সমরেশ দেবনাথের কবিতা ভ্রমণ যুবক অনার্য ॥ কেউ কেউ কবি

সমরেশ দেবনাথ। নিমগ্ন চৈতন্যের কবি। তাঁর কবিতায় আছে উর্বর জমির বুকে উজ্জ্বল ফসল, কবিতার অমিত নির্যাস, তিনি যে মূলতই কবি ও ‘I ‘Committed to poetry’–এ কথার প্রমাণ মেলে যখন তিনি উচ্চারণ করেন :
ভুবনডাঙার হাটে
সমস্ত জীবনের বিনিময়ে
কেনা হলো একটি কবিতাÑ
(দ্রঃ শ্রেষ্ঠ কবিতা : সমরেশ দেবনাথ)
দুই বাঙালার উজ্জ্বলতম প্রাবন্ধিক তরুণ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কবিতায়ন’ গ্রন্থে সমরেশ সম্পর্কে লিখেছেনÑ ‘এই কবি উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। তাঁর পাঠ পরিধি বিস্ময়কর সম্ভ্রম আদায় করে। অথচ পা-িত্যের ভার নেই, ধার আছে, আছে উজ্জ্বলতা। কেমন কবিতা লিখতে চান কবি? বলেছেনÑ
যে কবিতা পাখির ঠোঁটে গিয়ে সঙ্গীত হয়
সেই কবিতা কাগজে ধরতে চাই।
(দ্রঃ ভূমিপুত্র প্রসঙ্গে : তরুণ মুখোপাধ্যায়)
বুদ্ধদেব বসু ১৯৫৩ সালে বলবো না বলবো না করেও আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা নির্ণয় করে ফেললেরনÑ‘এই আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকলভাবে শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানেরÑআবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনে সংগ্রাম আর আত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু ভিন্ন ভিন্ন কবিতে নয়, কখনো হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।’
বুদ্ধদেব নৈরাশ্যের ভাষা দিলেনÑ
নেই আর সেই তরুণ দিনের মাধুরী
কতদূর আজ নব-যৌবন গন্ধ
প্রতিদিন পিঠে পড়ে জীবিকার হাতুড়ি,
কলঙ্কী কাজে ঘণ্টা মিনিট অন্ধ।
এই বন্ধ্যা যুগকে সুধীন্দ্রনাথ দেখলেন উটপাখির চিত্রকল্পে। তাঁর কাছে মার্কসীয় ডায়ালেক্টাস্ মুক্তি আনে না, এক নিঃসীম শূন্যতায় নৈরাশ্যে ভরিয়ে দেনÑ
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া
(উটপাখি /অর্কেস্ট্রা)
কিন্তু আশাবাদী মার্ক্সবাদী বিষ্ণু দে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারায়নিÑ
জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার হৃদয়ে আমার চড়া
চোরাবালি আমি দূর-দিগন্তে ডাকিÑ
কোথায় ঘোড় সওয়ার?
দীপ্ত বিশ্ববিজয়ী, বর্শা তোলো
কেন ভয়, কেন বীরের ভরসা ভোলো।
(দ্রঃ ঘোড়সওয়ার/চোরাবালি)
বর্তমান সময়ের শক্তিশালী কবি সমরেশ দেবনাথ ‘গন্তব্য’ কবিতায় লিখলেনÑ
কিছু সন্দেহ, কিছু পাপবোধ থেকে
বের হয়ে দেখি জীবন আশ্চর্য সুন্দর।
বিপরীতক্রমে সর্বগ্রাসী ঘৃণা, অনিশ্চয়তা আর হতাশার ব্যাপ্তিতে চিৎকার করে ওঠে সার্ত্রের নায়কÑ
It makes itself one with cafe; I am the one who is within it.
আধুনিক মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু যেন হতাশার ঊর্ণাজাল আর অবিশ্বাসের হলাহল। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যুগে বিষাদময়তা এলিয়টের ‘thought’-এর পরিসরকে স্পর্শ করেছে এইভাবেÑ
Shaped without form, shade without colour
Paralysed force, gesture without motion
(The Hollow Men)
সমরেশ দেবনাথের মনস্তত্ত্বের মানুষ ভেঙে চুরমার হওয়ার কষ্টে লেখেনÑ
আগে ভাঙতোনা
মানুষ হওয়ার পর থেকে আমাদের স্বপ্ন ভাঙে।
(দ্রঃ স্বপ্ন ভাঙে, শরীর ভাঙে/চিরায়ত কবিতা)
প্রায়শ বিশ্বাসের মধ্যেও গ্রন্থিত হয় অবিশ্বাস। ফাদার সিয়ের্গি (টলস্টয়ের লেখা বড় গল্প)-কেও আত্মনিগ্রহের মধ্য দিয়ে নতুন করে বিশ্বাসকে সাজাতে হয়েছে। সমরেশও এর ব্যতিক্রম ননÑ
তোমাকে ভালোবেসে অর্ধেক পৃথিবী হারিয়েছি
বাকীটা হারাবো তোমাকে ঘৃণা করে
(দ্রঃ পরমাণু কবিতা/ভূমিপুত্র)
