আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগের বিধান রাখতে অটল সরকার- সরকারী কর্মচারী আইন তবে ঢালাও না করে বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা রাখা হতে পারে
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের বিধান রেখে সরকারী কর্মচারী আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে সরকার। তবে ঢালাও না করে বিশেষ ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা রাখা হতে পারে।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম স্পষ্ট করে বলেছেন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা উচিত। তিনি বলেন, দ্রুত এই আইনটি প্রণয়ন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গহর রিজভীও বলেছেন, কিছুটা পরিবর্তন করে হলেও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের বিধান রাখতে হবে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর এক অভিজাত হোটেলে আয়োজিত সরকারী কর্মচারী আইন-২০১২ এর খসড়ার ওপর এক মতবিনিময় সভায় তাঁরা এ কথা বলেন।সকল ১১টায় শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্যাডারসহ মোট ২৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী বক্তব্য রাখেন। সকলের বক্তব্যে আইনটির ৫(ক) ধারার আউটসোর্সিং বাতিলের দাবি তুলে ধরা হয়। এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের বিধানটি থাকা ঠিক হবে না। ভবিষ্যতে এই ধারাটির অপপ্রয়োগ হতে পারে। তিনি বলেন, এটি নিয়ে এখনই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি কোন কোন কর্মকর্তা বলেন, কোন তফসিল পদে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ বাতিল করতে হবে। শুধু কর্মকর্তারা নয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পক্ষ থেকেও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার বিধান বাতিলের দাবি জানানো হয়। অনুষ্ঠানটি চলে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেন, যতদিন পর্যন্ত দেশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর চলতে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আউটসোর্সিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হবে। কোন বিষয়ে সরকারের যদি বিশেষজ্ঞ না থাকে সে ক্ষেত্রে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার। তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের সম্ভব্যতা যাচাইয়ে আসে বিশেষজ্ঞরা।
সভায় বক্তারা বলেন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধাকোটা অনুসরণ করা উচিত। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা প্রথা বাতিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, কোটার মাধ্যমে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনতে হবে। সে লক্ষ্যে কোটা প্রথা রাখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, মেধার কোন বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে শুধু মেধাভিত্তিক সব কিছু হওয়া ঠিক নয়। পিএসসির পরীক্ষায় একবার মেধা কোটায় বিশেষ স্থান দখল করলেই সব কিছু হয় না। এ ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতারও প্রয়োজন আছে। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে মেধা তালিকায় অনেক এগিয়ে থেকেও কাজের ক্ষেত্রে ধীর গতি সম্পন্ন। অথচ সেখানে প্রয়োজন রয়েছে সঠিকভাবে দ্রুত গতিতে কাজ করার। তাই শুধু জ্যেষ্ঠতা নয়, অন্যান্য বিষয়েও বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি বলেন, চাকরিতে অবশ্যই ‘টার্ম এ্যান্ড কন্ডিশন’ রয়েছে। এটি কী পরিমাণ পূরণ হলো তার ভিত্তিতে পদোন্নতির বিষয়টি মূল্যায়ন করতে হবে। এ ছাড়াও রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত্যতা কেমন তাও দেখতে হবে। অনেক কর্মকর্তা আছেন তাদের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যতা নেই। এসব বিষয়ে মাথায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, জ্যেষ্ঠতা বিষয়টি অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে এর পাশাপাশি দক্ষতা, সততা, দায়িত্বপালনের দক্ষতা ও আগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ও দেখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। পদোন্নতির ক্ষেত্রে এটিও বিবেচনায় আনতে হবে। সরকারের ভেতরে থেকে অনেকেই বাইরের কোন কিছু খবর রাখে না। বেসরকারী (করপোরেট) অফিসে কীভাবে কাজ হয়। এ ক্ষেত্রে সিনিয়রিটিই বড় নয়। ভাল কাজ করলে তাদের মূল্যায়ন অন্যভাবে হয়। সেখানে যার কাজের জন্য সে নিজেই দায়ী থাকেন। কাজের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। তিনি বলেন, চাকরির শুরুতে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অযোগ্য বিবেচিত হলে তাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হবে।
