ব্যাংকে টাকা নিরাপদ বিপরীতে ‘মলম’ কোম্পানির টাকা ঝুঁকিপূর্ণ by ড. আর এম দেবনাথ
ভাবছি কী নিয়ে লিখি বিষয়ের অভাব।২০১২ সাল শেষ হতে চলেছে। ২০১৩ সাল শুরু হবে আগামী মঙ্গলবার। এমতাবস্থায় একটা বিষয় হতে পারত ২০১২ সালের অর্থনীতি। ঠিক করেছি এ বিষয়ে পরেই লিখব।
আপাতত দেখি অন্য কোন বিষয় পাওয়া যায় কীনা। একটি কাগজে দেখলাম রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভ্রমণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত। সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রচ- ঠা-া। এতে কক্সবাজার যাত্রীর সংখ্যা কমছে। ২০১২ সালে বিদেশী পর্যটক যত সংখ্যায় এসেছিল ২০১৩ সালে তা নাও আসতে পারে। দেশীয় পর্যটকদেরও একই অবস্থা। হরতাল, অবরোধ, পথসভা, মারদাঙ্গা, গাড়ি ভাঙ্গা, আচমকা আক্রমণ এমন সব ভয়াবহ ঘটনার জন্য কে বাড়ির বাইরে যাবে। জানা যাচ্ছে, ২০১২ সালে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ১০-১৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা হবে না বলে আশঙ্কা। আমাদের পর্যটন শিল্প বড় কিছু নয়! ধীরে ধীরে এটা হচ্ছিল। এর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা একটা বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। গরিব দেশের জন্য এটা খারাপ খবরই বটে। বিশেষ করে যখন দেখা যায় আমরা বৈদেশিক মুদ্রার জন্য অতিমাত্রায় নির্ভরশীল ‘রেমিটেন্স’ এবং গার্মেন্টস রফতানির ওপর। হরতাল- ভয়তাল, তাহলে দেখা যাচ্ছে শুধু দেশীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না আমাদের, বৈদেশিক মুদ্রা আইনেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিদেশে ভাবমূর্তির কথা, না হয়, বাদই দিলাম।এদিকে দেখা যাচ্ছে সরকারের রাজস্ব বাড়ে না। বাড়ে না নানান কারণে যেখানে সরকারের জন্য এক টাকাও গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে বছরের পর বছর ধরে রাস্তাঘাটের নিয়মিত মেরামতও সম্ভব হচ্ছে না।, সেখানে খবর ছাপা হয়েছে। ১২৮টি তালিকাভুক্ত কম্পানি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পাওনা ৫৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করছে না। এর দ্বারা দুটো জিনিস প্রমাণিত হয়। প্রথমত আমাদের কম্পানিগুলো বরাবরের মতোই এখনও কর দেয় না। জরিমানার টাকা দিতে চায় না। ভ্যাট দিতে চায় না। আবার এটাও প্রমানিত হয় যে ‘রেগুলেটর’ ভীষণ দুর্বল। তাদের দুর্বলতার সুযোগে কোম্পানিগুলো এই অনিময় করে চলেছে। ‘এসইসি’ কিসের জন্য টাকা পাবে? ঠাকা পাবে জরিমানা হিসেবে। জরিমানা কেন? শেয়ার বেচাকেনা করেছে রিয়ম ভেঙ্গে, কম্পানীগুলো আর্থিক বিবরণী জমা দেয়নি। লভ্যাংশ ঘোষণা করতে গিয়ে তারা অনিয়ম করেছে। তাই বিনা অনুমতিকে কম্পানীর সম্পদ বিক্রি করেছে। এবার ভাবুন। ঘোরতর অন্যায় করেও তারা এখন পেশী শক্তি দেখাচ্ছে। একে তো অন্যায় করেছে, দ্বিতীয়ত এসইসিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। করণীয়? করণীয় আছে। আমরা অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করছি আমাদের রেগুলেটরি অথরিটিগুলো তাদের যে দাঁত, হাত আছে তা বোঝাতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি ( এম আরএ); ইনসিউরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি (ইডরা) জাতীয় সংগঠনগুলো তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তেমন সফল হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলো তাদের কথাই শুনতে চায় না। এতে দেশবাসী ক্ষতিগ্রস্ত, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত, শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত, সুশাসন বিঘিœত। এর প্রতিকার কী? আমরা কী আজীবনই এমন থাকব?
ভিন্ন একটি কাগজে দেখলাম ‘এনবিআর’ (ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভেনিউÑ) বেতনভুক করদাতাদের ফাইল অডিট না করার পরিকল্পনা করছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে তা জানি না। তবে এটা হলে এনবিআরকে অগ্রিম ধন্যবাদ জানাব। কারণ? অভিজ্ঞতায় দেখা যায় ‘এনবিআর’এর লোকবল কম থাকা সত্ত্বেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অহেতুক ছোটখাটো ও রুটিন কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে ভালবাসেন। যে কাজটি সহজ, ঝামেলা ও ঝুঁকিমুক্ত সেসব কাজেই তারা সময় বেশি দেন। কে তাদের বোঝাবে চাকরিজীবীদের কর ফাঁকি দেয়া কঠিন। তাদের কাছ থেকে কর চাকরিদাতা কোম্পানি কেটে নেয় এবং সেই টাকা পরিশোধে সরকারের কোষাগারে জমা দেয়। কেউ কেউ যে ফাঁকি দেয় না, তা বলা যাবে না। তবে তা যত সামান্য। এটা রোধ করা সহজ। যেটা কঠিন সেটা হচ্ছে প্রভাবশালীদের কাছ থেকে কর আদায় করা। কঠিন হলেও এ কাজটি ধীরে ধীরে শুরু করা দরকার। কী করে কর ফাঁকিবাজ বড় বড় ফাঁকিবাজ প্রভাবশালীদের করের আওতায় আনা যায়। সে ব্যাপারে কাজ শুরু হলে আজ হোক কাল হোক ফল পাওয়া যাবে। আমি বহুদিন যাবতই লিখছি গার্মেন্টস মালিকদের সম্পর্কে। তারা বিরাট একটা ট্যাক্স দেন না বলে বাজারে শোনা যায়। এমনও শোনা যায় তারা দুই কোটি টাকার গাড়ি দৌড়ান তাদের নাকি বাৎসরিক সংসার খরচ দুই লাখ টাকা। সত্য মিথ্যা জানি না। তবে এসব শুনে খুব খারাপ লাগে। আরও খারাপ লাগে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের উচ্চকণ্ঠ দেখে ও শুনে। মন্দের ভাল দেখা যাচ্ছে। এনবিআর এখন থেকে তাদের অফিসারদের কিছুটা সময় ফালতু কাজ থেকে বাঁচাবে। এ সময়টা ফাঁকিবাজদের ধরার কাজে লাগালে দেশের লাভ হবে। রাজস্ব বাড়বে।
ব্যাংক ঋণের ওপর একটা স্টোরি দেখলাম গত ২৬ তারিখে। এতে দেখা যায় ঋণ প্রবাহ আগের তুলনায় কমেছে। বলা হয়েছে এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ গ্রহণের ফল। হয়ত তাই আবার অন্যান্য উপাদানের অবদানও কম নয়। গত ৩ মাস সরকারী ব্যাংকে কোন বোর্ড ছিল না। অতএব, নতুন ঋণ প্রদান প্রায় বন্ধ ছিল। চাল আমদানি শূন্যের কোঠায়। জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় কমেছে কারণ এর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে তুলনামূলকভাবে কম। সারের আমদানিও আগের মতো নয়। তাছাড়া রয়েছে বিলাসপণ্য আমদানিতে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা কিন্তু তার চেয়ে বড় কারণ রয়েছে কয়েকটি। গ্রামে শিল্পজ পণ্যের চাহিদা কম। কৃষকের হাতে টাকা নেই। কৃষক দুই-তিনটি ফসলের দাম পায় না। আমনের দামও আশানুরূপ নয়। কৃষক পাটের দামও পায়নি। এতে কৃষকেক্ক্রয়-ক্ষমতা কমেছে। কমেছে তার সঞ্চয়। ফলে শিল্পজ পণ্যের চাহিদা, প্রামে ভোগ্য পণ্যের চাহিদা কমেছে। এতে এক ধরনের মন্দা বেসরকারী খাতের শিল্পে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া সেই গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন সংযোগ। সব মিলেই বেসরকারী খাতে ধানের চাহিদা গেল বারের তুলনায় কম। গেল বার কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের ‘জন্য বেশ যন্ত্রপাতি। আমদানি হয়। এবার তা নেই। অর্থ্যাৎ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কম। বলা বাহুল্য এতে অনেক টাকা লাগে। এসব কারণে অর্থনীতিতে ‘ক্রেডিট গ্রোথ’ কম। আমি অবশ্য মাত্রাতিরিক্ত ‘ক্রেডিট গ্রোথের’ বিপক্ষে। অতিরিক্ত ক্রেডিট দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ করে ক্রেডিট বা ঋণ হলেই উন্নতি, তা না হলে অবনতি এটা আমি বিশ্বাস করি না। বস্তুত বর্তমান সরকারের প্রথম তিনবছর ঋণপ্রবাহ বেড়েছে বেশি হারে। এটা ঠিক হয়নি। সস্তা ঋণেরও বিপক্ষে আমি। সস্তা ঋণ, অপ্রয়োজনীয় ঋণ পরিণামে ব্যাংকের শ্রেণী বিন্যাসিত।
