বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৫৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আফতাব আলী, বীর উত্তম, বীর প্রতীক অদম্য সাহসী এক দলনেতা দুপুরে শুরু হয়ে গেল মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল মুখোমুখি যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে আফতাব আলী।
মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তাঁর নেতৃত্বে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকলেন। বিকেল, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। পরদিনও যুদ্ধ চলল। তৃতীয় দিন দুপুরের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিক থেকে গোলাগুলি কমতে থাকল। রাতে একেবারে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। এ ঘটনা কোদালকাঠিতে। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে।
কোদালকাঠি কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার অন্তর্গত। সে সময় তারারশিপাড়া, খারুভাজ, চরসাজাই, ভেলামাঝী, শংকর- মাধবপুর এবং দেউয়ারচর নিয়ে ছিল কোদালকাঠি ইউনিয়ন। ইউনিয়নের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ।
এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির একাংশ বিদ্রোহ করে সুবেদার আফতাব আলীর নেতৃত্বে বর্তমান গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী থেকে রৌমারীর চরাঞ্চলে অবস্থান নেয়। সেখানে আফতাব আলী তাঁর দলে স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি আগস্ট মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত গোটা রৌমারী এলাকা মুক্ত রাখতে সক্ষম হন।
৪ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরাট একটি দল রৌমারী দখলের উদ্দেশ্যে কোদালকাঠিতে আক্রমণ করে। ব্যাপক আর্টিলারি গোলাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সুযোগে পাকিস্তানিরা কোদালকাঠি দখল করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী শক্তিতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকগুণ। সে জন্য আফতাব আলী তখনই পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ না করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কয়েক দিনের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর আরও কয়েকটি দল এসে শক্তি বৃদ্ধি করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোদালকাঠিতে অবস্থান নিয়ে রৌমারী দখলের চেষ্টা করতে থাকে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সে প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে থাকেন। দুই-তিন দিন পরপর সেখানে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁর সাহসিকতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রৌমারী দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। দুই দিন তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা কোদালকাঠি অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর গোটা রৌমারী এলাকা পুরোপুরি মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়।
১৯৭১ সালে তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। তাঁর রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মার্চ মাসে তাঁর কোম্পানি ছিল পলাশবাড়ীতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে অবস্থান নেন রৌমারীতে। এপ্রিল মাসের ১৪ বা ১৫ তারিখে তিনি রৌমারী থানা দখল করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের কাছে আফতাব আলী ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। অসংখ্য পাকিস্তান সমর্থককে প্রকাশ্যে গুলি করে শাস্তি দেন। জীবনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক পাকিস্তানিদের বিপর্যস্ত করে দেন। তিন একবার আহত হন। তার দুই পায়ে চারটি গুলি লাগে। সুস্থ হয়ে পুনরায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুঃসাহসী এই যোদ্ধা কখনো থেমে যাননি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় অদম্য সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। রৌমারী মুক্ত রেখে তিনি কিংবদন্তির যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পান।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আফতাব আলীকে বীর উত্তম ও বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২৯ ও ৬৩।
আফতাব আলীর পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর দক্ষিণভাগ গ্রামে। বর্তমানে তিনি এখানেই বসবাস করেন। ১৯৭৯ সালে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন। তাঁর বাবার নাম ইদ্রিস আলী। মা জোবেদা খানম। স্ত্রী তাহেরা খানম। তাঁর দুই ছেলে, পাঁচ মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর সিলেট প্রতিনিধি সুমন কুমার দাশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস এবং সুব্রত চক্রবর্তী ও কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সিলেট মহানগর ইউনিট। ছবি আনিস মাহমুদ।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
কোদালকাঠি কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার অন্তর্গত। সে সময় তারারশিপাড়া, খারুভাজ, চরসাজাই, ভেলামাঝী, শংকর- মাধবপুর এবং দেউয়ারচর নিয়ে ছিল কোদালকাঠি ইউনিয়ন। ইউনিয়নের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ।
এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির একাংশ বিদ্রোহ করে সুবেদার আফতাব আলীর নেতৃত্বে বর্তমান গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী থেকে রৌমারীর চরাঞ্চলে অবস্থান নেয়। সেখানে আফতাব আলী তাঁর দলে স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি আগস্ট মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত গোটা রৌমারী এলাকা মুক্ত রাখতে সক্ষম হন।
৪ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরাট একটি দল রৌমারী দখলের উদ্দেশ্যে কোদালকাঠিতে আক্রমণ করে। ব্যাপক আর্টিলারি গোলাবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সুযোগে পাকিস্তানিরা কোদালকাঠি দখল করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী শক্তিতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকগুণ। সে জন্য আফতাব আলী তখনই পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ না করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কয়েক দিনের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর আরও কয়েকটি দল এসে শক্তি বৃদ্ধি করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোদালকাঠিতে অবস্থান নিয়ে রৌমারী দখলের চেষ্টা করতে থাকে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সে প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে থাকেন। দুই-তিন দিন পরপর সেখানে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁর সাহসিকতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রৌমারী দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। দুই দিন তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা কোদালকাঠি অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর গোটা রৌমারী এলাকা পুরোপুরি মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়।
১৯৭১ সালে তাঁর পদবি ছিল সুবেদার। তাঁর রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মার্চ মাসে তাঁর কোম্পানি ছিল পলাশবাড়ীতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে অবস্থান নেন রৌমারীতে। এপ্রিল মাসের ১৪ বা ১৫ তারিখে তিনি রৌমারী থানা দখল করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের কাছে আফতাব আলী ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। অসংখ্য পাকিস্তান সমর্থককে প্রকাশ্যে গুলি করে শাস্তি দেন। জীবনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক পাকিস্তানিদের বিপর্যস্ত করে দেন। তিন একবার আহত হন। তার দুই পায়ে চারটি গুলি লাগে। সুস্থ হয়ে পুনরায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুঃসাহসী এই যোদ্ধা কখনো থেমে যাননি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় অদম্য সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। রৌমারী মুক্ত রেখে তিনি কিংবদন্তির যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পান।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আফতাব আলীকে বীর উত্তম ও বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২৯ ও ৬৩।
আফতাব আলীর পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর দক্ষিণভাগ গ্রামে। বর্তমানে তিনি এখানেই বসবাস করেন। ১৯৭৯ সালে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন। তাঁর বাবার নাম ইদ্রিস আলী। মা জোবেদা খানম। স্ত্রী তাহেরা খানম। তাঁর দুই ছেলে, পাঁচ মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর সিলেট প্রতিনিধি সুমন কুমার দাশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস এবং সুব্রত চক্রবর্তী ও কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সিলেট মহানগর ইউনিট। ছবি আনিস মাহমুদ।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments