শিক্ষা-বিশ্ববিদ্যালয় বেচাকেনার ধুম! by সিদ্দিকুর রহমান খান

বেসরকারি ব্যাংক কিংবা টিভি চ্যানেল বিক্রি হলে যতটা না নৈতিকতা আর মূল্যবোধের প্রশ্ন সামনে আসবে, তার চেয়ে বেশি আসবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিক্রি হলে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী অসংখ্যবার বলেছেন, 'এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুব ভালো করছে আবার


কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট বিক্রি করেছে এবং করছে।' এমন তো হতে পারে, বিগত দিনে চড়া দামে কেনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বিনিয়োগ করা টাকা উসুল
করে নিচ্ছে

লাগবে নতুন-পুরান বিশ্ববিদ্যালয়? বিশ্ববিদ্যালয় আছে... বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। মাছ-তরকারির হকারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় বিক্রির হকারের ডাকও শোনা যাবে খুব শিগগিরই! গত রোববার সকালে একটি জাতীয় দৈনিকের শেষ পাতায় একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে এ রকম :'আপনি কি বিশ্ববিদ্যালয় হস্তাস্তরে আগ্রহী।' যোগাযোগের জন্য একটি ফোন নম্বরও দেওয়া আছে ওই বিজ্ঞাপনটিতে। এমন বিজ্ঞাপন দেখে মনে হলো, বিশ্ববিদ্যালয় বেচাকেনার ধারায় এবার নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে ঢাকঢোল পিটিয়ে, প্রকাশ্যে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেচাকেনার পর্বটা কেমন ছিল তা আলোচনার সুবিধার্থে পুরনো পত্রিকা থেকে একটি শিরোনাম উল্লেখ করছি। 'পড়শোনা লাটে ওঠায় এবার হাটে উঠেছে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়'_দৈনিক জনকণ্ঠ, ১ জুন, ২০০৫। প্রতিবেদনটিতে দেখা যায় অন্তত চারটি রুগ্ণ বিশ্ববিদ্যালয় বেচাকেনা হয় অত্যন্ত গোপনে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন, ১৯৯২ সালে যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন তৈরি হয়, তখন এসব বিষয় মাথায় ছিল না। তাই আইনে কিছু বলা নেই। আর এ সুযোগে বেচাকেনা হচ্ছে। মঞ্জুরি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান জনকণ্ঠকে আরও বলেছিলেন :'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে যে সংশোধনী প্রায় চূড়ান্ত তাতে বেচাকেনা বন্ধে কঠোর বিধিবিধান রাখা হবে।' এ ছাড়াও পরবর্তীকালে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেচাকেনা সংক্রান্ত বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মালিকপক্ষ কখনও বলেছেন, কিছু নতুন লোককে নেওয়া হয়েছে ট্রাস্টি বোর্ডে; আবার কখনও বলেছেন, ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এসেছে ইত্যাদি। অর্থাৎ মোটামুটি গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য মালিকপক্ষ কখনোই স্বীকার করেননি যে, চাল-ডালের মতোই তাদের প্রতিষ্ঠানটিও বিক্রি হয়ে গেছে। বেচাকেনার বিষয়ে আইনগত কোনো বাধা না থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নাকের ডগায় বিকিকিনির প্রথম পর্ব শেষ হয় বিগত বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। কিছু দিন বিরতি দিয়ে কয়েকটি দুর্নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করে ২০০৯ সালের শুরুতে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থানের কারণে তাতে সফল না হয়ে আবারও বিকিকিনির পথে হাঁটতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ১০ ও ১১ মে প্রভাবশালী একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেনাবেচার বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। আবারও শিক্ষা বিষয়ক সাংবাদিকরা এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাদের। এবার কিছুটা তৎপরতা দেখা যায় মঞ্জুরি কমিশনকে। কেনাবেচার বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে ২০১০ সালের ২৩ মে কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি ছাপে কমিশন। কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মোঃ শামসুল আলম স্বাক্ষরিত ওই গণবিজ্ঞপ্তির একটি লাইন এ রকম :'কমিশন কর্তৃপক্ষ মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী একটি মহৎ প্রতিষ্ঠান। এটি বেচাকেনার মতো কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। কাজেই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিজ্ঞাপন দেখে অযথা প্রলুব্ধ না হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করা হলো।' কমিশন সরকারি টাকা খরচ করে ওই বিজ্ঞাপন ছেপেছিল। কিন্তু নতুন প্রণয়ন করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ কিন্তু কোথাও একটি বাক্যও নেই এ বেচাকেনা বন্ধে। নতুন আইনের অধীনে একশ'রও বেশি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জমা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। গত বছর মঞ্জুরি কমিশন আবেদনগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিন যাচাই-বাছাই করে সুপারিশসহ পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সুপারিশ উপেক্ষা করে চলতি মাসের ১৩ তারিখ রাত্রিবেলা সরকার সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও 'অর্থনৈতিক' বিবেচনায় আরও আটটি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের আদেশ জারি করে। পুরনো বৈধ ৫৪টির সঙ্গে যোগ দিল নতুন আটটি। পেশাদার ও প্রথিতযশা অনেক শিক্ষকের আবেদন ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। তাদের অনেকে মনোক্ষুণ্ন। উল্লেখ্য, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমতি দেয় এবং অনুমতি পাওয়ার পরপরই অনেক চ্যানেল চড়া দামে বিক্রি হয়ে যায়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও মনোক্ষুণ্নের ব্যাপার সক্রিয় আছে পেশাদার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মধ্যে। অনেক রুগ্ণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেশ কয়েকটা চ্যানেলও খুঁড়িয়ে চলছে। রুগ্ণ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চ্যানেলই শুধু নয়, রুগ্ণ বেসরকারি ব্যাংকও আছে। এগুলোও বিকিকিনি হয়। শুনতে পাই, আরও আটটি বেসরকারি ব্যাংক অনুমোদন পেতে যাচ্ছে শিগগিরই এবং এর মধ্যে একটির মালিক ইতিমধ্যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেয়ে গেছেন। শিক্ষকতা কিংবা ব্যাংকিং অথবা ব্যবসা কোনোটিরই পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই এই মহাক্ষমতাবান ব্যক্তির। এখন যদি তার নতুন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও নিকট ভবিষ্যতে পেতে যাওয়া ব্যাংক_ দুটি প্রতিষ্ঠানই চড়া দামে বিক্রি করে দেন, তাহলে সরকারের কী করার থাকবে? একই আশঙ্কা প্রযোজ্য অধিকাংশ নতুন অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রেও। তবে বেসরকারি ব্যাংক ও চ্যানেলের সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনা করা হয়তো সমীচীন নয়। তবে বেসরকারি ব্যাংক কিংবা টিভি চ্যানেল বিক্রি হলে যতটা না নৈতিকতা আর মূল্যবোধের প্রশ্ন সামনে আসবে, তার চেয়ে বেশি আসবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিক্রি হলে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী অসংখ্যবার বলেছেন, 'এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুব ভালো করছে আবার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট বিক্রি করেছে এবং করছে।' এমন তো হতে পারে, বিগত দিনে চড়া দামে কেনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বিনিয়োগ করা টাকা উসুল করে নিচ্ছে!
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বেশ কয়েক বছর ধরে বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেশের সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার প্রতি জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সামান্য নাগরিক হিসেবে আমি বলতে চাই, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী_ নৈতিক শিক্ষা দেওয়া-নেওয়ার প্রতিষ্ঠান যদি কেনাবেচা হয়, আর টাকাওয়ালা বাবার ছেলেমেয়েরা যদি বলে :'নৈতিকতা_ ওটাও বাবাকে বলব কিছুটা বেশি দাম দিয়ে কিনে দেওয়ার জন্য?

সিদ্দিকুর রহমান খান :সাংবাদিক, শিক্ষা বিষয়ক গবেষক
srkhaan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.