মিনার মাহমুদ : আমার গুরু by প্রভাষ আমিন
২৯ মার্চ সকাল ১১টার দিকে ইলিয়াসের ফোন পেয়েই অজানা আশঙ্কা ভর করেছিল মনে। ইলিয়াস জানাল, আগের দিন সকালে মামা বাসা থেকে বেরিয়েছে। কোনো খোঁজ পাচ্ছি না, ফোনও বন্ধ। সারা দিন চেষ্টা করেও কোনো খোঁজ পাইনি। সন্ধ্যায় মেহেদী ফোন করে বলল, 'খিলক্ষেত থানায় একটু খোঁজ নে তো। দাদার ব্যাপারে কী যেন বলছে!
' ইলিয়াসের মামা আর মেহেদীর দাদা মানে আমার গুরু মিনার মাহমুদ। খিলক্ষেত থানার ওসি নিশ্চিত করলেন, মিনার মাহমুদ নামে এক সাংবাদিক আত্মহত্যা করেছেন। হোটেল ঢাকা রিজেন্সির রুমেই পড়ে আছে মৃতদেহ। ছুটে গেলাম। যাওয়ার সময় ইস্কাটন থেকে তুলে নিলাম মিনার মাহমুদের লোকাল গার্জিয়ান আক্কাস মাহমুদকে। পথে যেতে যেতে আমার হৃদয়ে তোলপাড়। ২৩ বছরের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেল।
তে-ই-শ বছর! কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে এই তো সেদিন। ১৯৮৯ সাল। সাংবাদিকতা করব বলে ঢাকায় এসেছি। একদিন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হলো। মিনার মাহমুদ কিছু একটা করবেন। ছুটে গেলাম। সঙ্গে আমার আরেক বন্ধু। অনেক খুঁজে দিলু রোডের মুখে হোটেল লর্ডসের নিচতলার কোনায় একটি রুমে পেলাম কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা। ঢুকেই টেবিলের ওপাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনি বললেন, 'আমি মিনার।' আমি অবাক, চমকিত, শিহরিত। সত্যি বলছি, ২৩ বছর পর যখন এই লেখা লিখছি, তখনো সেই অনুভূতিটা ফিরে এসেছে। আমি মিনার মাহমুদের সামনে দাঁড়িয়ে! মিনার মাহমুদ আমাদের প্রজন্মের তরুণদের স্বপ্নের নায়ক। সেই দেখার সূত্রেই আমার সাংবাদিকতার শুরু। তাঁর হাত ধরেই আমার প্রথম রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল পাক্ষিক অনন্যায়।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে শুরু হলো সাপ্তাহিক বিচিন্তার দ্বিতীয় ইনিংস। সেখানে দু-একটা রিপোর্ট করার সুযোগ পেয়েছিলাম। মিনার ভাই হাতে ধরেই শিখিয়েছেন সাংবাদিকতা। বিচিন্তার দ্বিতীয় ইনিংস দুজনের জন্য খুব খারাপ গেছে- আমার আর মিনার মাহমুদের। ব্যাকবেঞ্চার হতে হতে আমি ছেড়ে দিলাম বিচিন্তা, আর একের পর এক মামলায় হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত মিনার মাহমুদ ছাড়লেন দেশ। কারাবাসের ভয়ে দেশ ছেড়েছিলেন মিনার মাহমুদ। কিন্তু গিয়ে ১৮ বছর অপচয় করে এলেন তালাবিহীন বড় কারাগারে। আসলেই অপচয় করলেন। প্রতিভার অপচয় তো বটেই, ১৮ বছর যুক্তরাষ্ট্রে থেকে আসা কারো ব্যাংক ব্যালান্স যখন চার হাজার টাকা হয়, জাগতিক অর্থেও সেটা চরম অপচয়ই। অনেকের জন্যই স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র মিনার মাহমুদের কাছে ছিল স্বপ্নভঙ্গের দেশ, দুঃস্বপ্নের দেশ।