ঋণের পরিমাণ বাড়ায়। এ ব্যাপারে আমি দুটো সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে চাই এবং তা করছি সমালোচনার ঝুঁকি নিয়েই। ইদানীং এসএমই নিয়ে বড় হৈ চৈ হচ্ছে। অথচ এতটা হৈ চৈয়ের কোন কারণ আমি দেখি না। এ ধরনের ঋণের টাকা অপচয় হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক গবর্নর বলেছেন, তিনি সম্প্রতি তিনটি জায়গায় গিয়েছেন। তিনি দেখেছেন সেসব জায়গায় এসএমই ঠিকমতো ব্যবহৃত হচ্ছে না। কাজেই জোর করে ‘এসএমই’ করার কোন কারণ দেখি না। কেবল আইলা উদ্যোক্তা ঋণ। আজকাল এটাও একটা সেøাগানে পরিণত হয়েছে। এ সম্বন্ধে কথা বললে অনেকেই বলবেন আমি নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে। অথচ তা আমি নই। কিন্তু শহরে যা দেখতে পাচ্ছি সে সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। যেহেতু মহিলাদের ঋণের একটা অগ্রাধিকার আছে সে কারণে অনেক বুদ্ধিমান পুরুষ তাদের স্ত্রীদের মেয়েদের সামনে দিয়ে নিজেই করছেন সব কিছু। অনেক মহিলা সই দেয়া ছাড়া কিছুই জানে না। অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের ‘লে-ো’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কাগজপত্রে মহিলা, কিন্তু বাস্তবে পুরুষরাই সব করছেন। এতে সত্যিকার অর্থে মহিলা উদ্যোক্তার জন্মও হচ্ছে না। বিকাশও হচ্ছে না। অথচ সত্যি সত্যি নারী উদ্যোক্তা আমাদের দরকার। তাই এই ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এগোনোই মঙ্গলজনক। তাড়াতাড়ি করলে মহিলা উদ্যোক্তা ঋণের ফান্ড ব্যয়িত হবে ঠিকই, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। আমি যে কথাটি বোঝাতে চাইছি তা হচ্ছে ঋণের গুণগতমান রক্ষা করার বিষয়টি। পরিমাণগতভাবে ঋণ বাড়া যতটুকু না জরুরী তার চেয়ে বেশি জরুরী ঋণের সদ্ব্যবহার ও গুণগত দিক রক্ষণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তা হচ্ছে না। ঋণ নিয়ে জমি কেনা হচ্ছে, ফ্ল্যাট কেনা হচ্ছে, ঋণের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিঘিœত। এই প্রবণতা রোধ না হলে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে ঠিকই। কাজের কাজ কিছুই হবে না বরং হবে মূল্যস্ফীতি এবং এ ঘটনাই ঘটছে বেশ কিছুদিন ধরে।
পরিশেষে যে খবরটির কথা (২৬.১২.১২) উল্লেখ করব তা হচ্ছে ‘ইউনিপে টু ইউ’, ‘ডেসটিনি ও ‘যুবকের’ কথা। দেশে এ ধরনের ৬২টি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি আছে বলে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে। এদের গ্রাহক সংখ্যা নাকি ৭০ লাখ। খবরে বলা হয়েছে এসব কোম্পানি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে না কি ২০ হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। আরও খবর এর ৮০ শতাংশ টাকাই নাকি বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এদের সম্পদের কোন খবর নেই। কাজেই সাধারণ মানুষ তাদের টাকা ফেরত পাবে তার কোন আশা নেই। কিছুদিন আগে হৈ চৈ হলো ‘হলমার্ক’কে নিয়ে। ইলমার্ক এর আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। তাদেরও সম্পদের কোন হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। এখানেও আশঙ্কা টাকা পাচার হয়েছে। এভাবে দেখা যাচ্ছে দেশে চলছে ‘সংগঠিত লুটপাট।’ তবে ‘মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির লুটপাটের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও সোনালী ব্যাংকের আমানতকারীরা হলমার্কের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। সোনালী ব্যাংক তার আমানতকারীর টাকা যথারীতি ফেরত দেবে। এটাই ব্যাংকে টাকা রাখলে লাভ। কোন ব্যাংক লালবাতি জ্বালালেও এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীরা সব টাকা ফেরত পাবে। আর ব্যাংকে জালিয়াতি হলে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এটা মনে রেখে দেশবাসী ‘এমএলএম’ কোম্পানিগুলোকে পরিহার করলে তারা বেঁচে যাবেন।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক বিআইবিএম
No comments