সোহরাব হোসেনকে শ্রদ্ধা
নজরুলসংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীতের খ্যাতিমান শিল্পী সোহরাব হোসেনের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বিভিন্ন অঙ্গনে। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাতটার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। গুণী এই শিল্পীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন তাঁর কাছের কয়েকজন বন্ধু ও সহকর্মী।
নজরুলসংগীতের একনিষ্ঠ একজন ফিরোজা বেগমসোহরাব হোসেনের মৃত্যুতে অনেক কষ্ট পেলাম। চমৎকার কণ্ঠের এক গায়ক ছিলেন তিনি। নজরুলের গান নিয়ে একনিষ্ঠভাবে কাজ করার অন্যতম কৃতিত্বের দাবিদারও বটে। পঞ্চাশের দশকের আগে তিনি কিন্তু অন্য ধারার গান গাইতেন। এরপর নিয়মিতভাবে নজরুলের গান নিয়ে কাজ করে গেছেন। তাঁর মেয়েরাও অনেক ভালো গান করেন। আমি বলব, একজন মানুষ ও শিল্পী হিসেবে সোহরাব হোসেন সার্থক। তাঁর পরিবারের জন্য আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।
একটা যুগের অবসান সুধীন দাশ
সোহরাব হোসেনকে হারিয়ে আমার শিল্পীজীবনের শেষ বন্ধুকে হারালাম। ১৯৪৮ সালে যখন থেকে রেডিওতে গান করি, তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত এ বন্ধুত্ব অমলিন ছিল। সোহরাব হোসেনের মতো এত প্রাণবন্ত ও প্রাণোচ্ছল মানুষ আর দেখিনি। তাঁর মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান হলো। নজরুলসংগীতে এমন সুরেলা কণ্ঠ আর আসবে কি না, আমার সন্দেহ রয়েছে।
নজরুলের গানের ভান্ডারি ও কান্ডারি মুস্তাফা জামান আব্বাসী
সোহরাব হোসেনের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক আগের। সোহরাব হোসেন প্রথমত ছিলেন সুকণ্ঠ গায়ক, দ্বিতীয়ত, তিনি অনেক ভালো একজন শিক্ষক। তাঁর অনেক ভালো ভালো ছাত্র আছেন, যাঁরা নিজেরাও গানের জগতে নিজেদের যোগ্যতর করেছেন। সোহরাব হোসেনকে আমি নজরুলের গানের ভান্ডারি ও কান্ডারি দুই-ই মনে করি। টানা ৪০ বছর নজরুলের গান শেখানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
তাঁর সমসাময়িক আর কেউ থাকলেন না খালিদ হোসেন
ঢাকায় যখন প্রথম গান করতে আসি, তখন থেকেই সোহরাব হোসেনের সঙ্গে পরিচয়। এরপর দিনে দিনে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। আমরা সহকর্মী ছিলাম। তবে সোহরাব ভাই বয়সে আমার চেয়ে বড়। কিন্তু সেটা তিনি কখনোই বুঝতে দিতেন না। তরুণ শিল্পীরাও তাঁর সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। সোহরাব হোসেনের মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান হলো। তাঁর সমসাময়িক আর কেউ থাকলেন না। তাঁর মতো শিল্পীকে হারানোর ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।
যেমন কণ্ঠমাধুর্য, তেমনি কারুকাজ সন্জীদা খাতুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের হাউস টিউটরের কোয়ার্টারে থাকতাম তখন। একদিন মাইক্রোফোনে ভেসে আসা গান শুনলাম, গাইছিলেন সোহরাব হোসেন। যেমন কণ্ঠমাধুর্য, তেমনি কারুকাজ। কয়েক দিন বাদেই সোহরাব হোসেনের কাছে গান শেখার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
টানা তিন বছর গান শিখেছিলাম আমি। গান দ্রুত তুলে নিতাম বলে সোহরাব ভাই খুব খুশি। রবীন্দ্রসংগীতের রসে মজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সোহরাব ভাইকেই আমার একমাত্র গুরু মেনেছি। ‘ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন’ শুরু করার আগে তাঁকে গিয়ে ধরেছিলাম, ‘সোহরাব ভাই, আমরা স্কুল করছি। আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে!’ এমন মজা করে ছোটদের গান শেখাতেন! ওরাও জমিয়ে গাইত।
তাঁর তুলনা শুধু তিনি নিজে খায়রুল আনাম শাকিল
পারিবারিকভাবে আমার গান শেখার শুরুটা মামা মাহমুদুর রহমান বেণুর কাছে। আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখা সোহরাব হোসেনের কাছেই। সত্তরের দশকে ছায়ানটে প্রথম গান শেখার শুরু। শিক্ষক হিসেবে সোহরাব হোসেনের তুলনা তিনি নিজে। গান গাওয়ার পাশাপাশি গানের উপস্থাপনা এবং পরিবেশনার বিষয়ে বেশ সচেতন থাকতেন। আর শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদেরও এই উপদেশটা সব সময় দিতেন তিনি। সব শিক্ষার্থীকে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব স্টাইল তৈরিরও তাগিদটা দিতেন। নজরুলের গান সব সময় সঠিকভাবে গাওয়ানোর ব্যাপারে সচেতন ছিলেন সোহরাব হোসেন। সব মিলিয়ে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অনেক উঁচু মাপের। তাঁর তুলনা শুধু তিনি নিজে। তাঁর মৃত্যুতে বিশেষ করে নজরুলসংগীতে বিশাল একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
গান শেখাতেন ভালো লাগার মধ্য দিয়ে সুজিত মোস্তফা
অনেক শিক্ষকই আছেন, যাঁদের গান অনেক কষ্ট করে শিখতে হয়। কিন্তু সোহরাব হোসেন ছিলেন পুরোপুরি ব্যতিক্রম। তিনি শিক্ষার্থীদের গান শেখাতেন ভালো লাগার মধ্য দিয়ে। আর তাই তাঁর কাছ থেকে খুব সহজেই গান আত্মস্থ করা হয়ে যেত। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন খুব সহজ-সরল। তিনি আমাদের সংগঠন নজরুলসংগীত শিল্পী পরিষদের একজন উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন। আমি বলব, সোহরাব হোসেনের মৃত্যুতে শুধু নজরুলসংগীত শিল্পী পরিষদ নয়, বাংলাদেশের নজরুলসংগীত সমাজ পরম একজন অভিভাবক হারাল।
No comments