পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক ছবি
আমরা যেমন দুই চোখ দিয়ে আকাশ দেখি তেমনি আকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখছে জার্মানির দুটি স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ। তারা পৃথিবীর উপরিভাগের থ্রিডি, মানে ত্রিমাত্রিক ছবি তুলছে।
২০০৭ সালে জার্মানি ‘টেরাসার-এক্স’ নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায়। এর তিন বছর পর মহাকাশে যায় ‘ট্যানডেম-এক্স’ নামের আরেকটি স্যাটেলাইট । এদের কাজ হচ্ছে পৃথিবীর উপরিভাগের ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা।সেই কাজটাই তারা করে যাচ্ছে নিষ্ঠার সঙ্গে। আর তাদের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করছেন জার্মান বিজ্ঞানীরা। আগামী বছরের শেষ নাগাদ পুরো কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্যাটেলাইট দুটির আকার অনেকটা প্রাইভেট কারের মতো। তাদের প্রত্যেকটির সঙ্গে রাডার লাগানো আছে। ফলে সূক্ষভাবে কাজ করতে পারছে স্যাটেলাইট দুটি। পৃথিবী থেকে প্রায় পাঁচ শ’ কিলোমিটার উপরে তাদের অবস্থান । তবে নিজেদের মধ্যে কয়েক শ’ মিটারের দূরত্ব রয়েছে। স্যাটেলাইট দুটি তৈরি করেছে ‘অ্যাসট্রিয়াম’ কোম্পানি, যেটি ‘ইউরোপিয়ান অ্যারোনটিক ডিফেন্স এ্যান্ড স্পেস কোম্পানি’ ইএডিএস-এর একটি অঙ্গসংস্থা । স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো তথ্যগুলো বিশ্লেষণের কাজ চলছে জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মিউনিখের কাছে অবস্থিত ‘জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার’ ডিএলআর-এর কার্যালয়ে।
ডিএলআর সংস্থার ‘ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এ্যান্ড রাডার সিস্টেমস’-এর পরিচালক আলবার্তো মোরাইরা বলছেন, ‘‘দুটি স্যাটেলাইট আলাদাভাবে তথ্য পাঠিয়ে থাকে। পরে সেগুলোকে এক করে বিশ্লেষণ করা হয়।’’ তিনি বলেন, স্যাটেলাইট দুটো যেন কখনও একসঙ্গে হয়ে না যায় সেই প্রযুক্তি বের করা হয়েছে যে প্রযুক্তিতে এর আগে কাজ করেনি কেউ। পৃথিবীর উপরিভাগের আয়তন প্রায় দেড় শ’ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। এ পর্যন্ত দুই বার এই পুরো এলাকার ছবি পাঠিয়েছে স্যাটেলাইট দুটো, বলছেন ট্যানডেম-এক্স এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মানফ্রেড সিংক । তবে পাহাড়ি এলাকার ছবি পাঠাতে সময় লাগবে আরও ছয়মাস। স্যাটেলাইটগুলোর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাসট্রিয়ামের ‘আর্থ অবজারভেশন এ্যান্ড সায়েন্স’ বিভাগের পরিচালক একার্ড জেটেলমায়ার বলছেন, স্যাটেলাইটের সঙ্গে রাডার লাগানোর কারণে অনেক সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে আকাশ পরিষ্কার থাকুক কিংবা মেঘে ঢাকা, দিনের আলো থাকুক কিংবা অন্ধকার যে কোন সময়ই ছবি তুলতে পারছে স্যাটেলাইটগুলো এবং সেটা হচ্ছে বেশ নিখুঁত। জেটেলমায়ার বলছেন, রাডারবিহীন পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইটগুলো রাতের অন্ধকার বা কুয়াশায় কাজ করতে পারে না। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যে তথ্য বা ছবি পাওয়া যাচ্ছে তা আগের যেকোনো গবেষণার চেয়ে নিখুঁত বলে দাবি প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীদের। এছাড়া এবার পুরো পৃথিবীর ছবি তোলা হচ্ছে।
এ ধরনের কাজ এর আগে করেছেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা । কিন্তু ২০০০ সালে শেষ হওয়া ‘শাটল রাডার টোপোগ্রাফি মিশন’ বা এসআরটিএম প্রকল্পের আওতায় সমগ্র পৃথিবীর মাত্র ৬০ ভাগের ছবি পাওয়া গেছে তাছাড়া। ছবির মানও ততটা ভাল ছিল না। রোবোট-ক্যামেরা দিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে গবেষণা সংক্রান্ত প্রকল্পে ডিএলআর এবং অ্যাস্ট্রিয়াম সহযোগিতা করছে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি বা তথ্যগুলো প্রথমে জমা হচ্ছে সুইডেন, ক্যানাডা ও অ্যান্টার্কটিকায় থাকা প্রকল্পের স্টেশনগুলোতে। সেখান থেকে যাচাইবাছাই হয়ে তথ্য যাচ্ছে জার্মানির মিউনিখে অবস্থিত প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ে? বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সব কাজ শেষে যে তথ্য পাওয়া যাবে তার পরিমাণ হতে পারে প্রায় ১৫ টেরাবাইট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই যে এত গবেষণা, এর থেকে যে ফল পাওয়া যাবে তা আসলে কি কাজে লাগবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন পৃথিবীর উপরিভাগের ত্রিমাত্রিক ছবি দিয়ে নগর পরিকল্পনা, নেভিগেশন, বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন লাইন বসানো, তেল, গ্যাস অনুসন্ধান, এমনকি দুর্গত এলাকায় উদ্ধারকাজের পরিকল্পনা করা যাবে।
এছাড়া ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা ও আগ্নেয়গিরি রয়েছে এমন অঞ্চলের সন্ধান পেতে কাজে লাগবে এই ত্রিমাত্রিক তথ্য।
ট্যানডেম-এক্স এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মানফ্রেড সিংক বলছেন, পৃথিবীকে নতুন করে দেখাতে শেখাবে ত্রিমাত্রিক এই ছবিগুলো। এই গবেষণা প্রকল্পের বাণিজ্যিক সফলতার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এতটাই আশাবাদী যে, স্যাটেলাইট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাসট্রিয়াম ২০০ মিলিয়ন ইউরোর এই প্রকল্পে এক-চতুর্থাংশ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে রাডার থেকে পাওয়া তথ্যগুলোর লাইসেন্সের মালিক হবে অ্যাসট্রিয়াম।
জুবায়ের আব্দুল বারি
No comments