নতুন বর্ষ নতুনের আহবান ॥ by তৌফিক অপু
পুরো বিশ্ব তিনদিন ডুবে থাকবে অন্ধকারে। শেষ হয়ে আসবে প্রাণের আয়ু। চোখ মেলে দেখা হবে না সুন্দর এ পৃথিবীকে। এ কেমন কথা! বাঁচার সাধ যে রয়েই যায়। কিন্তু কিছুই যেন করার নেই। কারণ পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পরে। এ যেন স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ।
মন চায় তারপরেও মেনে নিতে হবে। এমনই এক বিশ্বাস নিয়ে মায়া সভ্যতা এবং মায়া ক্যালেন্ডারে বিশ্বাসীরা তুলকালাম কা- বাধিয়ে বসেছেন। তাদের ধারণা মতে, ২১ ডিসেম্বর ২০১২ হচ্ছে পৃথিবীর শেষদিন। এদিনেই ঘটবে মহাপ্রলয়। কারণ এ দিনই ৫ হাজার বছরের বেশি সময়ের মায়া ক্যালেন্ডারের শেষদিন। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মায়া সভ্যতার কালচিন্তকরা পৃথিবীর শেষদিন হিসেবে চিহ্নিত করে গেছেন ২১ ডিসেম্বর ২০১২ সালকে। তারা বলেছেন, ৫ হাজার ১২৫ বছরের একটি কালচক্র। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসেবে ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর মকরক্রান্তিতে একই সঙ্গে শেষ হতে যাচ্ছে কালের বিশাল দুটি চক্র। রহস্যময় মায়া জাতি যার নাম দিয়েছিল পার্থিব যুগ। সে সময়ই তারা পাথর কেটে তৈরি করেছিল ‘লং কাউন্ট’ নামের বিশাল এক ক্যালেন্ডার। মায়া সভ্যতার ওই হিসেবের সঙ্গে মিলে গেছে আধুুনিক বিজ্ঞানের আরেক চক্র। ২১ ডিসেম্বরই শেষ হচ্ছে ২৬ হাজার বছরের পুরনো এক মহাচক্র। পৃথিবীর মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির খুব কাছে উপস্থিত হবে। সমস্ত সৌরজগত আর গ্যালাক্সির সঙ্গে পৃথিবী আবদ্ধ হবে বিরল এক অ্যালাইনমেন্টে। ঘটে যেতে পারে বড় রকমের কিছু একটা। হয়ত এখানেই থেমে যেতে পারে পৃথিবী। আর যাই হোক বড় রকমের একটা পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। পৃথিবীর বিখ্যাত ভবিষ্যত বক্তা নস্ট্রাডাম এবং এডগারও এ সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়েছেন। তাদের পূর্বাভাসে জ্যোতির্শাস্ত্র এবং বর্তমান সময়ের যাপিত জীবনের মিশেল রয়েছে। যেমন নৈতিকতার অবক্ষয়, পরিবেশ রক্ষায় উদাসীনতা, বন্য প্রাণীর প্রতি অবিচার ইত্যাদি পৃথিবী ধ্বংসের পূর্বাভাস। যে কারণে পৃথিবী ধ্বংসের গুজবটি আরও শক্তিশালী হয়। সবার মনে এক ধরনের ভীতি সঞ্চার করে। তবে পৃথিবী ধ্বংসের এ খবরটি যত বেশি না ছড়িয়েছে তার চেয়েও মুখরিত হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে। অর্থাৎ পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় আতœরক্ষার জন্য যে যেভাবে পেরেছে প্রস্তুতি নিয়েছে। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার এক ব্যক্তি মাটির নিচে সিলিন্ডারজাতীয় এক ধরনের বাঙ্কার তৈরি করেছেন; যা বিস্ফোরণ প্রতিরোধক। আবার চীনের এক ভদ্রলোক বল আকৃতির কিছু পড বানিয়েছেন; যাতে একসঙ্গে ১৪ জন বসবাস করতে পারবে। ফাইবার গ্লাসের পডগুলো সহজেই ভেঙ্গে পড়বে না এবং ঝড় জলচ্ছ্বাসে পানিতে ভেসে থাকতে সক্ষম। যদিও বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্ক করেছেনÑএগুলো গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়। তার পরও মায়া ক্যালেন্ডারে বিশ্বাসীরা নিজেদের মতো প্রস্তুতি সেরে রেখেছিলেন; যা সত্যিকার অর্থেই এখন রূপকথার গল্প। চীনের কিছু প্রদেশ, দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অঞ্চল, মেক্সিকো, ব্রাজিলের আলটা গ্রামবাসী এখনও মায়া ক্যালেন্ডারে বিশ্বাসী।নতুন বছরের পটভূমি
