কোর্টের রায় নিয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্য আদালত অবমাননার শামিল by আরাফাত মুন্না
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায় সম্পর্কে বিরোধী দলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আদালত অবমাননার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন দেশের প্রখ্যাত আইনজ্ঞরা।
বুধবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের গণসংযোগ কর্মসূচীতে পথ সভায় বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল প্রসঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে এনে রায় দেয়া হয়েছে। শোনা যায় টাকার বিনিময়ে রায় দেয়া হয়েছে।’ তাঁর এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বৃহস্পতিবার আইনজ্ঞরা বলেন, তিনি যদি এ রায়ে সংক্ষুব্ধ হতেন তাহলে আপীল বিভাগে এ রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করতে পারতেন। তবে তিনি তা না করে প্রকাশ্য সভায় এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে সুপ্রীমকোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। আইনজ্ঞরা আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায় সম্পর্কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অবমাননাকর বক্তব্য রাখা এবং এ রায় তাচ্ছিল্য করে আদালত ও রায় সম্পর্কে জনমনে অসত্য ধারণা দেয়া অবশ্যই আইনের আওতায় এনে বিচার যোগ্য অপরাধ, কারণ দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান অনুযায়ী কেউ আইনের উর্ধে নয়।আইনজ্ঞরা বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতির পূর্বশর্ত ‘আইনের শাসন।’ আইনের শাসন যথাযথ ভাবে হচ্ছে কি-না, আইন প্রণয়নে সংবিধান সম্মত বিষয় মানা হচ্ছে কি-না, এমনকি সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রেও মূল সংবিধানের মৌলিক নীতি ও কাঠামো পরিপন্থী কিছু করা হচ্ছে কি-না তা পরীক্ষা করে দেখে সিদ্ধান্ত প্রদানের এখতিয়ার একমাত্র সুপ্রীমকোর্টের। আইনজ্ঞরা আরও বলেন, সংসদের সকল সদস্যের সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোন আইন পাস করলে সংবিধানের ৭ম অনুচ্ছেদ অনুসারে তা বাতিল ঘোষিত হবে। তাই এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল তাই সুপ্রীমকোর্ট তা বাতিল করে। এর ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। আইনজ্ঞরা আরও বলেন, দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী উচ্চ আদালতের রায় সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করলে সাধারণ জনগণেরও আইনের উপর আস্থা কমে যাবে।
জানা গেছে, ইতোপূর্বে দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সুপ্রীমকোর্টের বিষয়ে কথা বলায় তার বিরুদ্ধেও আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আদালত অবমাননার অভিযোগে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের নজির আছে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা জিলানি।
এ বিষয়ে অতরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীর এ ধরনের কথা বলা সমীচীন হবে না। এসব কথার কারণে আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যায়। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদন নিয়ে আসে তাহলে আদালত তা পরীক্ষা করে দেখবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায় সম্পর্কে খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের বক্তব্য আদালত অবমাননার শামিল। মেহেদী বলেন, বেগম জিয়া বলেছেন, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে রায় দেয়া হয়েছে। তিনি হয়ত জানেন না, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় বিচাপতি খায়রুল হক অবসরে যাবার আগেই দিয়েছিলেন। আর যুগ যুগ ধরেই সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার পরে কোন বিচারপতি অবসরে গেলে অবসরের পরেই তিনি পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন। এতে আইনগত কোন সমস্যা নেই। মেহেদী আরও বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে আইনের শাসন হুমকির মুখ পড়বে। একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া কোন দায়িত্বশীল বক্তব্য রাখেননি বলেও মন্তব্য করেন মমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী।
এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় সকলের জন্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত রায় সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের দেয়া। এ রায় নিয়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি আপীল বিভাগে এ রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করতে পারেন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় ‘টাকার বিনিময়ে’ এ জাতীয় অভিযোগ, প্রকাশ্য ভাবে এ ধরনের শব্দ উচ্চারণ করা আদালতের বিচার কার্যক্রমকে বিকৃত করা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আদালত অবমাননার শামিল।
তিনি বলেন, আদালত অবমাননা সংক্রান্ত আইনে অবশ্যই এ জাতীয় কর্মকা- আদালত অবমাননার শামিল বলে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আদালতও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা কোন ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায় সম্পর্কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অবমাননাকর বক্তব্য রাখা এবং এ রায় তাচ্ছিল্য করে আদালত ও রায় সম্পর্কে জনমনে অসত্য ধারণা দেয়া অবশ্যই আইনের আওতায় এনে বিচার যোগ্য, কারণ দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান অনুযায়ী কেউ আইনের উর্ধে নয়। যিনি আদালত অবমাননা করবেন তিনি অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। ইতোপূর্বে বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও আদালত অবমাননার অভিযোগে মামলা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও আদালত অবমাননার মামলা হতে বাধা নেই।
এ বিষয়ে এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আদালতে রায় টাকার বিনিময়ে, এ ধরনের কথা বলার মাধ্যমে সাংবিধানিক ও আইনের শাসনকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে এবং বিচারবিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করার একধরনের প্রয়াস। তিনি আরও বলেন, যিনি টাকা দিয়ে আদালত থেকে রায় নিয়েছেন, তিনিই শুধু জানবেন টাকা দিয়ে আদালত থেকে রায় পাওয়া যায়।
জানা গেছে, ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করেন। হাইকোর্ট প্রাথমিক শুনানি শেষে রুল জারি করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ রায় দেন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে ওই রায়ে বলা হয়, ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত। তবে আদালত এ রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপীলের অনুমতি দেয়। এই ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে আপীল করা হয়। তবে এম সলিমউল্লহ মারা যাওয়ায় আবেদনটি চলতি বছর মোঃ আবদুল মান্নান বনাম বাংলাদেশ সরকার শিরোনামে কার্যতালিকায় আসে। এরপর দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত রায় দেয় আপীল বিভাগ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে সাত বিচারপতি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করে।
এ মামলার শুনানিতে আপীলকারী ও রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও এ্যামিকাস কিউরি (আদালতের আইনী সহায়তাকারী) হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আটজন আইনজীবী বক্তব্য দেন। এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। তবে রফিক-উল হক ও এম জহির বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংস্কারের পক্ষে মত দেন। অপর এ্যামিকাস কিউরি আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা সংবিধানের মৌল কাঠামোর পরিপন্থী। সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার কিছুদিন পর অবসর গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। পরে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার প্রায় দেড় বছর পর পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন বিচারপতি খায়রুল হকসহ রায় ঘোষণাকারী বিচারপতিগণ। পূর্ণাঙ্গ রায়ে ৩:২:২ সমানুপাতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে রায় আসে। আর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল হয়ে যায়।
No comments