১৮ বছর পর দেশে ফিরে শুরু করেছিলেন বিচিন্তার তৃতীয় ইনিংস। তবে করপোরেটদের দখলে থাকা আজকের বাণিজ্যিক সাংবাদিকতার এই সময়ে মিনার মাহমুদ ছিলেন একেবারেই আনফিট। তাইতো বিচিন্তার তৃতীয় ফ্লাইটের অনিবার্য পরিণতি ছিল ক্র্যাশ ল্যান্ডিং। মিনার মাহমুদের হাতে গড়া সাংবাদিকদের অনেকেই এখন তারকা, জাতির বিবেকের দায়িত্ব পালন করেন প্রায় প্রতিদিনই। এ নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল। একসময় বিচিন্তার বিজ্ঞাপনদাতাদের কেউ কেউ এখন মিডিয়া মোগল। তাঁর বন্ধুদের কারো কারো টাকা গুনতে কয়েক মাস লাগবে। কিন্তু মিনার মাহমুদকে কোনো সুযোগ দেননি কেউই। তাঁদের কেউ কেউ মিনার মাহমুদকে মাসে মাসে টাকা দিতেও তৈরি ছিলেন। কিন্তু মিনার মাহমুদকে সামলানোর ঝুঁকি নিতে চাননি কেউ। অত সাহস কারো নেই। কিন্তু মিনার মাহমুদ তো টাকা চাননি। চেয়েছিলেন সাংবাদিকতা করতে। কিন্তু সেটা তাঁর মতো করে। বাণিজ্যের পেটে ঢুকে যাওয়া, বিজ্ঞাপনের জন্য সম্পাদকের ধরনা, বিজ্ঞাপনদাতার সব অন্যায় মুখ বুজে সয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীর মতো আচরণ করা, সাংবাদিকতার প্রভাব খাটিয়ে বিত্তশালী হওয়া- এমন সাংবাদিকতা মিনার মাহমুদ কখনোই চাননি, কখনো করেননি। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় রিপোর্টিংয়ের জন্য তখনকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাষ্ট্রপতি এরশাদ মিনার মাহমুদকে নিয়ে হেলিকপ্টারে মংলা গিয়েছিলেন সরেজমিনে দেখতে। মিনার মাহমুদ না হয়ে অন্য কেউ হলে অনিবার্য পরিণতি হতো আজীবন এরশাদের অনুগত সাংবাদিক হয়ে আরাম-আয়েশ-বিলাসিতায় জীবনযাপন। কিন্তু মিনার মাহমুদ কী করলেন, প্রকাশ করলেন সাপ্তাহিক বিচিন্তা। সেই বিচিন্তার হুল বেশিদিন সইতে পারেননি এরশাদ। বিচিন্তা বন্ধ করে, মিনার মাহমুদকে জেলে পুরে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এখনকার প্রজন্মের অনেকে মিনার মাহমুদকে চেনেন না। বললে বলেন, কোন মিনার মাহমুদ? দু-একজন চেনেন তসলিমা নাসরিনের স্বামী হিসেবে। কিন্তু যে যা-ই বলুক, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে তাঁর নাম আলাদাভাবেই লিখতে হবে। তিনি বাংলাদেশে আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিন্তা ভেঙে দিয়েছিল সাংবাদিকতার প্রচলিত সব রীতিনীতি, নিয়মকানুন, শৃঙ্খল। সত্যের এমন কঠিন আর চাঁছাছোলা প্রকাশে চমকে গিয়েছিল সবাই। তখনকার সাংবাদিকতার মূলধারার সবাই বিচিন্তাকে পোলাপানের শখ বলে অবজ্ঞা করেছিলেন, উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। নিয়মকানুন না মানা, স্মার্ট, আধুনিক সাংবাদিকতার সেই ক্ষীণ ধারাটিই পরে খবরের কাগজ হয়ে দৈনিক আজকের কাগজে অনেকটা সুশৃঙ্খল। আজকে যেটি সাংবাদিকতার মূলধারা, সেটির উৎস অবশ্যই ৩২ পৃষ্ঠার বিচিন্তা।
দেশে ফিরে মিনার মাহমুদ প্রাণপণে কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। আমরা ছাপোষা মানুষ। প্রতিদিন ছোটখাটো অনেক আপস করে টিকে থাকছি। মিনার মাহমুদ এমন নন। তিনি তেলাপোকার মতো টিকে থাকতে চাননি বলেই মরে গেছেন। মিনার মাহমুদের আত্মহত্যার পর নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি, আর কী করতে পারতেন তিনি? হারিয়ে যাওয়ার আগের দিন ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, 'আজকের প্রত্যাশার চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।' আজকের প্রত্যাশার নির্বাহী সম্পাদক হওয়ার চেয়ে মিনার মাহমুদের মরে যাওয়া অনেক ভালো। মিনার মাহমুদ তো আমাদের মতো নন। মিনার মাহমুদ অন্য রকম। কেরানির মতো ৯টা-৫টা