অক্সফোর্ডশায়ারে কয়েক দিন by ড. জাকিয়া বেগম
যুক্তরাজ্যের প্রশাসনিক বিভাগ (কাউন্টি) ‘অক্সফোর্ডশায়ার’ লন্ডন থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এই এলাকার দক্ষিণ দিক থেকে প্রবাহিত ‘টেমস্’ নদী ও উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত ‘চারওয়েল’ নদী অক্সফোর্ড শহরের কেন্দ্রস্থলে এসে যুক্ত হয়েছে। মূল্যবান কৃষিজমির প্রাচুর্য ঐতিহাসিকভাবেই এলাকাটিকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। বিশেষ করে এলাকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত প্রায় ৯০ মাইল দীর্ঘ এবং ২৫ মাইল চওড়া ‘কট্ওল্ডস্’ পাহাড়ী বনাঞ্চলের কারণে ১৩ শতাব্দীর দিক থেকেই এলাকাটি ‘উল’ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে সম্পদশালী হয়ে ওঠে। ১৯১২ সালে অক্সফোর্ডে বিখ্যাত মোটরযান কারখানা ‘মরিস মটরস্’ গড়ে তোলার পর এলাকার বেশিরভাগ লোক কারখানার কাজে উৎসাহী হয়ে উঠলে কৃষিকাজে মন্দাভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে।
এই বিভাগের প্রধান জেলা শহর অক্সফোর্ড। বিশ্বের অন্যতম বিদ্যাপীঠ বলে খ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১০৯৬ সালে এই শহরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ‘তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ’ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে এই শহরটিতে যাওয়া ও অবস্থান করার এবং বেশ কয়েকমাস থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। পুরাতন এই শহরটির গোড়াপত্তন কবে হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও ৯১২ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কবাসীরা শহরটি দখল করে নিয়েছিল বলে জানা যায়। ৫ থেকে ৬ শতকের দিকে জার্মানদের অনুপ্রবেশ ঘটে শহরটিতে। আর ১২ শতক থেকে এটি জ্ঞানের বিদ্যাপীঠ এবং প-িত ব্যক্তিদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে বাণিজ্যিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।
যুক্তরাজ্য তথা বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টি ছাড়াও এই শহরটির ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অনবদ্য স্থাপত্য শৈলীর পুরাতন ও নতুন স্থাপনার নিদর্শন আজও পর্যটকদেরকে আকর্ষণ করে চলেছে। আকর্ষণীয় সব জাদুঘর এবং শিল্পকর্মপূর্ণ গ্যালারি ছাড়া বিনোদন ও বিশ্রামের জন্য এই শহরে আছে বেশ কতকগুলো পার্ক, বাগান এবং উন্মুক্ত স্থান।
বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই যেন শহরটির বিস্তৃতি ঘটেছে। কেন্দ্রটি বেশ ছোট এবং সহজেই ঘুরে দেখা যায়। প্রধান রেলস্টেশন এবং বাসস্টেশন হাঁটার দূরত্বে অবস্থিত। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির বড় একটি পার্থক্য হচ্ছে এটির প্রধান ভবন বলে কিছু নেই। শহরটির কেন্দ্রে ৩৮টি কলেজ নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ স্থাপনাগুলোর কোনটি ১৩ শতকে নির্মিত কোনটি আবার কয়েক যুগ আগের। সবক’টি কলেজের অবস্থানই হাঁটার দূরত্বের মধ্যে। প্রায় প্রত্যেকটি স্থাপনার নিজস্ব স্থাপত্য শৈলীর বৈশিষ্ট্যতা ছাড়াও প্রায় প্রত্যেকটির সম্মুখে ঘন সবুজ ঘাস যেন কার্পেটের ন্যায় বিছিয়ে রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদৃশ্যপূর্ণ স্থাপনাগুলো যেন একই ঐক্যতানে বাঁধা পড়ে আছে। আর তাই কবি ম্যাথু আরনল্ড মুগ্ধ হয়ে এই শহরকে ‘স্বপ্নের চূড়াবিশিষ্ট শহর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই পৃথিবীর প্রায় ১৮০টি দেশ থেকে আগত। ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে পড়াশুনা করা ছাড়াও পায় বিশ্বমানের গবেষণার সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়টির আছে নিজস্ব বেশ কয়েকটি জাদুঘর, নাট্যশালা, উপাসনালয়, পার্ক ইত্যাদি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম স্বনামধন্য কলেজ হচ্ছে ‘ক্রাইস্ট চার্চ। এই কলেজের ঐতিহ্যের ধারক ‘টম টাওয়ার’ এবং গির্জার সুউচ্চ চূড়া। স্থাপনা সংলগ্ন সবুজ মাঠে হয়ত দেখা যাবে কিছু গবাদিপশু বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। চত্বরের প্রতিটি স্থাপনা, ফটক, জানালা ও আঙ্গিনায় ৫০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের দীপ্তিময় প্রকাশ ঘটে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ছোট উপাসানালয়টিতে প্রতি সন্ধ্যায় গানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন সিনেমার আকর্ষণীয় সব দৃশ্য ধারণের জন্যও এই কলেজটির কোন কোন স্থাপনা ব্যবহার করা হয় যেমন ‘হ্যারি পটার’ সিনেমায় এখানকার ‘ডাইনিং হল’টি ব্যবহার করা হয়। এরূপ প্রায় প্রতিটি কলেজের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্যও আছে। কোনটির ধার ঘেঁষে বয়ে চলেছে নদী, কোনটি আবার গাছের ঘন ছায়ায় ঘেরা। প্রধান সড়ক সংলগ্ন ‘ম্যাগডালেন’ কলেজের সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত সুউচ্চ টাওয়ার আর লেডি ম্যাগডালিনের ভাস্কর্যবিশিষ্ট ফটক কলেজটির গৌরবান্বিত ইতিহাস প্রকাশ করে চলেছে। স্থাপনাসংলগ্ন হরিণের পার্কটিও বেশ আকর্ষণীয়। চারওয়েল নদীর তীরে স্থাপিত ‘সেন্ট হিলডা’ কলেজ থেকে নদীর সৌন্দর্য খুবই উপভোগ্য, বাগানবেষ্টিত এডমান্ড হলের ভূগর্ভস্থ কক্ষ ঘুরে দেখার সময় মনে হয় যেন কোন এক অচিনপুরীতে ঢুকে গেছি, জেসাস কলেজের দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা লতাগুল্মের ফুলেল সৌন্দর্য ভাললাগার ছোঁয়ায় মন ভরিয়ে দেয়। ঐতিহ্যপূর্ণ এসব স্থাপনার সুনিপুণ স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্যতা অক্ষুণœ রেখে বিশ্ববিদ্যালয়টির সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা সংযোজন করা হয়েছে যার আকর্ষণ বলে শেষ করার নয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অনুপ্রবেশ অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার অনুমতি দেয়া হয়।
২৩ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ‘কারফ্যাক্স টাওয়ার’টিকে শহরের কেন্দ্র বলে বিবেচনা করা হয়। ৯৯ ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে ওঠা গেলে এখান থেকে এক নজরে শহরের কেন্দ্র অনেকটাই দৃষ্টিগোচর হয়। ১৩ শতাব্দীতে স্থাপিত সেন্ট মারটিনস্ চার্চের ধ্বংসাবশেষ এই টাওয়ারটি। টাওয়ারের পূর্ব দিকের ঘড়ি থেকে দু’জন যান্ত্রিক মানুষ প্রত্যেক ১৫ মিনিট পর পর ঘণ্টা ধ্বনি বাজিয়ে পুরনো শতাব্দীর আবহ সৃষ্টি করে চলেছে। ১৭ ও ১৮ শতকের স্থাপত্য শৈলী দ্বারা অলঙ্কৃত ‘ইউনিভার্সিটি চার্চ অব সেন্ট মারি দি ভার্জিন’-কে পুরনো এই বিশ্ববিদ্যালয়টির আধ্যাত্মিক আত্মা বলে অভিহিত করা হয় কারণ এখান থেকে প্রায় সাত শত বছর ধরে খিস্ট্রীয় ধর্মের প্রচারণা, আলোচনা, রাজনীতি এবং নৈতিকতাবোধ শিক্ষা দেয়ার কার্যক্রম পরিচালিত হতো এবং এটিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃতি ঘটে। কেন্দ্রের প্রধান সড়ক থেকে পূর্ব দিকে অবস্থিত এই স্থাপনার চতুর্দিক বিশ্ববিদ্যালয়র এবং কলেজগুলো দ্বারা বেষ্টিত। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকা- এখান থেকে পরিচালিত হয়। এই চার্চটির পূর্ব দিকে ‘র্যাডক্লিফ স্কোয়ার’-টি অবস্থিত।
