মিয়ানমারে পার্লামেন্টের উপনির্বাচন-সু চির বিজয় গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রা

মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি সে দেশের পার্লামেন্টের উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) দাবি, তারা ৪৫টি আসনের মধ্যে ৪৪টিতে জয়ী হয়েছে (৪৪টি আসনে তারা প্রার্থী দিয়েছিল) এবং এরই একটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সু চি, যিনি গত প্রায় ২২ বছরের বেশির ভাগ সময়ই বন্দি


ছিলেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে নতুন অভিযাত্রা শুরু হলো মিয়ানমারে। সৃষ্টি হলো নতুন ইতিহাসেরও। ১ এপ্রিল ২০১২ দেশটির পার্লামেন্টের যে নির্বাচন হলো বিপুলসংখ্যক বিদেশি পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে, তাতে প্রথমবারের মতো সু চি পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বলে এনএলডির দাবি। তবে দেশটির কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ, চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে। তার পরও সুচি এবং তাঁর দলকে আমাদের অভিনন্দন।
দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে চলছে অগণতান্ত্রিক সরকারের শাসন। কখনো কখনো সেখানে এমন পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব মিডিয়া এবং বিভিন্ন ফোরামে মিয়ানমার বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেয়েছে। যে উপনির্বাচনটি মিয়ানমারে হলো এবং এর মধ্য দিয়ে যে ফল বেরিয়ে এলো, তাতে পার্লামেন্টে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কোনো পরিবর্তন আসবে না বটে, কিন্তু দেশটির আইনসভায় ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবেন জনরায়ে নির্বাচিত সু চি এবং তাঁর দলের বিজয়ী অন্য সদস্যরা। একটি বিষয় খুব জোর দিয়েই বলা যায়, সামরিক জান্তার সমর্থনপুষ্ট সরকার দেশটির নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টি তাদের দিকে নিবিষ্ট করতে যখন সচেষ্ট, তখন এই উপনির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলের অন্য রকম দৃষ্টি কাড়বে। স্মরণ করা যেতে পারে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর আগে ইঙ্গিত দিয়েছিল, উপনির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ কিংবা বিতর্কমুক্ত হয়, তাহলে মিয়ানমারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, সে পথ এখন অনেকটাই প্রশস্ত। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নির্বাচনে অংশ নেয়। এনএলডির জনৈক মুখপাত্র নির্বাচনোত্তর যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা যায়, তাঁরাও নির্বাচনের ফল নিয়ে সন্তুষ্ট এবং অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি প্রশ্নমুক্ত; যদিও নির্বাচনের আগে সু চিকে অবাধে প্রচার চালানোর ক্ষেত্রে বাধা মোকাবিলা করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছিল।
চার দেয়ালের বাধা টপকে জনরায়ে গণতন্ত্রের জন্য জীবন উৎসর্গকারী অং সান সু চি এখন মিয়ানমারের আইনসভার সদস্য এবং রাজনীতির মাঠে নিরন্তর চষে বেড়ানো আলোকিত রাজনীতিক। তাঁর জয় গণতন্ত্রেরই জয় এবং দেশটিতে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার সড়ক নির্মাণে আশির দশকে অনেকটা আকস্মিক রাজনীতিতে আগমনকারী সু চির ধারাবাহিক সংগ্রামেরই আরেক ধাপ সাফল্য। ২০১০ সালের নভেম্বরে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে সু চি মুক্তি পেলেও তাঁর পথ কণ্টকমুক্ত ছিল না। মিয়ানমারের স্বাধীনতার অগ্রনায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে সু চি অঙ্ফোর্ডে পড়াশোনা শেষে ১৯৮৮ সালে মায়ের অসুস্থতার কারণে দেশে ফিরলে দেশটিতে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চরম রূপ নেয়। অভিযোগ আছে, তখন প্রায় তিন হাজার বিক্ষোভকারীর প্রাণহানি ঘটে সামরিক জান্তার দমন-পীড়নে। ১৯৮৯ সালে সু চি গৃহবন্দি হন। ১৯৯০ সালে তিনি গৃহবন্দি থাকাকালে বিপুল ভোটে জয়ী হলেও ক্ষমতা সামরিক জান্তার হাতেই থেকে যায়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া অনেকটাই মুক্তভাবে বইতে দিতে বাধ্য হয়েছে সামরিক জান্তা সমর্থিত সরকার। মিয়ানমারের এই অধ্যায় থেকে বিশ্বের সব অগণতান্ত্রিক সরকারেরই শিক্ষা নেওয়ার আছে।

No comments

Powered by Blogger.