অফিস করবেন, উত্তরায় নির্বাসিত জীবন যাপন করবেন, বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন- এমনটা মিনার মাহমুদের কাছে আশা করাই অন্যায়। তাঁর ভেতরে আগুন ছিল, আশির দশকে তা টের পেয়েছে সবাই। ১৮ বছর সে আগুন চাপা ছিল। দেশে ফিরে সে আগুনে পোড়াতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকতার নামে আমাদের সব ভণ্ডামি, কূপমণ্ডূকতা, অসততা আর তথাকথিত ঠাটবাট। পারেননি। তিনি একা হয়ে গিয়েছিলেন। আমরাই যে এখন সংখ্যাগুরু। তাই উল্টো নিজেই পুড়ে গেলেন। মিনার ভাই আমাদের বলতেন মাসুদ রানা, আর নিজেকে রাহাত খান। কিন্তু মাসুদ রানারা যখন আপসের চোরাবালিতে হারিয়ে ভিলেন হয়ে যায়, রাহাত খানের তো তখন মরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। মিনার মাহমুদ চাননি তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে সামাজিক নখরামি হোক, দিস্তা দিস্তা কাগজের অপচয় হোক, শোকসভার বক্তারা টেবিল ভেঙে ফেলুক থাপড় মেরে। না চাইলেও তা-ই হবে। বেঁচে থাকতে যাঁর চাওয়া পূরণ করিনি আমরা, মরে যাওয়ার পর তাঁর ইচ্ছা পূরণের কী দায় ঠেকেছে।
অনেকেই জানতে চেয়েছেন মিনার ভাই কেন আত্মহত্যা করলেন। আমি জানি না। আমি জবাব খুঁজি জীবনানন্দে- অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়- আরো এক বিপন্ন বিস্ময়, আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে; ক্লান্ত-ক্লান্ত করে; লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নেই; তাই লাশকাটা ঘরে চিত হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ওপর।
মিনার মাহমুদ মারা যাওয়ার পর ভারাক্রান্ত আমি আশ্রয় খুঁজেছি রবীন্দ্রনাথে। ঘুরে ঘুরে আমার গাড়িতে, আমার মাথায় কলিম শরাফীর ভরাট কণ্ঠ- 'আমি তখন, ছিলেম মগন, গহন ঘুমের ঘোরে; যখন বৃষ্টি নামলো।' 'নির্ঘুম স্বপ্নের দেশ' থেকে মিনার মাহমুদ চলে গেছেন গহন ঘুমের ঘোরে। আর আমাদের হৃদয়ে কান্নার অনন্ত বৃষ্টি নেমেছে।
লেখক : সাংবাদিক
probhash2000@gmail.com
তে-ই-শ বছর! কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে এই তো সেদিন। ১৯৮৯ সাল। সাংবাদিকতা করব বলে ঢাকায় এসেছি। একদিন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হলো। মিনার মাহমুদ কিছু একটা করবেন। ছুটে গেলাম। সঙ্গে আমার আরেক বন্ধু। অনেক খুঁজে দিলু রোডের মুখে হোটেল লর্ডসের নিচতলার কোনায় একটি রুমে পেলাম কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা। ঢুকেই টেবিলের ওপাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। তিনি বললেন, 'আমি মিনার।' আমি অবাক, চমকিত, শিহরিত। সত্যি বলছি, ২৩ বছর পর যখন এই লেখা লিখছি, তখনো সেই অনুভূতিটা ফিরে এসেছে। আমি মিনার মাহমুদের সামনে দাঁড়িয়ে! মিনার মাহমুদ আমাদের প্রজন্মের তরুণদের স্বপ্নের নায়ক। সেই দেখার সূত্রেই আমার সাংবাদিকতার শুরু। তাঁর হাত ধরেই আমার প্রথম রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল পাক্ষিক অনন্যায়।