ঢাকায় একজন নিহত-দিনদুপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৬

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদস্যদের সঙ্গে দিনদুপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নরসিংদীতে ছয়জন এবং রাজধানীতে একজন নিহত হয়েছেন। র‌্যাব জানিয়েছে, নরসিংদীতে গতকাল সোমবার দুপুরে নিহত ব্যক্তিরা ছিনতাইকারী।


আর রাজধানীর মিরপুরে রোববার রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ব্যক্তি সন্ত্রাসী বলে দাবি করেছে র‌্যাব। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিহত যুবক শারীরিক প্রতিবন্ধী। রোববার দুপুরে কেরানীগঞ্জের বাসার সামনে থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
নরসিংদীর ঘটনা: র‌্যাব জানায়, সদর উপজেলার নরসিংদী-মদনগঞ্জ সড়কের খাটেহারা নামক স্থানে গতকাল বেলা পৌনে তিনটার দিকে বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে ছয়জন নিহত ও র‌্যাবের দুই সদস্যসহ পাঁচজন আহত হন। র‌্যাব চার ছিনতাইকারীকে আটক করেছে। ঘটনাস্থল থেকে ছিনতাইকারীদের ব্যবহূত তিনটি পিস্তল, একটি কাটা বন্দুক, তিনটি গুলি ও নগদ ৪০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
নরসিংদী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনের পরিচয় জানিয়েছেন। তাঁরা হলেন: সদর উপজেলার বিলাসদী মহল্লার হোসেন মোল্লার ছেলে নাহিদ মিয়া (২৮), ভেলানগর মহল্লার আবুল হোসেনের ছেলে আরিফ মিয়া (৩৩), পাঁচদোনা এলাকার আবদুল আউয়ালের ছেলে মোশারফ হোসেন ও শিবপুর উপজেলার কারারচর গ্রামের জামাল মিয়া (৪৫)। অন্য দুজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিহত ও গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা মামলা আছে কি না, তাৎক্ষণিকভাবে ওসি জানাতে পারেননি।
র‌্যাবের মুখে ঘটনার বর্ণনা: র‌্যাব-১১-এর নরসিংদী ক্যাম্প সূত্রে জানা যায়, গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে একজন ব্যবসায়ী র‌্যাবের নরসিংদীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে ফোন করে জানান, তিনি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছেন। ছিনতাইকারীরা তাঁর ৪০ হাজার টাকা লুট করে একটি সাদা মাইক্রোবাসে পালিয়েছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন টহলদলকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় র‌্যাবের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি টহলদল সাদা পোশাকে মাইক্রোবাস নিয়ে সদর উপজেলার নরসিংদী-মদনগঞ্জ সড়কে টহল দিচ্ছিল। র‌্যাবের মাইক্রোবাস খাটেহারা এলাকায় পৌঁছার পর গাড়িটিকে সাধারণ জনগণের গাড়ি ভেবে ছিনতাইকারীরা রাস্তার ওপর একটি ট্রাক রেখে মাইক্রোবাসের গতিরোধ করে। প্রায় একই সময় ট্রাকের পেছনে এসে থামে ছিনতাইকারীদের আরেকটি মাইক্রোবাস। ওই মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন ছিনতাইকারী বেরিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। এ সময় র‌্যাব সদস্যরা ছিনতাইকারীদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি ছোড়েন। দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় আধা ঘণ্টা চলে বন্দুকযুদ্ধ। একপর্যায়ে র‌্যাবের আরও তিনটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। একসময় ছিনতাইকারীরা সড়কের দুই পাশের ধানের জমি দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। বন্দুকযুদ্ধ শেষে র‌্যাব সদস্যরা দেখতে পান, ছিনতাইকারীদের মাইক্রোবাসে দুজনের লাশ পড়ে আছে। ট্রাকের ভেতরে রয়েছে একজনের লাশ। এ ছাড়া সড়কের ওপর একজন এবং সড়কের দুই পাশে আরও দুজনের লাশ পাওয়া যায়।
পালিয়ে যাওয়ার সময় চার ছিনতাইকারীকে আটক করে র‌্যাব। তাঁরা হলেন: নরসিংদী শহরের বিলাসদী এলাকার হারুন মিয়ার ছেলে শাওন মিয়া (২৫), একই উপজেলার পাঁচদোনা গ্রামের সুরুজ মিয়ার ছেলে মনির হোসেন ৩২), রায়পুরা উপজেলার পিরিজকান্দী গ্রামের সুরেশ চন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে অমর বিশ্বাস (৩২) ও শিবপুর উপজেলার কুমরাদী গ্রামের আমিন উদ্দিনের ছেলে মাসুম মিয়া (২৭)। তাঁদের মধ্যে মনির বাদে অন্য তিনজন গুলিবিদ্ধ। তাঁদের প্রথমে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ওপর একটি সাদা মাইক্রোবাস পড়ে আছে। মাইক্রোবাসের সামনে-পেছনে ও চারপাশের