ইতিহাসের গোড়পত্তন কবে বিশেষ করে মানব ইতিহাসের সঠিক সাল এবং তারিখ আজও অনাবিষ্কৃত। মানব ইতিহাসের অনেকটা পেছনে গেলে দেখা যায় জাতিধর্মগোত্র বিশেষে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর ধরন একেক রকম। বর্তমান সময়ে আমরা জানুয়ারির এক তারিখকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে উদ্যাপন করে থাকি। এ ট্র্যাডিশন খুব বেশিদিনের পুরনো নয়। জানুয়ারির এক তারিখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সন্ধান মেলে খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ বছর আগে। রোমানরাই সর্বপ্রথম বর্ষবরণের জন্য জানুয়ারির এক তারিখকে নির্ধারণ করে। নতুন বছরকে ঘিরে রোমান সাম্রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজ নিজ দায়িত্বে আসীন হতো। নিজেদের সারা বছরের ওয়ার্কিং প্ল্যান জনসম্মুখে তুলে ধরতেন। এক ধরনের প্রতিশ্রুতি বলা যায়। তবে এক জানুয়ারির আগে ভার্নাল ইকুইনক্স (দিন-রাত সমান) থিওরি ফলো করে ২৫ মার্চকে নববর্ষ ধরে উদ্যাপন করত তারা। ইউরোপিয়ান খ্রীস্টানরাও এদিনটিকে নববর্ষ হিসেবে পালন করত। কিন্তু জানুয়ারির এক তারিখ নববর্ষ ঘোষণা দেয়ায় তাদের বছর গণনায় এবং দাপ্তরিত কাজে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালে জুলিয়াস সিজার নতুন বছরের সূচনাকে জানুয়ারির এক তারিখ থেকে সরিয়ে ভার্নাল ইকুইনক্সের সঙ্গে সামঞ্জস্য কোন এক দিনে নিতে উদ্যোগী হন। কিন্তু জানুয়ারির এক তারিখ পরিবর্তন করে ২৫ মার্চ আনাটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তারপরও অনেক হিসেবনিকেশ করে নববর্ষের দিন ধার্য হয়; যা সবার মনমতো হয়। জুলিয়াস সিজারের এ অবদানের জন্য রোমান সিনেট নববর্ষের সে মাসটির নামকরণ করেন জুলাই। সেই থেকে ১৫৮২ সাল পর্যন্ত জুলাইয়ের এক তারিখে নববর্ষ পালিত হতো। ১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি, ক্যালেন্ডারে আরও কিছু পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি চূড়ান্ত হিসেবনিকেশের পর আজকের নববর্ষের দিন ধার্য করেন। অর্থাৎ জানুয়ারির এক তারিখকে তিনি বছরের প্রথম দিন হিসেবে ঘোষণা দেন। তবে গ্রেটব্রিটেন এবং আমেরিকায় অফিসিয়ালি তারিখটি স্বীকৃতি পায় ১৭৫২ সালে। এর পর থেকেই সারাবিশ্বে একযোগে জানুয়ারির ১ তারিখ নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
নববর্ষ এবং জুলিয়ান-গ্রেগরির লড়াই
জুলিয়ান তার ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের আগে ১ বছরে মাস ছিল ১০টি। বছরটি শুরু হতো মার্চিয়াস (মার্চ) থেকে। এর পর মাসগুলো ছিল যথাক্রমে এপ্রিলিস, মাইয়াস, লুনিয়াস, কুইন্টিলিস, সেক্সটিলিস, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নবেম্বর ডিসেম্বর। ১০ মাসে সবমিলিয়ে ৩০৪ দিন। এতে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা ছিল তা হলো একেক সময় একেক ঋতুতে বছর শুরু হতো। এ জটিলতা নিরসনে ৭১৩ খ্রিস্টপূর্ব তৎকালীন রোমান সম্রাট নুমা পম্পিলাস সৌরবছরের সঙ্গে মিল রাখতে লানুয়ারিয়াস (জানুয়ারি) এবং ফেব্রুয়ারিয়াস (ফেব্রুয়ারি) মাস দুটি যোগ করেন। তখন ১ বছর গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫৫ দিনে। তারপরও হিসেব করে দেখা যায় রোমান ক্যালেন্ডার সৌরবছর থেকে কিছুটা পিছিয়ে আছে। একটি সৌর বছরের স্থায়িত্ব ৩৬৫.