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে শুরু হলো সাপ্তাহিক বিচিন্তার দ্বিতীয় ইনিংস। সেখানে দু-একটা রিপোর্ট করার সুযোগ পেয়েছিলাম। মিনার ভাই হাতে ধরেই শিখিয়েছেন সাংবাদিকতা। বিচিন্তার দ্বিতীয় ইনিংস দুজনের জন্য খুব খারাপ গেছে- আমার আর মিনার মাহমুদের। ব্যাকবেঞ্চার হতে হতে আমি ছেড়ে দিলাম বিচিন্তা, আর একের পর এক মামলায় হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত মিনার মাহমুদ ছাড়লেন দেশ। কারাবাসের ভয়ে দেশ ছেড়েছিলেন মিনার মাহমুদ। কিন্তু গিয়ে ১৮ বছর অপচয় করে এলেন তালাবিহীন বড় কারাগারে। আসলেই অপচয় করলেন। প্রতিভার অপচয় তো বটেই, ১৮ বছর যুক্তরাষ্ট্রে থেকে আসা কারো ব্যাংক ব্যালান্স যখন চার হাজার টাকা হয়, জাগতিক অর্থেও সেটা চরম অপচয়ই। অনেকের জন্যই স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র মিনার মাহমুদের কাছে ছিল স্বপ্নভঙ্গের দেশ, দুঃস্বপ্নের দেশ।
১৮ বছর পর দেশে ফিরে শুরু করেছিলেন বিচিন্তার তৃতীয় ইনিংস। তবে করপোরেটদের দখলে থাকা আজকের বাণিজ্যিক সাংবাদিকতার এই সময়ে মিনার মাহমুদ ছিলেন একেবারেই আনফিট। তাইতো বিচিন্তার তৃতীয় ফ্লাইটের অনিবার্য পরিণতি ছিল ক্র্যাশ ল্যান্ডিং। মিনার মাহমুদের হাতে গড়া সাংবাদিকদের অনেকেই এখন তারকা, জাতির বিবেকের দায়িত্ব পালন করেন প্রায় প্রতিদিনই। এ নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল। একসময় বিচিন্তার বিজ্ঞাপনদাতাদের কেউ কেউ এখন মিডিয়া মোগল। তাঁর বন্ধুদের কারো কারো টাকা গুনতে কয়েক মাস লাগবে। কিন্তু মিনার মাহমুদকে কোনো সুযোগ দেননি কেউই। তাঁদের কেউ কেউ মিনার মাহমুদকে মাসে মাসে টাকা দিতেও তৈরি ছিলেন। কিন্তু মিনার মাহমুদকে সামলানোর ঝুঁকি নিতে চাননি কেউ। অত সাহস কারো নেই। কিন্তু মিনার মাহমুদ তো টাকা চাননি। চেয়েছিলেন সাংবাদিকতা করতে। কিন্তু সেটা তাঁর মতো করে। বাণিজ্যের পেটে ঢুকে যাওয়া, বিজ্ঞাপনের জন্য সম্পাদকের ধরনা, বিজ্ঞাপনদাতার সব অন্যায় মুখ বুজে সয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীর মতো আচরণ করা, সাংবাদিকতার প্রভাব খাটিয়ে বিত্তশালী হওয়া- এমন সাংবাদিকতা মিনার মাহমুদ কখনোই চাননি, কখনো করেননি। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় রিপোর্টিংয়ের জন্য তখনকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাষ্ট্রপতি এরশাদ মিনার মাহমুদকে নিয়ে হেলিকপ্টারে মংলা গিয়েছিলেন সরেজমিনে দেখতে। মিনার মাহমুদ না হয়ে অন্য কেউ হলে অনিবার্য পরিণতি হতো আজীবন এরশাদের অনুগত সাংবাদিক হয়ে আরাম-আয়েশ-বিলাসিতায় জীবনযাপন। কিন্তু মিনার মাহমুদ কী করলেন, প্রকাশ করলেন সাপ্তাহিক বিচিন্তা। সেই বিচিন্তার হুল বেশিদিন সইতে পারেননি এরশাদ। বিচিন্তা বন্ধ করে, মিনার মাহমুদকে জেলে পুরে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এখনকার প্রজন্মের অনেকে মিনার মাহমুদকে চেনেন না। বললে বলেন, কোন মিনার মাহমুদ? দু-একজন চেনেন তসলিমা নাসরিনের স্বামী হিসেবে। কিন্তু যে যা-ই বলুক, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে তাঁর নাম আলাদাভাবেই লিখতে হবে। তিনি বাংলাদেশে আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিন্তা ভেঙে দিয়েছিল সাংবাদিকতার প্রচলিত সব রীতিনীতি, নিয়মকানুন, শৃঙ্খল। সত্যের এমন কঠিন আর চাঁছাছোলা প্রকাশে চমকে গিয়েছিল সবাই। তখনকার সাংবাদিকতার মূলধারার সবাই বিচিন্তাকে পোলাপানের শখ বলে অবজ্ঞা করেছিলেন, উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। নিয়মকানুন না মানা, স্মার্ট, আধুনিক সাংবাদিকতার সেই ক্ষীণ ধারাটিই পরে খবরের কাগজ হয়ে দৈনিক আজকের কাগজে অনেকটা সুশৃঙ্খল। আজকে যেটি সাংবাদিকতার মূলধারা, সেটির উৎস অবশ্যই ৩২ পৃষ্ঠার বিচিন্তা।