‘র্যাডক্লিফ স্কোয়ার’ চত্বরটিও চতুর্দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন দ্বারা বেষ্টিত। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত এই চত্বরের মাঝখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ স্থাপত্যবিদ্যার আদলে নির্মিত ‘র্যাডক্লিফ ক্যামেরা’-র অবস্থান যা আসলে গম্বুজ আকৃতির গোলাকার একটি স্থাপনা এবং ‘বোডলেইয়ান’ লাইব্রেরিরই একটি অংশ। বলা যায় এই দালানটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের ধারক। চত্বরের ঠিক উত্তরে ইউরোপের অন্যতম পুরনো তথা ইংল্যান্ডের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘বোডলেইয়ান লাইব্রেরি’-এর প্রধান দালানটির অবস্থান। এই দু’টি দালান মাটির নিচের এমন সুরঙ্গ পথ দ্বারা সংযুক্ত যে এখানেও বই রাখার ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে এই লাইব্রেরির বইয়ের তাকগুলোর দৈর্ঘ্য ১৭৬ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রায় ৬ লাখ এখানে বই সংরক্ষিত আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে অক্সফোর্ড শহরের কেন্দ্রে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি জাদুঘর। এরূপ ‘এ্যাশমোলিয়ান জাদুঘর’টি ইংল্যান্ড তথা বিশ্বের প্রাচীনতম একটি জাদুঘর। সেই ব্রোঞ্জ সভ্যতা থেকে শুরু“করে প্রাচীন গ্রীক এবং মিসরীয় আমলের ধাতব মুদ্রা, পুস্তক, খোদাই-কর্ম, মৃৎশিল্প, ভূ-তাত্ত্বিক ও প্রাণীবিদ্যা বিষয়ক বহু নমুনা, লিওনার্দো-দ্যা ভিঞ্চি, পিকাশোসহ বিশ্ববিখ্যাত সব শিল্পীর চিত্রকর্মসহ প্রায় চার সহস্রাব্দ আগের বহু বিরল এবং প্রাচীন নিদর্শন এখানকার ভা-ারকে সমৃদ্ধশালী করে রেখেছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে গড়ে ওঠা ‘মিউজিয়াম অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স’ জাদুঘরটিকে বলা যায় বিশ্বের মধ্যে অদ্বিতীয় একটি জাদুঘর। মধ্যযুগ থেকে আরম্ভ করে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত বিজ্ঞানের পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতির ইতিহাসকে তুলে ধরছে এই জাদুঘরটি। এ সময়ের মধ্যে আবিষ্কৃত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ছাড়া ১৮ ও ১৯ শতকে তৈরি বিভিন্ন যন্ত্রপাতিরও বিরাট একটি সংগ্রহশালা এটি। ‘দি পিটস্ রিভার মিউজিয়াম’টি স্থাপন করা হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। বলা যায় এটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব এবং প্রতœতত্ত্ব বিষয়ক সংগ্রহশালা। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত প্রায় ১৮০০০টি নমুনা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এই সংখ্যা অর্ধ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এখানকার ছবি ও শব্দের সমন্বয়ে তৈরি ‘আর্কাইভ’টি পুরনো অনেক ঘটনাকে জীবন্ত করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে চলেছে।
(চলবে)
এই বিভাগের প্রধান জেলা শহর অক্সফোর্ড। বিশ্বের অন্যতম বিদ্যাপীঠ বলে খ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১০৯৬ সালে এই শহরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ‘তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ’ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে এই শহরটিতে যাওয়া ও অবস্থান করার এবং বেশ কয়েকমাস থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। পুরাতন এই শহরটির গোড়াপত্তন কবে হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও ৯১২ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কবাসীরা শহরটি দখল করে নিয়েছিল বলে জানা যায়। ৫ থেকে ৬ শতকের দিকে জার্মানদের অনুপ্রবেশ ঘটে শহরটিতে। আর ১২ শতক থেকে এটি জ্ঞানের বিদ্যাপীঠ এবং প-িত ব্যক্তিদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে বাণিজ্যিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।
যুক্তরাজ্য তথা বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টি ছাড়াও এই শহরটির ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অনবদ্য স্থাপত্য শৈলীর পুরাতন ও নতুন স্থাপনার নিদর্শন আজও পর্যটকদেরকে আকর্ষণ করে চলেছে। আকর্ষণীয় সব জাদুঘর এবং শিল্পকর্মপূর্ণ গ্যালারি ছাড়া বিনোদন ও বিশ্রামের জন্য এই শহরে আছে বেশ কতকগুলো পার্ক, বাগান এবং উন্মুক্ত স্থান।
বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই যেন শহরটির বিস্তৃতি ঘটেছে। কেন্দ্রটি বেশ ছোট এবং সহজেই ঘুরে দেখা যায়। প্রধান রেলস্টেশন এবং বাসস্টেশন হাঁটার দূরত্বে অবস্থিত। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির বড় একটি পার্থক্য হচ্ছে এটির প্রধান ভবন বলে কিছু নেই। শহরটির কেন্দ্রে ৩৮টি কলেজ নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ স্থাপনাগুলোর কোনটি ১৩ শতকে নির্মিত কোনটি আবার কয়েক যুগ আগের। সবক’টি কলেজের অবস্থানই হাঁটার দূরত্বের মধ্যে। প্রায় প্রত্যেকটি স্থাপনার নিজস্ব স্থাপত্য শৈলীর বৈশিষ্ট্যতা ছাড়াও প্রায় প্রত্যেকটির সম্মুখে ঘন সবুজ ঘাস যেন কার্পেটের ন্যায় বিছিয়ে রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদৃশ্যপূর্ণ স্থাপনাগুলো যেন একই ঐক্যতানে বাঁধা পড়ে আছে। আর তাই কবি ম্যাথু আরনল্ড মুগ্ধ হয়ে এই শহরকে ‘স্বপ্নের চূড়াবিশিষ্ট শহর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই পৃথিবীর প্রায় ১৮০টি দেশ থেকে আগত। ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে পড়াশুনা করা ছাড়াও পায় বিশ্বমানের গবেষণার সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়টির আছে নিজস্ব বেশ কয়েকটি জাদুঘর, নাট্যশালা, উপাসনালয়, পার্ক ইত্যাদি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম স্বনামধন্য কলেজ হচ্ছে ‘ক্রাইস্ট চার্চ। এই কলেজের ঐতিহ্যের ধারক ‘টম টাওয়ার’ এবং গির্জার সুউচ্চ চূড়া। স্থাপনা সংলগ্ন সবুজ মাঠে হয়ত দেখা যাবে কিছু গবাদিপশু বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। চত্বরের প্রতিটি স্থাপনা, ফটক, জানালা ও আঙ্গিনায় ৫০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের দীপ্তিময় প্রকাশ ঘটে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ছোট উপাসানালয়টিতে প্রতি সন্ধ্যায় গানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন সিনেমার আকর্ষণীয় সব দৃশ্য ধারণের জন্যও এই কলেজটির কোন কোন স্থাপনা ব্যবহার করা হয় যেমন ‘হ্যারি পটার’ সিনেমায় এখানকার ‘ডাইনিং হল’টি ব্যবহার করা হয়। এরূপ প্রায় প্রতিটি কলেজের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্যও আছে। কোনটির ধার ঘেঁষে বয়ে চলেছে নদী, কোনটি আবার গাছের ঘন ছায়ায় ঘেরা। প্রধান সড়ক সংলগ্ন ‘ম্যাগডালেন’ কলেজের সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত সুউচ্চ টাওয়ার আর লেডি ম্যাগডালিনের ভাস্কর্যবিশিষ্ট ফটক কলেজটির গৌরবান্বিত ইতিহাস প্রকাশ করে চলেছে। স্থাপনাসংলগ্ন হরিণের পার্কটিও বেশ আকর্ষণীয়। চারওয়েল নদীর তীরে স্থাপিত ‘সেন্ট হিলডা’ কলেজ থেকে নদীর সৌন্দর্য খুবই উপভোগ্য, বাগানবেষ্টিত এডমান্ড হলের ভূগর্ভস্থ কক্ষ ঘুরে দেখার সময় মনে হয় যেন কোন এক অচিনপুরীতে ঢুকে গেছি, জেসাস কলেজের দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা লতাগুল্মের ফুলেল সৌন্দর্য ভাললাগার ছোঁয়ায় মন ভরিয়ে দেয়। ঐতিহ্যপূর্ণ এসব স্থাপনার সুনিপুণ স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্যতা অক্ষুণœ রেখে বিশ্ববিদ্যালয়টির সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা সংযোজন করা হয়েছে যার আকর্ষণ বলে শেষ করার নয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অনুপ্রবেশ অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার অনুমতি দেয়া হয়।
