পাহাড়ের সুখ-দুঃখ- আদিবাসী নারীর নিরাপত্তাহীনতা by হরি কিশোর চাকমা
তুমা চিং মারমা (১৫) রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার কলমপতি ইউনিয়নের বড়ডলুপাড়ার দরিদ্র পরিবারের কিশোরী। সে কাউখালী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। সে যখন আরও ছোট ছিল, তখন তার বাবা মারা যান।
মা তাকে নিয়ে ছোট একটা পাখির বাসার মতো বাড়িতে থাকেন। সেই বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ গজ দূরে পাহাড়ের ঢালুতে তুমা চিং মারমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ২১ ডিসেম্বর বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। সে গিয়েছিল সেই পাহাড়ে নিজেদের পালিত গরু আনতে। ২৪ ডিসেম্বর তুমা চিং মারমার বাড়িতে গেলে তার বিধবা মা মাজেই প্রু মারমা কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলছিলেন, ‘আমি কেন গরু আনতে গেলাম না, কেন তাকে পাঠালাম। আমার মেয়ের কী দোষ? কেন তাকে এভাবে মরতে হলো?’
আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তাহীনতা এখন এক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। আদিবাসীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো নারীদের সম্মান করা। হয়তো উত্তরাধিকার আইনে নারীদের অধিকার নেই কিন্তু আদিবাসীরা নারীদের সম্মান করে। আদিবাসীদের ভাষায় ‘ধর্ষণ’ শব্দটিরই অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়া আদিবাসী নারীরা একা একা চলতে-ফিরতে কোনো দিনই সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বাধার সম্মুখীন হয় না। আর এখন বাড়ি থেকে ২০০-৩০০ গজ দূরেও আদিবাসী নারীরা নিরাপদ নয়।
তুমা চিং মারমার মতো লংগদু উপজেলার আটরকছড়া ইউনিয়নে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সুজাতা চাকমাকে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হতে হয়েছিল গ্রামের পাশের মাঠ থেকে গরু আনতে গিয়ে। সুজাতা চাকমার ধর্ষক ও হত্যাকারী মো. ইব্রাহিম একই এলাকায় অপর এক আদিবাসী শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় আট মাস জেলে থাকার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসেছিল। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় এক ত্রিপুরা আদিবাসী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল একইভাবে গরু আনতে গিয়ে। রাঙামাটির শহরতলী ভেদভেদীতে বলিমিলে এক চাকমা মেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিলেন পাড়ার পাশের নদীতে গোসল করতে গিয়ে। এসব ঘটনায় প্রতিবাদ হয়েছে সামান্য। ঘটনার কয়েক দিন পর সবাই ভুলে যায় যে এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল।
শুধু চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় আদিবাসী নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২০ জন। সেই সঙ্গে যোগ হলো তুমা চিং মারমার নাম। ২০১১ সালে আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০ জন। এটি কাপেং ফাউন্ডেশন নামের একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাব। সংস্থাটির হিসাবমতে, চলতি বছর আদিবাসী নারীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৫১টি, যা ২০১১ সালে ছিল ৩১টি এবং ২০০৮ সালে চারটি।
অপর দিকে মালেয়া ফাউন্ডেশনের ২০১২ সালের মানবাধিকারসংক্রান্ত প্রতিবেদনে আদিবাসী নারীদের প্রতি সহিংসতার হার সবচেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে মার্চ-এপ্রিলে ৩৯ শতাংশ, মে-জুনে ২০ শতাংশ এবং আগস্ট-অক্টোবরে ৩৫ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগ করে ‘আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা’ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে তথ্য পেয়েছে, তাতে দেখা যায় যে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বান্দরবান জেলায় ২২টি, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় ১৭টি করে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায় ১৪টি করে এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ১২টি মামলার চার্জশিট তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদন ফাইল করা হয়েছে বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় পাঁচটি করে এবং রাঙামাটি জেলায় তিনটি। মামলার শুনানি হয়েছে বান্দরবানে দুটি এবং রাঙামাটিতে চারটি। বান্দরবান ও রাঙামাটিতে দুটি করে মামলার রায় হলেও কোনো দোষী ব্যক্তির সাজা হয়নি। (তথ্যসূত্র: নিরাপদ গৃহ, নিরাপদ সমাজ: পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, মেঘনা গুহঠাকুরতা)
এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলেছে ব্যাপক হারে। এ নিয়ে এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী অধিকার কর্মী ও সচেতন মানুষের মধ্যে ব্যাপক চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রতিকারের উপায় কী, তা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না।