দৈহিক সংস্পর্শ যদি হয় শুধুই যান্ত্রিক তাহলে গভীরতম ডুব দিয়ে উঠে নারী ও পুরুষ উদাসীন হয়ে চলে যায় যে যার গন্তব্যে, কারো কোনো দায়িত্ব নেই।
The waste land এ এলিয়ট লিখেনÑ
Well, now that’s done; and I’m glad it’s over
আর জীবনানন্দ এলিয়টের এই উদাসীনতা নিয়ে ইয়েটসের কবিতায় রবিন্দ্রিক তন্ময়তা মিশিয়ে উচ্চারণ করলেন আশ্চর্য কঠিন পেলবতাÑ
ছায়া হয়ে গেছ বলে
তোমাকে এমন অসম্ভ্রব
সমরেশ দেবনাথের উচ্চারণও এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্যÑ
জোছনা সরে গেলে
নারী হয় সাপ
(দ্রঃ পরিণতি/শ্রেষ্ঠ কবিতা)
পারিবারিক অশান্তির জন্য কৈশরেই গৃহত্যাগ করেছিলেন আধুনিকতার জনক আর্তুর র্যাঁবো। প্যারিসে পৌঁছে বন্ধুর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পেলেন পল ভেরলেনকে। তারপর প্রকাশিত হলো ‘মাতাল তরণী’, ‘নরকে এক ঋতু’। র্যাঁবো গ্রাম ও প্রকৃতিভিত্তিক কবিতা আমাদের নিয়ে যায় তাঁর কিশোরবেলায়Ñ
On a summer night I will go through the field
Through the overgrown paths
(Feelings)

(ঋববষরহমং)
তেমনি ‘গ্রামে ফেরা’ কবিতায় সমরেশ লিখেছেনÑ
এইতো সবুজ চাদরে ঢাকা আমার শৈশব
যেখানে মার্বেল খেলছে এক বালক।
সমরেশ দেবনাথের প্রেমের কবিতায় ফ্রয়েডীয় অনুষঙ্গ পরিলক্ষিত হয়। যেমন ‘সম্পর্ক’ কবিতায় তিনি লিখেছেনÑ
ভুল সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে
এসেছি আমরা;
এখন সম্পর্ক ঠিক করতে গেলে
দুজনেই মিথ্যে হয়ে যাবো।
কবি আবুল হাসানের সৌন্দর্য চেতনার কথা স্মরণ রেখেও বলা যায় সমরেশ দেবনাথ কবিতায় সৌন্দর্য সৃষ্টিতে দক্ষ। তিনি শৈলী নির্মাণেও দক্ষÑএ কথার প্রমাণ মেলে তাঁর রস কাব্য ‘মৃত্তিকা কন্যা’য়। টাঙ্গাইল জেলার আঞ্চলিক ভাষায় লেখা এই কাব্যটিকে কবি স্বয়ং ‘রসকাব্য’ বলেছেন। বান্দরী নাম্নী এক নারীর বেড়ে ওঠা, প্রণয়, সম্ভোগ, বিবাহ ইত্যাদি চৌদ্দটি ছবকে বলা হয়েছে। কবি এখানে গায়েনের ভূমিকা নিয়েছেন। গ্রাম-বাংলার রূপরস-স্পর্শগন্ধ এর পরতে পরতে। ভদ্রকাব্য না লিখে জনকাব্য লিখেছেন সমরেশ দেবনাথ। কবি জসীম উদদীনের পর এহেন প্রচেষ্টা আর চোখে পড়েনি। সমরেশ দেবনাথ ‘মৃত্তিকা কন্যা’য় মিলনদৃশ্যে লিখেছেনÑ
এবার খাট্টাশ বান্দরীরে নিয়ে
ঘরে দিল খিল
খাট্টাশের পিঠে পড়ুক
নরম হাতের মিষ্টি কিল।
সমরেশ দেবনাথের কবিতা পড়ে ওপার বাংলার বিশিষ্ট কবি দেবারতি মিত্র লিখেছেনÑসমরেশ দেবনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়ে মনে হয় মেশতা পাটের গন্ধ, গিমাশাকের সবুজাভায়, পোয়াতি বিলের স্নানে, পোয়াপিঠের স্বাদে তিনি আচ্ছন্ন। তিনি ঘোষণা করেনÑ‘প্রযতেœ-ট্রযতেœ নয়, আমি সরাসরি ভূমিপুত্র’। আবহমান বাংলাদেশ যেন কবির বুকে স্থায়ী হয়ে আছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়কেও অস্বীকার করেননি তিনি। তার মনে প্রশ্ন জাগে-কবিতার উৎপাদন খরচ কত? তিনি এও দেখতে পান পৃথিবীর ছোট বড় চেয়ারে বসে ডলারেরা, এমন কী ফুলেকে নির্দেশ দেয় বেশি করে ফুটতে!
সমরেশের সূক্ষ্ম অনুভূতি আমাদেরও নতুনত্বের মুখ দেখায়। কেঁচো বিষয়ে তার প্রকৃতি পাঠÑ‘চোখ নেই’ ত্বক দিয়ে তোমাদের দেখি’। তার কবিতার গভীর থেকে দর্শন বের হয়ে আসেÑ
একটিই মাত্র রাস্তা
তার এক পাশে সময়
অন্যপাশে শূন্যতা।
(দ্রঃ কবিতা সমগ্র : সমরেশ দেবনাথ)
আধুনিক বাংলা কবিতার সম্রাট জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থে লিখেছেন, সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি, শক্তিশালী কবি সমরেশ দেবনাথ অবশ্যই ‘কেউ কেউ কবি’র মধ্যে অন্যতম কবি ব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.