২৪২৫ দিন। জুলিয়ান এ সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসেন। তিনি ১২ মাস ঠিক রেখে দিন-ক্ষণ হিসেব করে ১ বছরকে ৩৬৫ দিনে রূপ দেন। এবং প্রতি ৩ বছর পর পর ফেব্রুয়ারিতে ১ দিন যোগ করে সৌরবছরের সঙ্গে সঙ্গতি রাখা হতো। জুলিয়াস সিজারের ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত ছিল দীর্ঘদিন; যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। কিন্তু পনেরো শতকে এসে কিছুটা বিপাকে পড়েন খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীরা। কারণ লিপইয়ারের কারণে দিন দিন একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল। যে কারণে ইস্টার সানডে একেক চার্চে একেক সময় পালন করা হতো। জুলিয়াস সৌরবর্ষের হিসেব মিলাতে গিয়ে লিপইয়ার চালু করলেও তা সৌরবর্ষ থেকে কিছুটা এগিয়ে যায়। যেমন সৌরবর্ষ হয় ৩৬৫.২৪২৫ দিনে। কিন্তু জুলিয়াসের বছর হতো ৩৬৫.২৫ দিনে। যে কারণে একটু একটু করে বছর অনেকটাই এগিয়ে যায়। ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি তা সংশোধন করেন; যা সৌরবর্ষের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু অনেকেই গ্রেগরির এ ক্যালেন্ডারের বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রীস্টানরা ছিল তীব্র বিরোধী। এর পর প্রায় ৪০০ বছর ধরে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে লড়তে হয়েছে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে। তবে বর্তমানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই সর্বস্বীকৃত।
নববর্ষের উৎসব
বিদায়ী বছরের বিষন্নতাকে ছাপিয়ে মনকে উৎফুল্ল করে তোলে নতুন বছরের আগমনী বার্তা। ক্যালেন্ডারের শেষ পাতাটি ছিঁড়ে একসঙ্গে উচ্চারিত হয় হ্যাপি নিউ ইয়ার। নতুন দিনের সূচনা, নতুন করে পথচলা। নতুন প্রাণচাঞ্চল্য, নতুন শপথ সব কিছুই যেন একাকার হয় বছরের প্রথম দিনটিতে এসে। অতীতকে মুড়িয়ে দিয়ে নতুন এক সময়কে বরণ করে নেয়ার শিহরণই যেন অন্যরকম। প্রতিমুহূর্তেই চলে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার প্রস্ততি।
বন্ধু-প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানানোর মাধ্যমে শুরু নতুন বছরের দিন। পুরনো গ্লানি মুছে নতুনভাবে বাঁচার প্রত্যয়ে শুরু হয় নববর্ষ। যে কারণে উন্মাদনাও একটু বেশি থাকে নববর্ষকে ঘিরে। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। ইংরেজী নববর্ষ পালনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উৎসব হচ্ছে থার্টিফাস্ট নাইট। বছরের শেষ এ দিনটিতে বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় নববর্ষের উৎসব। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সুর ও সঙ্গীতের মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। আতশবাজির আলোকছটায় ছেয়ে যায় আকাশ। শুরু হয় প্রিয়জনদের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো। একে অপরকে উপহার আদান -প্রদানের মাধ্যমে বরণ করে নেয় নতুন বছর। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই পালন করা হয়ে থাকে ইংরেজী নববর্ষ।
একেক দেশের একেক বরণ
ভৌগোলিক সীমারেখা কিংবা ধর্র্র্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতার কারণে একেক দেশের বর্ষবরণ একেক রকম হয়ে থাকে। আমেরিকার নিউইয়র্কে বেশ জাঁকজমকভাবে পালন করা হয় নববর্ষ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হচ্ছে ফলিং বল। ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ঠিক বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে টাইমস্ স্কয়ারের উঁচু দালান থেকে আলো ঝলমল সংবলিত বিশাল সাইজের একটা বল দ্রুত মাটির দিকে নামতে থাকে। মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই হ্যাপি নিউ ইয়ার লেখাটি জ্বলে ওঠে। এরই সঙ্গে চারপাশ থেকে ফুটতে থাকে আতশবাজি। সঙ্গীতের মূর্ছনাও যোগ হয় এর সঙ্গে। বহু পর্যটক প্রতিবছর ভিড় জমায় এই ফলিং বলের কা-কারখানা দেখার জন্য। সুইডেনের প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় ত্রিভুজ আকৃতির বাতি জ্বলতে থাকে। শহরের ওপেন স্কয়ারে সন্ধ্যার পর থেকেই জ্বলতে থাকে রঙ-বেরঙের বাতি। ডেনমার্কের অধিবাসীরা তাদের প্রিয়জনদের বাড়ির দরজায় সজোরে আঘাত করে জানান দেন নতুনের আগমনী বার্তা। লন্ডনের রিজেন্টস্ স্ট্রীটে যে আলোকসজ্জা করা হয় তা রীতিমতো চোখ ধাঁধানো। মিয়ানমারে উৎসব পালন করা হয় একটু ভিন্ন স্টাইলে; যা আমাদের দেশের উপজাতিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রয়েছে। মিয়ানমারের জনগণ নববর্ষে জলোৎসব করে থাকে। ছেলেমেয়ে মুখোমুখি দুটি সারিতে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝখানে পানির চৌবাচ্চা। এই চৌবাচ্চা থেকে পানি নিয়ে একে অপরকে ছুড়ে মারে। এভাবেই একজন আরেকজনকে ভিজিয়ে বরণ করে থাকে নববর্ষকে। তাজা ফুলের সাজসজ্জা এবং ফুল দেয়া-নেয়া নিয়ে নতুন বছরকে পালন করে নেয় জাপানীরা। ফ্লোরিডার অধিবাসীরা নববর্ষের দিন কমলা-বাটির খেলা উপভোগ করে আর টেক্সাসের জনগণ সুতি-বাটির খেলার আয়োজন করে থাকে।
বাঙালীর ইংরেজী নববর্ষ পালন
বাঙালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য হাজার বছরের। বারো মাসে তেরো পার্বণে অভ্যস্ত বাঙালী জাতি খুবই উৎসবপ্রিয়। যে কারণে নিজস্ব উৎসব ছাড়াও অন্যের উৎসবেও রঙ ছড়াতে দ্বিধাবোধ করে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ জাতি ইংরেজী নববর্ষ পালন করে থাকে বেশ জাঁকজমকপূর্র্ণভাবে। প্রিয়জনকে ফুল, মিষ্টি আর কার্ড আদান-প্রদানের মাধ্যমে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। আয়োজন করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। গান, আলাপচারিতা, উপহার আদান-প্রদান আর ঘুরে বেড়ানো ট্র্যাডিশন এখন এদেশেও চালু হয়েছে। যদিও ইংরেজী বলা হয় তথাপি গ্রেগরিয়ানের ক্যালেন্ডার বিশ্ববাসীর সম্পদ। কারও নিজস্ব নয়। আমাদের দেশেও এর শিকড় অনেক গভীরে। গ্রামবাংলার কিছু অঞ্চলে বাঙালীর নিজস্ব ক্যালেন্ডার ফলো করা হলেও সমাজ-রাষ্ট্রের সব কাজ গ্রেগরিয়ান ক্যানেন্ডারকে অনুসরণ করে করা হয়ে থাকে। যে ইংরেজী নববর্ষ আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
থার্টিফার্স্ট নাইট প্রসঙ্গ
ইংরেজী নববর্ষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হয়ে থাকে বছরের শেষদিনটিতে। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ব। সমম্বরে চিৎকার করে ওঠে হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে। ঘুম ভাঙ্গা মানুষরা জড়ো হয় নতুন অভিযাত্রা, নতুন রূপান্তরের তাগিদে। গেয়ে ওঠে নববর্ষের গান। আমাদের দেশে ইংরেজী নববর্ষের দিন সরকারী ছুটি না থাকলেও অন্যান্য দেশে রয়েছে। কারণ থার্টিফাস্ট নাইট এত বেশি উৎসবের মেজাজে থাকে যার ফলে পরের দিন কর্মব্যস্ত মুড আর আসে না। আমাদের দেশেও থার্টিফাস্ট নাইট জাতীয়ভাবে পালন করা না হলেও পাড়ায় পাড়ায় কিংবা মহল্লায় বেশ জাঁকজমকভাবেই তা পালন করা হয়। তবে থার্টিফাস্ট নাইট পালন নিয়ে বেশ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে এদেশের তরুণ-তরুণীরা। তারা থার্টিফাস্ট নাইট পালনের নামে সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা। অনেক সময় নৈতিকতার অবক্ষয়ের প্রমাণ মেলে। অথচ যেসব দেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে থার্টিফাস্ট নাইট জাতীয়ভাবে পালন করা হয় সেসব দেশেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। আর আমাদের দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর মাথার ঘাম পায়ে পড়ার যোগাড়। থার্টিফাস্ট নাইটের সঙ্গে একাত্ম প্রকাশকারী বোদ্ধাদের মতে, এদেশে থার্টিফাস্ট নাইট ভুল ব্যাখ্যায় পালিত হয়। এলকোহল কিংবা মাদকের নেশায় ডুবে হৈহুল্লোড় করাই বুঝি থার্টিফাস্ট নাইট। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। শীতপ্রধান দেশে এলকোহল অনেকটা পানি খাওয়ার মতোই স্বাভাবিক। ওরা এটাতে অভ্যস্ত। এবং এর জন্য ওরা জ্ঞানহীন কোন কাজ করে বসে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে খাওয়া-দাওয়া, গান গাওয়া, উপহার আদান-প্রদান করা কিংবা ড্যান্স পার্টিতে এটেন্ট করা পর্যন্তই; যা তাদের কালচারে খুবই মানানসই। আমাদের দেশেরও নিজস্বতা আছে। আমরাও আমাদের মতো করে উদ্যাপন করতে পারি। কিন্তু অন্যেরটা ধার করতে গিয়েই বাধিয়ে ফেরি বিপত্তি। একটি বছরের বিদায় আর নতুন বছরের আগমন সত্যিকার অর্থেই জীবনযাপনে প্রভাব ফেলবে। বিষাদের গ্লানি দূর করে নতুনকে স্বাগত জানানোর উন্মাদনা থাকবেই। সেটা উপহার আদান-প্রদান, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে, গান গেয়ে কিংবা বর্ষ বিদায় ও স্বাগত অনুষ্ঠান করে এবং পরিবার-পরিজনকে ভাল সময় উপহার দিয়ে পালন করা যেতে পারে। কিন্তু খারাপ কোন পন্থায় যা দৃষ্টিকটু এমন কিছু দিয়ে বর্ষবরণ কখনই হতে পারে না। এতে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর চেয়ে অপমানই করা হয়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই থার্টিফাস্ট নাইট নিয়ে অনেক উন্মাদনা থাকে কিন্তু এর মধ্যেও থাকে নির্মলতা। কখনই থার্টিফাস্ট নাইট নিয়ে কোন দুর্ঘটনা বা দুর্নাম পাওয়া যায়নি। অথচ আমাদের সমাজে থার্টিফাস্ট নাইটে কোন কোন দুর্নাম কিংবা দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ নির্মল আনন্দ যেন খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে মানুষ এখন অনেক সচেতন। যে কারণে এদেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্মল আনন্দের থার্টিফাস্ট নাইট অনুষ্ঠানের দেখা মেলে। বিশেষ করে ঢাকা শহর এখন ফ্ল্যাটের শহর বলা যায়। একই ছাদের নিচে অনেক ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা মিলে থার্টিফাস্ট নাইটে একসঙ্গে রাতের ডিনারের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকে থার্টিফাস্ট নাইট। কর্মব্যস্ত জীবনে ফ্ল্যাটের সবার সঙ্গে দেখা হওয়া এবং আলাপচারিতার গুঞ্জনমুখর এ সময়টিই বা কম কি।
শুভ কামনা ও শুভেচ্ছা
একটি বছর গড়িয়ে আরেকটি বছর শুরু হয়। গত বছরের সব ব্যর্থতাকে মুছে দিতেই নতুন বছরের আগমন ঘটে, এটাই আমাদের বিশ্বাস। দেশের মঙ্গল কামনা কিংবা নিজেদের মঙ্গল কামনা যাই বলি না কেন এ যেন সৌহার্দ্য সম্প্রীতির জন্যই। হাতে হাত ধরে সুন্দর একটি বছর পার করার কামনা, সাফল্যের ঝুড়ি প্রসারিত করা, বিশ্বের মানচিত্রে সফল দেশের একটি হিসেবে নিজের দেশকে তুলে ধরাই সবার কাম্য। আমাদের ছোট এ দেশ। আমাদের অবহেলাতেই নষ্ট করে ফেলছি। নতুন বছরের দৃঢ় প্রত্যয় হওয়া উচিত আমাদের এ হাত দিয়েই যেন দেশের মঙ্গল বারতা বয়ে নিয়ে আসতে পারি।
একেকটি বছর এখন থেকেই যেন আমাদের সফলতার বছর হয় সে লক্ষ্যেই দেশের প্রতি নিবেদিত হওয়া উচিত। আমাদের সফলতার বার্তা ও নতুন বছরের শুভেচ্ছা আমরাই পৌঁছে দেব বিশ্ববাসীকে। আর চিৎকার করে বলবÑ শুভ হোক নতুন বর্ষ। শুভ নববর্ষ।
No comments