এখন তুমা চিং মারমার মায়ের কথায় আসি। যে জায়গায় হেসেখেলে ১৪টি বছর পার করেছে তুমা চিং আর তার মা, যে জায়গার প্রতিটি বালুকণা কেমন বলতে পারে তারা, সেই জায়গায় তুমা চিং নিজে অথবা তার মা নিজের মেয়ের সামান্যতম বিপদের গন্ধ পেতে পারেন? যদিও এক দিন আগে ওই পাহাড়ের দখল নিয়ে একজন বাঙালির সঙ্গে স্থানীয় এক আদিবাসীর কিছুটা ঝগড়া হয়েছিল। আদিবাসী সমাজ-সংস্কৃতির কথা চিন্তা করলে এটা অকল্পনীয় যে নিজের আঙিনায় আদিবাসী নারী নিরাপত্তাহীন! নিরাপত্তাহীনতার সামান্যতম চিন্তা মাথায় এলে বিধবা মাজেই প্রু মারমা কি নিজের মেয়েকে সেখানে গরু আনতে পাঠাতেন? অবশ্যই না। তার মানে, পরিবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মিশ্র সংস্কৃতি আর পরিবেশে আদিবাসী নারীদের পদে পদে বিপদের ফাঁদ তৈরি হচ্ছে। সে কারণে আদিবাসী নারীদের ওপর ধর্ষণ আর সহিংসতা বাড়ছে। সেটা আরও বেশি বাড়ছে আদিবাসী বাঙালির রাজনৈতিক বিরোধ, সাম্প্রদায়িক নানা টানাপোড়েন, ভূমি নিয়ে বিরোধ, কর্মসংস্থানের অভাব, খাদ্য উৎপাদন, দূরদূরান্ত থেকে পানীয় জলের সংস্থানসহ নানা কারণে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি নারী অন্য সম্প্রদায়ের পুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না। তার অন্যতম কারণ বাঙালি সম্প্রদায়ের পারিবারিক ও সামাজিক রক্ষণশীলতা। কিন্তু আদিবাসীদের সেই রক্ষণশীলতা নেই। আদিবাসীরা নারী-পুরুষ একসঙ্গে মাঠেঘাটে কাজ করেন। বলতে গেলে গ্রামীণ আদিবাসী সমাজে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি পরিশ্রম করেন। আর পারিবারিক কিছু কাজ একদম নারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট। যেমন নদী বা কুয়া বা ছড়া থেকে পানি আনা, জুমে পাখি তাড়ানো, খেত থেকে সবজি তোলা ইত্যাদি নারীরই কাজ হিসেবে দেখা হয়। সেটা যত দূরই হোক। আর যে পরিবারে পুরুষের সংখ্যা কম, সেই পরিবারে নারীরাই পুরুষের কাজগুলো করেন। এসব কারণে নারীরা খুব সহজে সহিংসতার শিকার হন। নারীদের জন্য নিরাপদ, চিন্তাহীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহে যদি হিংসার সংস্কৃতি, মানসিক বিকৃতির সংস্কৃতি এসে যায়, তাতে নারীরা নিরাপদ থাকার কথা নয়। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তাহীনতা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ছে।
নারীর প্রতি সহিংসতাকে রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে তোলা না গেলে এটা বাড়তেই থাকবে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসন যদি সহিংসতা দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে, তা হলে সহিংসতার হার কমবে। সর্বশেষ নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে দলমত, সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিরোধ গড়ে না তোলা পর্যন্ত সহিংসতা বন্ধ করা যাবে না।
হরি কিশোর চাকমা: সাংবাদিক।
আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তাহীনতা এখন এক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। আদিবাসীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো নারীদের সম্মান করা। হয়তো উত্তরাধিকার আইনে নারীদের অধিকার নেই কিন্তু আদিবাসীরা নারীদের সম্মান করে। আদিবাসীদের ভাষায় ‘ধর্ষণ’ শব্দটিরই অস্তিত্ব নেই। এ ছাড়া আদিবাসী নারীরা একা একা চলতে-ফিরতে কোনো দিনই সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বাধার সম্মুখীন হয় না। আর এখন বাড়ি থেকে ২০০-৩০০ গজ দূরেও আদিবাসী নারীরা নিরাপদ নয়।
তুমা চিং মারমার মতো লংগদু উপজেলার আটরকছড়া ইউনিয়নে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সুজাতা চাকমাকে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হতে হয়েছিল গ্রামের পাশের মাঠ থেকে গরু আনতে গিয়ে। সুজাতা চাকমার ধর্ষক ও হত্যাকারী মো. ইব্রাহিম একই এলাকায় অপর এক আদিবাসী শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় আট মাস জেলে থাকার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসেছিল। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় এক ত্রিপুরা আদিবাসী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল একইভাবে গরু আনতে গিয়ে। রাঙামাটির শহরতলী ভেদভেদীতে বলিমিলে এক চাকমা মেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিলেন পাড়ার পাশের নদীতে গোসল করতে গিয়ে। এসব ঘটনায় প্রতিবাদ হয়েছে সামান্য। ঘটনার কয়েক দিন পর সবাই ভুলে যায় যে এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল।
শুধু চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় আদিবাসী নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২০ জন। সেই সঙ্গে যোগ হলো তুমা চিং মারমার নাম। ২০১১ সালে আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০ জন। এটি কাপেং ফাউন্ডেশন নামের একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাব। সংস্থাটির হিসাবমতে, চলতি বছর আদিবাসী নারীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৫১টি, যা ২০১১ সালে ছিল ৩১টি এবং ২০০৮ সালে চারটি।
