আজ আবাহনী-মোহামেডান -সেই সময় এখন শুধুই স্মৃতি
‘উত্তেজনায় আমি রুমি ভাইকে ফাউল করে বসি! পেনাল্টি পায় আবাহনী। মোহামেডানের জার্সিতে সেটি ছিল আমার প্রথম আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ।
মিরপুর স্টেডিয়ামে আমরা ৩-২ গোলে হেরে যাই ১৯৯৭ সালের ফেডারেশন কাপের ফাইনাল। টিপুর গোল্ডেন গোলে আবাহনী চাম্পিয়ন।’আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আজ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে আরেকটি আবাহনী-মোহামেডান লড়াইয়ে নজরুল বসবেন আবাহনীর বেঞ্চে। কিন্তু নস্টালজিক ঠিকই থাকবেন। তাঁর শুরুর সময়েও আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে আগুনের ফুলকি ছুটত। খেলোয়াড়েরা রীতিমতো কাঁপতেন। তাঁদের জন্য এই ম্যাচ ছিল অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস। আবেগের তরঙ্গে ভাসতেন দুই দলের সমর্থকেরা। আর আজ?
ভেঙে পড়েছে দর্শক-আগ্রহের সেই সর্ববৃহৎ টাওয়ার। উত্তাপ নেই, দর্শক-আগ্রহ তলানিতে। আগে ভরা স্টেডিয়ামের বাইরে কয়েক হাজার দর্শক ঢুকতে না পেরে হাহাকার করত। এখন দর্শক আসতে চায় না। সংবাদমাধ্যমও নিরাবেগ। কাল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে সাংবাদিকদের মধ্যে এমন রসিকতাও হলো, গত বছরের আবাহনী-মোহামেডান প্রিভিউটা কিছু নাম-টাম বদলে ছাপিয়ে দেওয়া যায়। কেউ কিছু বুঝবে না!
সত্যিই তাই। কোথায় গেল দুই দলের স্নায়ুযুদ্ধের সেই দিনগুলো, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে টিকিট কাটার লম্বা লাইন! আক্ষেপ করছেন আলফাজ, মতিউর মুন্না, রজনীরা। এঁরা নব্বইয়ের দশকে খেলা শুরু করেছেন, আবাহনী-মোহামেডান প্রতিদ্বন্দ্বিতার সোনালি সময়টা পেয়েছেন। আবাহনীর নজরুলের মতো সাদাকালোর আলফাজও আজ বেঞ্চে থাকবেন। তবে মতিউর মুন্না, রজনীরা আজ মোহামেডানের জার্সিতে খেলবেন আরেকটি আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ। কিন্তু তাঁরা আগের মতো কি খেলে আনন্দ পান?
প্রত্যেকেই একই সুরে বললেন ‘না’। ১৯৯৬ সালে মোহামেডানের জার্সিতে প্রথম আবাহনীর বিপক্ষে খেলা রজনীর কথা, ‘কই আগের সেই উত্তাপ! কিছুই টের পাই না। আর দশটা ম্যাচের মতোই লাগে। মনে পড়ছে প্রথম আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ খেলতে নেমে প্রচণ্ড টেনশনে ছিলাম। সেই টেনশন এখন আর নেই। ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। ’৯২-৯৩-এর দিকে দর্শক হিসেবে গ্যালারিতে বসে কত কাঁদানে গ্যাস খেয়েছি পুলিশের!’
রজনীর মতো এমন লাখো কিশোর তখন এসবের সঙ্গে পরিচিত হতো হররোজ। কিন্তু সেই পরিবেশ পুরোপুরি বদলে গেছে। এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংজ্ঞা শুধু আবাহনী-মোহামেডানকেন্দ্রিক নয়। শেখ রাসেল, শেখ জামাল, মুক্তিযোদ্ধা, বিজেএমসিও বড় দল। কাজেই বড় ম্যাচ অনেক বেড়েছে।
তবু আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ এলেই পুরোনো স্মৃতি ফিরে আসে। তুলনা চলে সেকাল-একালের। এই ফাঁকে কিছু খুচরো তথ্য দিয়ে রাখা যাক। এবার লিগে আবাহনী-মোহামেডান দুই দলই পাঁচ ম্যাচে দশ পয়েন্ট পেয়েছে। শক্তির তুলনায় মোহামেডান ভালো খেলছে। দুই দলের গত দশটি বাংলাদেশ লিগ সাক্ষাতে আবাহনী জিতেছে তিনটি, মোহামেডান দুটি এবং বাকি পাঁঁচ ম্যাচ ড্র হয়েছে। সর্বশেষ লড়াইয়ে মোহামেডান জিতেছে ২-০ গোলে।
কিন্তু এসব পরিসংখ্যানও খুব কম লোকই মনে রাখছে এখন। অথচ আলফাজের মুখে শুনুন তাঁর শুরুর সময়ের কথা, ‘৯৫-তে মোহামেডানের জার্সিতে প্রথম আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচটা খেলে পরদিন দেখলাম পত্রিকায় বিশাল কভারেজ। আমার একমাত্র গোলে জিতেছিল মোহামেডান। প্রথম ম্যাচেই আমি হিরো। সেই দিনই বুঝলাম এই ম্যাচের মাহাত্ম্য। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে ভালো করলে পরের বছর ভালো পেমেন্ট পাওয়া যেত। এখন তো কিছুই নেই। তখন ছিল স্বপ্নের এক সময়।’
সেই স্বপ্নময় সময় ২০০৮ সালে সুপার কাপের ফাইনালে খানিক ফিরিয়ে এনেছিল স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক। কিন্তু সেটি ধূলিকণা হয়ে আবার হারিয়ে গেল। মতিউর মুন্না বলছিলেন, ‘চট্টগ্রামে আবাহনী-মোহামেডান খেলতে নামল। ম্যাচের পর মারপিটের মাঝখানে পড়ে কোনো রকমে জীবন নিয়ে হালিশহরের বাসায় যাই। তখন আমি ছোট। ’৯৭ সালে মোহামেডানের হয়ে প্রথম আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ খেলি, সে সময় রাতে ঘুমই হতো না। আর আজ মাঠে দর্শক নেই, ভালো খেলার প্রেরণা আসবে কীভাবে!’
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আজ বিকেল সাড়ে চারটায় শুরু ম্যাচটায় কি এই আক্ষেপ দূর হতে পারে না খেলোয়াড়দের? মাঠের পরিবেশ সুন্দর, সবকিছুই ঝকঝকে। শুধু দর্শক এলেই তো ভালো খেলার উৎসাহ পান খেলোয়াড়েরা।
No comments