চারদিক- ‘আমরা তোমাদেরই লোক’ by প্রণব বল
যানজট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মনটা স্নিগ্ধতায় ভরে উঠল। দুই পাশে ফুল ও ফলমূলের বাগান, দু-একটি ঔপনিবেশিক আমলের দালানকোঠা। মূল শহরের চাকচিক্য এখানে কোথায়! আরেকটু সামনে পা বাড়াতেই চোখ আটকে গেল একটা দালানের নিচতলার বারান্দায়।
সেখানে হইচই করে খেলছিল কয়েকটি শিশু। কাছাকাছি যেতেই দৌড়ে এসে ‘শুভ সকাল’ বলে জড়িয়ে ধরল, কেউ বা হাত মেলাল। খটকা লাগল! আমাদের কি তারা চেনে?
চট্টগ্রামের পাথরঘাটার সেন্ট বেনেডিক্ট নার্সারি ও সেন্ট পিটারস অরফানেজের শিশু ওরা। প্রকৃতি ও সমাজের অবহেলায় তাদের অন্ধকারের স্রোতে ভেসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কিছু মানুষের দয়ার্দ্র হাত তাদের তুলে এনেছে মানুষের কাতারে। শতবর্ষের পুরোনো এই অরফানেজই তাদের ঘরবাড়ি। অরফানেজ-প্রধান সিস্টার ও ‘মাসি’রা তাদের মা-বাবা।
সেন্ট বেনেডিক্ট নার্সারিতে ৪৭ জন শিশু এবং পিটারস অরফানেজে রয়েছে ৪৩ জন কিশোরী। এতিমখানা দুটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১২ সালে। আজ ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হচ্ছে শতবর্ষ পূর্তি উৎসব। চট্টগ্রাম ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশের অধীনে আরএনডিএম সিস্টাররা এ দুটি প্রতিষ্ঠান চালান। মাঝেমধ্যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুদান দিয়ে সাহায্য করে।
বেনেডিক্ট নার্সারিতে নবজাতক থেকে ছয়-সাত বছর বয়সী শিশুরা এবং পিটারস অরফানেজে থাকে কিশোরীরা। এখানেই তাদের বেড়ে ওঠা, খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলা এবং পড়ালেখা চলছে। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা এসব শিশুর জীবনে রয়েছে একেক ধরনের কাহিনি।
ইনোসেন্টের কথাই ধরা যাক। তার কাহিনি শোনান অরফানেজের প্রধান সিস্টার বিবিয়ানা। ‘তার মা একদিন বাচ্চাটিকে নিয়ে এখানে চলে আসেন। কোনো পিতৃপরিচয় নেই। মা হয়ে তিনি ওই বাচ্চাকে রাখতে চান না।’
ইনোসেন্ট নামটিও সিস্টারের দেওয়া। ১০ মাসের নিষ্পাপ এই শিশু তখন ঘুমাচ্ছে। আরেকজন ‘মাসি’ বারবার গিয়ে দেখছেন বিছানা ভিজে গেছে কি না। তাতে যে ঠান্ডা লেগে যাবে! এভাবে একদিন হয়তো বড় হয়ে উঠবে ইনোসেন্ট। পরম উষ্ণতায়, মায়ের মমতায়।
দিবার বয়স কত আর হবে, বড়জোর পাঁচ বছর। এতিমখানার সামনের আঙিনায় অন্যদের সঙ্গে খেলছে। সহপাঠী একজন বলে উঠল, ‘দিবা গান গায়।’ দুই গাল প্রসারিত করে দিবার ফোকলা দাঁতের হাসি, একটু লজ্জাও পেল। অনুরোধ করতেই দিবা গেয়ে উঠল ‘ডার্লিং ডার্লিং...’। কে বলবে হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটির অন্তঃপুরে অপূর্ণতার দহন?