উপদেষ্টার এই বক্তব্যের সময় জনপ্রশাসন সচিব আবদুস সোবহান সিকদার বলেন, এই ধারাটির ওপর অনেকেই আপত্তি করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে এইচটি ইমাম বলেন, এটি নিয়ে কারও কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, কার আপত্তি আছে? এ সময় কয়েক সেকেন্ড সকলে নীরব থাকলেও বিভিন্ন স্থানে বসা কয়েকজন একসঙ্গে বলে ওঠেন, এটি অপপ্রয়োগ হবে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের সুযোগ তৈরি হবে। তখন উপদেষ্টা বলেন, এটা পুলিশের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। হাবিলদারকে খুশি না করলে ফেল করিয়ে দেয়। কিন্তু সিভিল সার্ভিসে এটি হবে না। বলার সঙ্গে সঙ্গে হলভর্তি সকলে হেসে ওঠেন। পরে তিনি বলেন, চাকরিতে প্রবেশের পর বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে যে অযোগ্য হবে সে চাকরিতেও অযোগ্য হবে।
প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গহর রিজভী বলেন, সকলের বক্তব্যে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছি যে আইনটি করতে হবে। তিনি বলেন, আউটসোর্সিং বিষয়ে সকলের সেন্টিমেন্টের সঙ্গে আমিও একমত। তবে যেভাবেই হোক আউটসোর্সিংয়ের বিষয়টি রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিভাবে এটি রাখা যায় তা সবাইকে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে এটি রাখার বিষয়ে তিনি মত দেন।
বক্তব্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, আইনটির ৫(খ) ধারায় বর্ণিত আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের বিধানটি বাতিল করতে হবে। আইনের এই ধারাটিতে বলা হয়েছে, ‘সরকার প্রয়োজন মনে করলে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট, শ্রেণী, প্রকৃতি বা কর্মের সেবা সম্পূর্ণ বা আংশিক নিতে পারবে এবং কোন নির্দিষ্ট শ্রেণী বা শ্রেণীর কর্ম পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করতে পারবে; তবে নিজ শ্রেণীর কর্ম বিলুপ্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে কর্মের যোগ্যতা এবং পদ খালি থাকা সাপেক্ষে অন্য কোন বিভাগে সমমানের পদে স্থানান্তর বা যোগ্যতা থাকলে পদ খালি থাকা সাপেক্ষে পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চতর শ্রেণীতে পদোন্নতির সুযোগ দিতে হবে অথবা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করে তার কর্মাবসান করতে হবে।’ শহীদ খান বলেন, সরকার প্রয়োজন মনে করলে ‘কনসালট্যান্ট’ হিসেবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়োগ দিতে পারে। তিনি বলেন, ’৭৯-এর কালো আইন অবশ্যই বাতিল হওয়া দরকার। আইনের বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে নির্ধারিত না রেখে সরকার প্রয়োজনে বিধি প্রণয়ন করার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা বিষয়ে তিনি মত দেন। জনপ্রশাসন সচিব তাঁর এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করে বলেন, শহীদ সাহেব এটি খুব ভাল প্রস্তাব করেছেন।
এ ছাড়া পে-স্কেল নিয়ে আলোচনা হয়। প্রায় সব বক্তাই এ বিষয়ে মত প্রকাশ করেন। আইন বলা আছে পেকমিশন প্রতি তিন বছর পর পর বাজার মূল্য বিবেচনায় নিয়ে একটি সুপারিশ পেশ করবে। সরকার এই সুপারিশ আমলে নেবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাডার কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিবছর মূল্যস্ফীতির হিসেব অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন সমতা করা প্রয়োজন। তা না হলে নির্ধারিত আয়ের এই সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিমশিম খেতে হয়। সভায় বক্তারা ৮ ও ৯ ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া আইনের ৬(ক), ৭(গ), ১০, ১১(ক), ১২(খ), ১৬(খ) ও (চ), ১৭(খ) ও (গ), এবং ১৮(খ) ধারা আংশিক সংশোধনের প্রস্তাব করেন।
জনপ্রশাসন সচিব আবদুস সোবহান সিকদার বলেন, সিভিল সার্ভিস এ্যাক্ট হিসেবে অনেক সভা করা হয়েছে। আজকে এই আলোচনায় সকল ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, অনেকে বলছেন, এই আইনটি হবে না, এটি সঠিক নয়। বর্তমান সরকারের আমলে অনেক আইন হয়েছে। এ ছাড়া স্বাধীনতার ৪০ বছর পর মহাজোট সরকার এই আইনটি করার উদ্যোগ নিয়েছে। অতীতে অন্য কোন রাজনৈতিক সরকার এটি করার প্রয়োজন মনে করেনি। তিনি বলেন, আশা করি খুব শীঘ্রই আইনটি আমরা মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য পাঠাতে পারব।
No comments