কাচ গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে, আসন থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে সড়কে। ট্রাকের সামনের কাচে গুলির ছিদ্র রয়েছে। আশপাশের এলাকার শত শত লোক সেখানে ভিড় জমিয়েছে। ঘটনাস্থলের চার কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতবাড়ি নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীর কথা: পাশের বাগহাটা গ্রামের বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তার ওপর হঠাৎ গুলির শব্দে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। শব্দ থামার পর শুনি, র‌্যাব ও ছিনতাইকারীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। ঘটনাস্থলে ছুটে এসে দেখি, মাইক্রোবাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন জায়গায় লাশ পড়ে আছে। ধানের জমিতে ছিনতাইকারীদের খুঁজছে র‌্যাব।’
গ্রেপ্তার হওয়া মনির হোসেন সাংবাদিকদের জানান, তিনি পাঁচদোনা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী। পূর্বপরিচিত জামাল নামের এক ব্যক্তি তাঁকে কাজের কথা বলে সঙ্গে নিয়ে আসে। তারা যাওয়ার পথে তাঁকে নরসিংদী নতুন বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দেয়। পরে গুলির শব্দ শুনে এগিয়ে এলে র‌্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার হওয়া মাছুম জানান, তিনি পেশায় গাড়িচালক। জামাল তাঁকে কাজের কথা বলে মাইক্রোতে তুলে নিয়ে আসে। পথে এ ঘটনা ঘটে। তাঁর দাবি, তাঁরা কোনো ছিনতাই করেননি।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত র‌্যাবের নরসিংদী ক্যাম্পের উপপরিদর্শক (এসআই) শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে আমরাও পাল্টা গুলি চালাই। আমার গায়ে বুলেট প্রতিরোধক জ্যাকেট ছিল। ছিনতাইকারীর ছোড়া গুলি আমার শরীরে লাগলে আমি পড়ে যাই। এরপর অচেতন হয়ে পড়ি।’
নরসিংদী সদর মডেল থানার ওসি আসাদুজ্জামান গত সন্ধ্যায় জানান, লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।
ঢাকায় যুবকের মৃত্যু: র‌্যাব-৪-এর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা খবর পান, মিরপুর ১৩ নম্বরের এ ব্লকে আবদুল মোমিন নামের এক সন্ত্রাসী ও তার সহযোগীরা জড়ো হয়েছে। এরপর র‌্যাবের একটি টহল দল এ ব্লকের টিনশেড কলোনির ১২ নম্বর সড়কের সামনে ঘিরে ফেলে অভিযান চালায়। তখন সন্ত্রাসীরা র‌্যাবের দলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। র‌্যাবও পাল্টা গুলি চালালে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। পরে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে এলাকা তল্লাশি করে গুলিবিদ্ধ মোমিনকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি রিভলবার, দুটি গুলি ও চার বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে।
র‌্যাব জানায়, নিহত মোমিন মিরপুরের সন্ত্রাসী তাজের অন্যতম সহযোগী। মোমিনের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় হত্যাচেষ্টা ও মারধরসহ বিভিন্ন অভিযোগে ছয়টি মামলা, পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা, শেরেবাংলা নগর থানায় অস্ত্র আইনে একটি মামলা এবং কাফরুল থানায় দুটি জিডি রয়েছে।
তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিহতের স্ত্রী জোসনা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, কেরানীগঞ্জের পূর্ব চড়াইল কদমতলী ক্লাব মাঠ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন তাঁরা। রোববার দুপুরে তাঁর স্বামী রিকশা নিয়ে বাসার সামনে নামার সঙ্গে সঙ্গে র‌্যাব সদস্যরা তাঁকে আটক করেন। এরপর মোমিনকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মোমিন পোশাক কারখানায় খণ্ডকালীন কাজ করতেন বলে তাঁর স্ত্রী দাবি করেন।
জোসনা আক্তার আরও জানান, ছয় বছর বয়সে পোলিও রোগে মোমিনের বাঁ পা স্বাভাবিকের চেয়ে চিকন হয়ে যায়। তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটতেন।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৯ জন, পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৪ জন এবং র‌্যাব ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজন নিহত হন। এ ছাড়া পুলিশের নির্যাতনে চারজন এবং পুলিশের গুলিতে সাতজন নিহত হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.