২০০৭ সালের কোনো এক সকালে সেন্ট বেনেডিক্টের ফটকের সামনে নবজাতক দিবাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল কেউ। তার এক বছর আগে একইভাবে প্রতিষ্ঠানটির ফটকের সামনে পাওয়া গিয়েছিল আরেক নবজাতককে। দিবার মতো সে-ও বেড়ে উঠেছে এখানে। তার নাম দেওয়া হয় অনুক্ষণ।
নবজাতক এসব শিশুকে খাওয়ানো, যত্ন নেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো—সবই করতে হয় সিস্টার ও মাসিদের। ১৩ জন মাসি বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন। পড়ালেখার দায়িত্বও নিতে হয় তাঁদের। সইতে হয় নানা আবদার-দুষ্টুমিও। মাসিদের এটা চাকরি। কিন্তু একধরনের মায়ার জালে জড়িয়ে গেছেন তাঁরাও।
যেমন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের রূপনা। ‘আমার নিজের ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু এসব ছোট ছোট বাচ্চার কাজ করতে আমার কোনো ক্লান্তি লাগে না।’ বললেন রূপনা।
মহিমা এ এতিমখানায় বড় হয়েছেন। এখন তিনিও তাঁর উত্তরসূরিদের পরিচর্যার দায়িত্ব নিয়েছেন। এ এতিমখানায় বড় হওয়া অনেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকতাসহ নানা পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এখানে পরিচয়হীন শিশুর পাশাপাশি বাবা কিংবা মা আছে—এ রকম শিশুরাও থাকে। অনেক মা-বাবা দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা চাকরির কারণে শিশু প্রতিপালন করতে পারেন না। তাঁরা শিশুদের এখানে নিয়ে আসেন।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরের নাসরিন এক বছর বয়সে এ প্রতিষ্ঠানে আসে। তার মা নিজেই তাকে এখানে দিয়ে যান। বাবা নেই। যে যেখান থেকেই আসুক, তাদের একটাই পরিচয়—তারা এতিম।
যাদের মা কিংবা স্বজন আছে, তাঁরা শিশুদের দেখতে আসেন। তখন মা-বাবার পরিচয়হীন এতিমেরা হাহাকার করে ওঠে। ‘কারও স্বজন এলে এতিমেরা জানতে চায় তাদের বাবা-মায়ের নাম কী? তাঁরা কবে আসবেন? আমরা ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখি তাদের। মাতৃস্নেহ তো আর কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করি আনন্দের সঙ্গে তাদের বড় করতে।’ শিশুদের বেদনার কথা বিবিয়ানার ভাষায় প্রকাশিত হয়।
টিভি দেখা, নিয়মিত খেলাধুলা করা, গান-নাচ, পড়ালেখা ইত্যাদিতে আনন্দেই কেটে যাচ্ছে স্বপ্না, নাসরিন, পূজাদের দিনকাল। আনন্দিত এসব শিশুমনে অব্যক্ত একটি ব্যথা হয়তো উঁকি দেয় মাঝেমধ্যে। সেটি মা-বাবা ও স্বজনের ভালোবাসার অভাব। সেই ভালোবাসার টানেই কিনা অচেনা-অজানা আমাদের দিকে ছুটে এল অবহেলিত এসব শিশু! তারা যেন বলতে চাইছে, ‘আমাদের অবজ্ঞা কোরো না। আমরা তোমাদেরই লোক।’
প্রণব বল
চট্টগ্রামের পাথরঘাটার সেন্ট বেনেডিক্ট নার্সারি ও সেন্ট পিটারস অরফানেজের শিশু ওরা। প্রকৃতি ও সমাজের অবহেলায় তাদের অন্ধকারের স্রোতে ভেসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কিছু মানুষের দয়ার্দ্র হাত তাদের তুলে এনেছে মানুষের কাতারে। শতবর্ষের পুরোনো এই অরফানেজই তাদের ঘরবাড়ি। অরফানেজ-প্রধান সিস্টার ও ‘মাসি’রা তাদের মা-বাবা।
সেন্ট বেনেডিক্ট নার্সারিতে ৪৭ জন শিশু এবং পিটারস অরফানেজে রয়েছে ৪৩ জন কিশোরী। এতিমখানা দুটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১২ সালে। আজ ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হচ্ছে শতবর্ষ পূর্তি উৎসব। চট্টগ্রাম ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশের অধীনে আরএনডিএম সিস্টাররা এ দুটি প্রতিষ্ঠান চালান। মাঝেমধ্যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুদান দিয়ে সাহায্য করে।
বেনেডিক্ট নার্সারিতে নবজাতক থেকে ছয়-সাত বছর বয়সী শিশুরা এবং পিটারস অরফানেজে থাকে কিশোরীরা। এখানেই তাদের বেড়ে ওঠা, খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলা এবং পড়ালেখা চলছে। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা এসব শিশুর জীবনে রয়েছে একেক ধরনের কাহিনি।
ইনোসেন্টের কথাই ধরা যাক। তার কাহিনি শোনান অরফানেজের প্রধান সিস্টার বিবিয়ানা। ‘তার মা একদিন বাচ্চাটিকে নিয়ে এখানে চলে আসেন। কোনো পিতৃপরিচয় নেই। মা হয়ে তিনি ওই বাচ্চাকে রাখতে চান না।’
ইনোসেন্ট নামটিও সিস্টারের দেওয়া। ১০ মাসের নিষ্পাপ এই শিশু তখন ঘুমাচ্ছে। আরেকজন ‘মাসি’ বারবার গিয়ে দেখছেন বিছানা ভিজে গেছে কি না। তাতে যে ঠান্ডা লেগে যাবে! এভাবে একদিন হয়তো বড় হয়ে উঠবে ইনোসেন্ট। পরম উষ্ণতায়, মায়ের মমতায়।
দিবার বয়স কত আর হবে, বড়জোর পাঁচ বছর। এতিমখানার সামনের আঙিনায় অন্যদের সঙ্গে খেলছে। সহপাঠী একজন বলে উঠল, ‘দিবা গান গায়।’ দুই গাল প্রসারিত করে দিবার ফোকলা দাঁতের হাসি, একটু লজ্জাও পেল। অনুরোধ করতেই দিবা গেয়ে উঠল ‘ডার্লিং ডার্লিং...’। কে বলবে হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটির অন্তঃপুরে অপূর্ণতার দহন?
২০০৭ সালের কোনো এক সকালে সেন্ট বেনেডিক্টের ফটকের সামনে নবজাতক দিবাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল কেউ। তার এক বছর আগে একইভাবে প্রতিষ্ঠানটির ফটকের সামনে পাওয়া গিয়েছিল আরেক নবজাতককে। দিবার মতো সে-ও বেড়ে উঠেছে এখানে। তার নাম দেওয়া হয় অনুক্ষণ।
নবজাতক এসব শিশুকে খাওয়ানো, যত্ন নেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো—সবই করতে হয় সিস্টার ও মাসিদের। ১৩ জন মাসি বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন। পড়ালেখার দায়িত্বও নিতে হয় তাঁদের। সইতে হয় নানা আবদার-দুষ্টুমিও। মাসিদের এটা চাকরি। কিন্তু একধরনের মায়ার জালে জড়িয়ে গেছেন তাঁরাও।
যেমন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের রূপনা। ‘আমার নিজের ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু এসব ছোট ছোট বাচ্চার কাজ করতে আমার কোনো ক্লান্তি লাগে না।’ বললেন রূপনা।
মহিমা এ এতিমখানায় বড় হয়েছেন। এখন তিনিও তাঁর উত্তরসূরিদের পরিচর্যার দায়িত্ব নিয়েছেন। এ এতিমখানায় বড় হওয়া অনেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকতাসহ নানা পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এখানে পরিচয়হীন শিশুর পাশাপাশি বাবা কিংবা মা আছে—এ রকম শিশুরাও থাকে। অনেক মা-বাবা দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা চাকরির কারণে শিশু প্রতিপালন করতে পারেন না। তাঁরা শিশুদের এখানে নিয়ে আসেন।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরের নাসরিন এক বছর বয়সে এ প্রতিষ্ঠানে আসে। তার মা নিজেই তাকে এখানে দিয়ে যান। বাবা নেই। যে যেখান থেকেই আসুক, তাদের একটাই পরিচয়—তারা এতিম।
যাদের মা কিংবা স্বজন আছে, তাঁরা শিশুদের দেখতে আসেন। তখন মা-বাবার পরিচয়হীন এতিমেরা হাহাকার করে ওঠে। ‘কারও স্বজন এলে এতিমেরা জানতে চায় তাদের বাবা-মায়ের নাম কী? তাঁরা কবে আসবেন? আমরা ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখি তাদের। মাতৃস্নেহ তো আর কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করি আনন্দের সঙ্গে তাদের বড় করতে।’ শিশুদের বেদনার কথা বিবিয়ানার ভাষায় প্রকাশিত হয়।
টিভি দেখা, নিয়মিত খেলাধুলা করা, গান-নাচ, পড়ালেখা ইত্যাদিতে আনন্দেই কেটে যাচ্ছে স্বপ্না, নাসরিন, পূজাদের দিনকাল। আনন্দিত এসব শিশুমনে অব্যক্ত একটি ব্যথা হয়তো উঁকি দেয় মাঝেমধ্যে। সেটি মা-বাবা ও স্বজনের ভালোবাসার অভাব। সেই ভালোবাসার টানেই কিনা অচেনা-অজানা আমাদের দিকে ছুটে এল অবহেলিত এসব শিশু! তারা যেন বলতে চাইছে, ‘আমাদের অবজ্ঞা কোরো না। আমরা তোমাদেরই লোক।’
প্রণব বল
No comments