স্বপ্ন দেখব বলে by ফজলুল হালিম রানা

আমি পত্রিকার নিয়মিত পাঠক। অভ্যাসটা ছাত্রজীবন থেকেই। এর আগেও প্রধানমন্ত্রীর লেখা পড়েছি। শুনেছি বক্তৃতা জনসভায়, এমনকি কথা শুনেছি সুধা সদনে এবং যমুনায়। আপনার 'ভালোর পসরা' পড়ে অভিভূত হয়েছি। আপনি মনে রেখেছেন জামায়াত-বিএনপি জোট এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফেলে আসা দুঃসহ সাতটি বছর।


যে সময়ে গোটা রাষ্ট্র্র ছিল কারাগার! আপনি মনে রেখেছেন ১৯৫৮ সালের জেনারেল আইয়ুব খানের মার্শাল ল জারির পরের ঘটনা কিংবা রাজনৈতিক চাচাদের আত্মকাহিনী। শুধু তাই নয়, এই চাচাদের রাজনৈতিক ব্যাকরণের বাইরে আপনার স্মৃতিতে আজও পূর্ণিমার মুখ ভাসে, যা এ দেশের হাজারো পূর্ণিমাকে বাঁচতে শিখাবে।
আপনার 'ভালোর পসরা' আমার স্মৃতির নিউরনে অনুরণন ঘটায়। মনে পড়ে যায় শিহাবের সতেরো টুকরো লাশ, পিতার কোলে নওশীন খুন, ক্ষুধার তাড়নায় দিপালী সাহার আত্মহনন। রাষ্ট্রের আইন অভিমানে কেঁদেছিল ফাহিমা, মহিমা, তৃণা, তৃষার আত্মহননে; জামাল ফকির, ব্যবসায়ী জামালউদ্দিন ও গোপালকৃষ্ণ মুহুরির মতো শত খেটে খাওয়া মানুষের জীবনাবসানে। আমার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় সারের দাবিতে কৃষকের আত্মাহুতি, বিদ্যুতের দাবিতে কানসাট ট্র্যাজেডি, বাঁশখালীতে সংখ্যালঘু পরিবারকে পুড়িয়ে হত্যা! পিচঢালা পথে সোডিয়াম লাইটের নিচে পার্লামেন্টের সাউথ প্লাজায় ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের পরে কোনো এক রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম আমি আর এক প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। সকালবেলা দেখলাম মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে চলে গেল লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে '৭১-এর সেই রাজাকার। আমি আমার প্রিয় মুক্তিযোদ্ধার দিকে তাকালাম। তিনি সেদিন অভিমানে কেঁদেছিলেন। আমি তার কপালে দেখেছিলাম আমার প্রিয় স্বদেশের মানচিত্র। ওই রাতে রাস্তায় ঘুমিয়েছিলাম। কারণ আমার থাকার জায়গা ছিল না ওই রাতে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্র রাজনীতি করতাম। ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর বঙ্গবল্পুব্দ হলের যে কক্ষটিতে আমি থাকতাম, কয়েক দফা সেই কক্ষে আগুন দেওয়া হয়। লুটপাট করা হয় আমার জিনিসপত্র এবং আমার আত্মার খোরাক বই। অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় আমিসহ ছাত্রলীগের সকল নেতাকর্মীর ওপর। ফলে আমি আমার দ্বিতীয় আঁতুড়ঘরে প্রবেশ করতে পারিনি দীর্ঘ পাঁচটি বছর। আমার স্মৃতি আমায় মনে করিয়ে দেয় শাহ এএমএস কিবরিয়ার ওপর বর্বর হামলা, অবশেষে মৃত্যু।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এক অর্থে আপনি ভাগ্যবান। কারণ শত বুলেট আপনায় তাড়া করেছে বহুবার। তারপরও স্রষ্টার অশেষ কৃপায় আপনি বেঁচে আছেন। এ দেশের রাজনীতিতে আসার পর যতবার আপনাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে তা পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রনায়ক কিংবা রাজনীতিককে করা হয়েছে কি-না তা আমার জানা নেই। একটি হত্যাচেষ্টা আমার আমৃত্যু মনে থাকবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিনে সেই বিকেলে ২৩, বঙ্গবল্পুব্দ এভিনিউ গিয়েছিলাম। মোস্তাক আহমেদ সেন্টু ভাই আমাকে পার্টি অফিসের পাশে চা খেতে ডেকেছিলেন। আমরা চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার কৃষক বাবা আমাকে ফোন দিলেন। তিনি আমার মাস চলার যে টাকা কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠিয়েছিলেন সেই টাকা তুলে আমি যেন তাকে ফোন দেই। আমি তৎক্ষণাৎ যেতে চাইনি। সেন্টু ভাই সব শুনে বললেন, 'যাও মুরবি্ব মানুষ ফোনের অপেক্ষায় থাকবেন। তুমি এসে প্রোগ্রাম পাবা।' এটাই তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। এরপরে আর তার সঙ্গে কথা হয়নি। হবেও না। টাকা তুলে যখন ফিরে আসি ততক্ষণে ২৩, বঙ্গবল্পুব্দ এভিনিউ মৃত্যুপুরী। মানুষের চিৎকার আর আর্তনাদ। সে কথা আর মনে করতে চাই না। এর পরের ঘটনা বিশ্ববাসীসহ সবার জানা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আপনার ভালোর পসরায় জানিয়েছেন আরও ভালোর পসরা যারা চান সেই শ্রেণীর কথা। এই শ্রেণীর উদ্দেশ্য আমার মতো ছোট মানুষও যেহেতু তার সাদা চোখে দেখতে পায়, অতএব সেই দিন খুব কাছে যেদিন এ দেশের প্রান্তিক বলয়ের মানুষ গণতন্ত্রের আবডালে কারসাজি করা এই চক্রকে বুঝে ফেলবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আপনার ভালোর পসরায় আরও জানিয়েছেন, আপনি বেঁচে থাকতে দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর খেলতে দেবেন না। হ্যাঁ, আপনি বেঁচে থাকবেন এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। বেঁচে থাকবেন পূর্ণিমাদের স্বপ্ন দেখানোর জন্য। শ্রমজীবী মানুষের ক্ষুধার হাহাকার মেটানোর জন্য। বেঁচে থাকবেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবল্পুব্দর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণের জন্য।
শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.