২৩ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ‘কারফ্যাক্স টাওয়ার’টিকে শহরের কেন্দ্র বলে বিবেচনা করা হয়। ৯৯ ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে ওঠা গেলে এখান থেকে এক নজরে শহরের কেন্দ্র অনেকটাই দৃষ্টিগোচর হয়। ১৩ শতাব্দীতে স্থাপিত সেন্ট মারটিনস্ চার্চের ধ্বংসাবশেষ এই টাওয়ারটি। টাওয়ারের পূর্ব দিকের ঘড়ি থেকে দু’জন যান্ত্রিক মানুষ প্রত্যেক ১৫ মিনিট পর পর ঘণ্টা ধ্বনি বাজিয়ে পুরনো শতাব্দীর আবহ সৃষ্টি করে চলেছে। ১৭ ও ১৮ শতকের স্থাপত্য শৈলী দ্বারা অলঙ্কৃত ‘ইউনিভার্সিটি চার্চ অব সেন্ট মারি দি ভার্জিন’-কে পুরনো এই বিশ্ববিদ্যালয়টির আধ্যাত্মিক আত্মা বলে অভিহিত করা হয় কারণ এখান থেকে প্রায় সাত শত বছর ধরে খিস্ট্রীয় ধর্মের প্রচারণা, আলোচনা, রাজনীতি এবং নৈতিকতাবোধ শিক্ষা দেয়ার কার্যক্রম পরিচালিত হতো এবং এটিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃতি ঘটে। কেন্দ্রের প্রধান সড়ক থেকে পূর্ব দিকে অবস্থিত এই স্থাপনার চতুর্দিক বিশ্ববিদ্যালয়র এবং কলেজগুলো দ্বারা বেষ্টিত। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকা- এখান থেকে পরিচালিত হয়। এই চার্চটির পূর্ব দিকে ‘র্যাডক্লিফ স্কোয়ার’-টি অবস্থিত।
‘র্যাডক্লিফ স্কোয়ার’ চত্বরটিও চতুর্দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন দ্বারা বেষ্টিত। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত এই চত্বরের মাঝখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ স্থাপত্যবিদ্যার আদলে নির্মিত ‘র্যাডক্লিফ ক্যামেরা’-র অবস্থান যা আসলে গম্বুজ আকৃতির গোলাকার একটি স্থাপনা এবং ‘বোডলেইয়ান’ লাইব্রেরিরই একটি অংশ। বলা যায় এই দালানটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের ধারক। চত্বরের ঠিক উত্তরে ইউরোপের অন্যতম পুরনো তথা ইংল্যান্ডের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘বোডলেইয়ান লাইব্রেরি’-এর প্রধান দালানটির অবস্থান। এই দু’টি দালান মাটির নিচের এমন সুরঙ্গ পথ দ্বারা সংযুক্ত যে এখানেও বই রাখার ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে এই লাইব্রেরির বইয়ের তাকগুলোর দৈর্ঘ্য ১৭৬ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রায় ৬ লাখ এখানে বই সংরক্ষিত আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে অক্সফোর্ড শহরের কেন্দ্রে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি জাদুঘর। এরূপ ‘এ্যাশমোলিয়ান জাদুঘর’টি ইংল্যান্ড তথা বিশ্বের প্রাচীনতম একটি জাদুঘর। সেই ব্রোঞ্জ সভ্যতা থেকে শুরু“করে প্রাচীন গ্রীক এবং মিসরীয় আমলের ধাতব মুদ্রা, পুস্তক, খোদাই-কর্ম, মৃৎশিল্প, ভূ-তাত্ত্বিক ও প্রাণীবিদ্যা বিষয়ক বহু নমুনা, লিওনার্দো-দ্যা ভিঞ্চি, পিকাশোসহ বিশ্ববিখ্যাত সব শিল্পীর চিত্রকর্মসহ প্রায় চার সহস্রাব্দ আগের বহু বিরল এবং প্রাচীন নিদর্শন এখানকার ভা-ারকে সমৃদ্ধশালী করে রেখেছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে গড়ে ওঠা ‘মিউজিয়াম অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স’ জাদুঘরটিকে বলা যায় বিশ্বের মধ্যে অদ্বিতীয় একটি জাদুঘর। মধ্যযুগ থেকে আরম্ভ করে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত বিজ্ঞানের পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতির ইতিহাসকে তুলে ধরছে এই জাদুঘরটি। এ সময়ের মধ্যে আবিষ্কৃত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ছাড়া ১৮ ও ১৯ শতকে তৈরি বিভিন্ন যন্ত্রপাতিরও বিরাট একটি সংগ্রহশালা এটি। ‘দি পিটস্ রিভার মিউজিয়াম’টি স্থাপন করা হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। বলা যায় এটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব এবং প্রতœতত্ত্ব বিষয়ক সংগ্রহশালা। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত প্রায় ১৮০০০টি নমুনা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এই সংখ্যা অর্ধ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এখানকার ছবি ও শব্দের সমন্বয়ে তৈরি ‘আর্কাইভ’টি পুরনো অনেক ঘটনাকে জীবন্ত করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে চলেছে।
(চলবে)
No comments