অপর দিকে মালেয়া ফাউন্ডেশনের ২০১২ সালের মানবাধিকারসংক্রান্ত প্রতিবেদনে আদিবাসী নারীদের প্রতি সহিংসতার হার সবচেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে মার্চ-এপ্রিলে ৩৯ শতাংশ, মে-জুনে ২০ শতাংশ এবং আগস্ট-অক্টোবরে ৩৫ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগ করে ‘আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা’ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে তথ্য পেয়েছে, তাতে দেখা যায় যে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বান্দরবান জেলায় ২২টি, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় ১৭টি করে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায় ১৪টি করে এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ১২টি মামলার চার্জশিট তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদন ফাইল করা হয়েছে বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় পাঁচটি করে এবং রাঙামাটি জেলায় তিনটি। মামলার শুনানি হয়েছে বান্দরবানে দুটি এবং রাঙামাটিতে চারটি। বান্দরবান ও রাঙামাটিতে দুটি করে মামলার রায় হলেও কোনো দোষী ব্যক্তির সাজা হয়নি। (তথ্যসূত্র: নিরাপদ গৃহ, নিরাপদ সমাজ: পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, মেঘনা গুহঠাকুরতা)
এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলেছে ব্যাপক হারে। এ নিয়ে এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী অধিকার কর্মী ও সচেতন মানুষের মধ্যে ব্যাপক চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রতিকারের উপায় কী, তা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না।
এখন তুমা চিং মারমার মায়ের কথায় আসি। যে জায়গায় হেসেখেলে ১৪টি বছর পার করেছে তুমা চিং আর তার মা, যে জায়গার প্রতিটি বালুকণা কেমন বলতে পারে তারা, সেই জায়গায় তুমা চিং নিজে অথবা তার মা নিজের মেয়ের সামান্যতম বিপদের গন্ধ পেতে পারেন? যদিও এক দিন আগে ওই পাহাড়ের দখল নিয়ে একজন বাঙালির সঙ্গে স্থানীয় এক আদিবাসীর কিছুটা ঝগড়া হয়েছিল। আদিবাসী সমাজ-সংস্কৃতির কথা চিন্তা করলে এটা অকল্পনীয় যে নিজের আঙিনায় আদিবাসী নারী নিরাপত্তাহীন! নিরাপত্তাহীনতার সামান্যতম চিন্তা মাথায় এলে বিধবা মাজেই প্রু মারমা কি নিজের মেয়েকে সেখানে গরু আনতে পাঠাতেন? অবশ্যই না। তার মানে, পরিবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মিশ্র সংস্কৃতি আর পরিবেশে আদিবাসী নারীদের পদে পদে বিপদের ফাঁদ তৈরি হচ্ছে। সে কারণে আদিবাসী নারীদের ওপর ধর্ষণ আর সহিংসতা বাড়ছে। সেটা আরও বেশি বাড়ছে আদিবাসী বাঙালির রাজনৈতিক বিরোধ, সাম্প্রদায়িক নানা টানাপোড়েন, ভূমি নিয়ে বিরোধ, কর্মসংস্থানের অভাব, খাদ্য উৎপাদন, দূরদূরান্ত থেকে পানীয় জলের সংস্থানসহ নানা কারণে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি নারী অন্য সম্প্রদায়ের পুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না। তার অন্যতম কারণ বাঙালি সম্প্রদায়ের পারিবারিক ও সামাজিক রক্ষণশীলতা। কিন্তু আদিবাসীদের সেই রক্ষণশীলতা নেই। আদিবাসীরা নারী-পুরুষ একসঙ্গে মাঠেঘাটে কাজ করেন। বলতে গেলে গ্রামীণ আদিবাসী সমাজে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি পরিশ্রম করেন। আর পারিবারিক কিছু কাজ একদম নারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট। যেমন নদী বা কুয়া বা ছড়া থেকে পানি আনা, জুমে পাখি তাড়ানো, খেত থেকে সবজি তোলা ইত্যাদি নারীরই কাজ হিসেবে দেখা হয়। সেটা যত দূরই হোক। আর যে পরিবারে পুরুষের সংখ্যা কম, সেই পরিবারে নারীরাই পুরুষের কাজগুলো করেন। এসব কারণে নারীরা খুব সহজে সহিংসতার শিকার হন। নারীদের জন্য নিরাপদ, চিন্তাহীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহে যদি হিংসার সংস্কৃতি, মানসিক বিকৃতির সংস্কৃতি এসে যায়, তাতে নারীরা নিরাপদ থাকার কথা নয়। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তাহীনতা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ছে।
নারীর প্রতি সহিংসতাকে রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে তোলা না গেলে এটা বাড়তেই থাকবে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসন যদি সহিংসতা দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে, তা হলে সহিংসতার হার কমবে। সর্বশেষ নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে দলমত, সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিরোধ গড়ে না তোলা পর্যন্ত সহিংসতা বন্ধ করা যাবে না।
হরি কিশোর চাকমা: সাংবাদিক।
No comments