দেশে ফিরে মিনার মাহমুদ প্রাণপণে কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। আমরা ছাপোষা মানুষ। প্রতিদিন ছোটখাটো অনেক আপস করে টিকে থাকছি। মিনার মাহমুদ এমন নন। তিনি তেলাপোকার মতো টিকে থাকতে চাননি বলেই মরে গেছেন। মিনার মাহমুদের আত্মহত্যার পর নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি, আর কী করতে পারতেন তিনি? হারিয়ে যাওয়ার আগের দিন ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, 'আজকের প্রত্যাশার চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।' আজকের প্রত্যাশার নির্বাহী সম্পাদক হওয়ার চেয়ে মিনার মাহমুদের মরে যাওয়া অনেক ভালো। মিনার মাহমুদ তো আমাদের মতো নন। মিনার মাহমুদ অন্য রকম। কেরানির মতো ৯টা-৫টা অফিস করবেন, উত্তরায় নির্বাসিত জীবন যাপন করবেন, বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন- এমনটা মিনার মাহমুদের কাছে আশা করাই অন্যায়। তাঁর ভেতরে আগুন ছিল, আশির দশকে তা টের পেয়েছে সবাই। ১৮ বছর সে আগুন চাপা ছিল। দেশে ফিরে সে আগুনে পোড়াতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকতার নামে আমাদের সব ভণ্ডামি, কূপমণ্ডূকতা, অসততা আর তথাকথিত ঠাটবাট। পারেননি। তিনি একা হয়ে গিয়েছিলেন। আমরাই যে এখন সংখ্যাগুরু। তাই উল্টো নিজেই পুড়ে গেলেন। মিনার ভাই আমাদের বলতেন মাসুদ রানা, আর নিজেকে রাহাত খান। কিন্তু মাসুদ রানারা যখন আপসের চোরাবালিতে হারিয়ে ভিলেন হয়ে যায়, রাহাত খানের তো তখন মরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। মিনার মাহমুদ চাননি তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে সামাজিক নখরামি হোক, দিস্তা দিস্তা কাগজের অপচয় হোক, শোকসভার বক্তারা টেবিল ভেঙে ফেলুক থাপড় মেরে। না চাইলেও তা-ই হবে। বেঁচে থাকতে যাঁর চাওয়া পূরণ করিনি আমরা, মরে যাওয়ার পর তাঁর ইচ্ছা পূরণের কী দায় ঠেকেছে।
অনেকেই জানতে চেয়েছেন মিনার ভাই কেন আত্মহত্যা করলেন। আমি জানি না। আমি জবাব খুঁজি জীবনানন্দে- অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়- আরো এক বিপন্ন বিস্ময়, আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে; ক্লান্ত-ক্লান্ত করে; লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নেই; তাই লাশকাটা ঘরে চিত হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ওপর।
মিনার মাহমুদ মারা যাওয়ার পর ভারাক্রান্ত আমি আশ্রয় খুঁজেছি রবীন্দ্রনাথে। ঘুরে ঘুরে আমার গাড়িতে, আমার মাথায় কলিম শরাফীর ভরাট কণ্ঠ- 'আমি তখন, ছিলেম মগন, গহন ঘুমের ঘোরে; যখন বৃষ্টি নামলো।' 'নির্ঘুম স্বপ্নের দেশ' থেকে মিনার মাহমুদ চলে গেছেন গহন ঘুমের ঘোরে। আর আমাদের হৃদয়ে কান্নার অনন্ত বৃষ্টি নেমেছে।
লেখক : সাংবাদিক
probhash2000@gmail.com
No comments