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণে শীতবস্ত্র সরবরাহ করে তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো। নিঃস্বার্থভাবে শীতার্ত মানুষকে সাহায্য ও আর্তমানবতার সেবা করাই মানবধর্ম। এমন মহৎ ও পুণ্যময় কাজই সর্বোত্তম ইবাদত। অসহায় মানুষের দুর্দিনে সাহায্য, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মনমানসিকতা যাদের নেই, তাদের ইবাদত বন্দেগি আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। সুতরাং নামাজ, রোজার সঙ্গে জনকল্যাণের তথা মানবিকতা ও নৈতিকতার গুণাবলি অর্জন করাও জরুরি। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সব কিতাব এবং নবীদের প্রতি ইমান আনয়ন করলে এবং আল্লাহর প্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, পর্যটক, সাহায্যপ্রার্থীদের এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থদান করলে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করলে ও জাকাত প্রদান করলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে, অর্থসংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৭)
শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য অসহায় দরিদ্র মানুষের অনেক শীতবস্ত্রের প্রয়োজন। শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে সুচিকিৎসা ও ওষুধপত্র এবং শীত মোকাবিলায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। এ জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দলমত-নির্বিশেষে বিত্তবানদের শীতার্ত বস্ত্রহীন মানুষের পাশে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। নবী করিম (সা.) পরকালীন পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা ঘোষণা করেছেন, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাপড় দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের পোশাক দান করবেন। ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুস্বাদু ফল দান করবেন। কোনো মুসলমানকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি পান করালে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সিলমোহরকৃত পাত্র থেকে পবিত্র পানি পান করাবেন।’ (আবু দাউদ)
তীব্র শীত নিবারণে দুর্গত অঞ্চলে শীতবস্ত্র বা গরম কাপড়, ওষুধপত্র সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। দুর্যোগময় মুহূর্তে করণীয় হলো মনপ্রাণ খুলে আর্তমানবতার সেবায় সাহায্যের হাত বাড়ানো; খাদ্য, ওষুধ, পথ্য, শীতবস্ত্র ও জরুরি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বিপদগ্রস্ত দুর্গত মানুষের পাশে যাওয়া এবং দুস্থ মানবতার সেবার মতো শ্রেষ্ঠ কর্মে অগ্রসর হওয়া। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক দিয়ে আল্লাহ তাআলা মানুষের ইমানের দৃঢ়তা পরীক্ষা করেন, আর দেখেন, বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের জন্য কারা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে, আমি সেগুলোকে এর শোভা করেছি মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ।’ (সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ৭)
যারা শীতজনিত রোগব্যাধিতে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে ভুগছে, তাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ওষুধপত্র ও সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা একান্ত প্রয়োজন। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, সেদিন (রোজ কিয়ামতের দিন) তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’
অতএব, প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষেরই পারস্পরিক মানবতাবোধ ও উদার মনমানসিকতা থাকা অপরিহার্য। সব মানুষের উচিত সমগ্র সৃষ্টির প্রতি দয়ামায়া, অকৃত্রিম ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতি বজায় রাখা। তাই দেশের সর্বস্তরের ধনাঢ্য, বিত্তবান, শিল্পপতি ব্যবসায়ী যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা চলতি শীতের মৌসুমে শীতার্ত, গরিব, অসহায়, দুঃখী মানুষকে যাঁর যাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন বা পুরোনো কিছু শীতবস্ত্র দিয়ে অকাতরে সাহায্য করুন। এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে মানবজাতিকে প্রাণ দিয়ে যেন আমরা সম্মান-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতে পারি; বিপদে-আপদে প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সাহায্যের হাত বাড়াতে সক্ষম হই এবং পৃথিবীর কোনো মানুষকে অবহেলা বা অবজ্ঞা না করি। কোনো ধর্ম, জাত, কুল বা বংশ নয়; মানুষ নামের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টজীব ‘আশরাফুল মাখলুকাত’কে যেন হূদয় ও মনপ্রাণ দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা ও আর্তমানবতার সেবায় পরম সহানুভূতিতে এগিয়ে আসতে সমর্থ হই, আল্লাহ তাআলা সমাজের বিত্তশালী ও সামর্থ্যবানদের এ তওফিক দান করুন!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.