প্রতিবেশী-নতুন মিয়ানমারকে পথ দেখাবেন সু চি by শিহাবউদ্দিন আহমদ
সামরিক শাসক থাকা অবস্থায় যে ব্যক্তিদের সু চি এক চুল ছাড় দেননি; গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়া মাত্র তাদেরই তিনি সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বলেছেন, তার লক্ষ্য শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা নয়, গণতান্ত্রিক মিয়ানমার। গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রশ্নে তিনি বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে গেছেন।
রাষ্ট্রপতি যে 'ন্যাশনাল ভিশন' ঘোষণা করেছেন, সেখানে সু চির নিবিড় পরামর্শ রয়েছে। অনেকে হয়তো জানেন, বর্তমান রাষ্ট্রপতির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা উ মিন্ত নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আগে অং সান সু চির উপদেষ্টা ছিলেন। সু চিই তাকে উৎসাহিত করেছেন। এভাবে মিয়ানমারে গড়ে উঠছে এক অনন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যার পথিকৃৎ হচ্ছেন অং সান সু চি
সংসদীয় উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণের একদিন পর রেঙ্গুনে এখন সাদা তারকা ও হলুদ ময়ূর আঁকা লাল পতাকার ছড়াছড়ি। এটা সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) পতাকা। দলটির কর্মী-সমর্থকরা রাস্তায় রাস্তায় পতাকা দুলিয়ে মিছিল করছে। আনন্দ প্রকাশ করছে। সাধারণ নাগরিকরাও খুশি। রেঙ্গুনের বাহান টাউনশিপ এলাকায় অবস্থিত এনএলডির সদর দফতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছেন অং সান সু চি। তিনি বলেছেন, রোববারের উপনির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।
নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফল পেতে আরও কয়েক দিন লেগে যাবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই এটা স্পষ্ট যে, অং সান সু চি তার আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। এনএলডি নেতারা দাবি করেছেন, তাদের সব প্রার্থীই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছে। সু চি নিজে অবশ্য নির্বাচনের ফলকে আখ্যা দিয়েছেন 'জনগণের বিজয়' হিসেবে। দলীয় সদর দফতরের সামনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, এই বিজয় যতখানি না আমাদের, তার চেয়ে অনেক বেশি মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের। কারণ, তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং এর ফল দেশের গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক হয়েছে।
বস্তুত এই উপনির্বাচনে এনএলডির অংশগ্রহণ এবং বিজয় খোদ সু চির নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা প্রমাণ। গত এক বছর ধরে তিনি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় যে প্রচার চালিয়েছেন, তার সহকর্মীদের বিজয়ের পেছনে তা টনিক হিসেবে কাজ করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সদিচ্ছার কথাও বলতে হবে। সামরিক অতীত থাকলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথ বেছে নিয়েছেন। চিরবৈরী সু চির প্রতি নানাভাবে সমঝোতার বার্তা দিয়েছেন। মূলত সেই সমঝোতার অংশ হিসেবেই মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা ৪৫ জন এমপির শূন্য আসনে নির্বাচনের অংশ নেয় এনএলডি। ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম দলটি নির্বাচনে অংশ নিল। আরও ১৬টি রাজনৈতিক দল এতে অংশ নিয়েছিল। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের অন্যান্য দল অংশ নিলেও সু চির এনএলডি তা বয়কট করে।
এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের কথা মনে রাখা জরুরি। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, যারা মন্ত্রী হবেন তারা এমপি থাকতে পারবেন না। মন্ত্রিসভা যেহেতু পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহি করবে, সেহেতু সেখানে পার্লামেন্টের কোনো সদস্য থাকতে পারবে না। এমনকি মন্ত্রীরা দলীয় কোনো পদেও আর থাকতে পারবেন না। আমাদের দেশে কি এমন একটি ব্যবস্থা আমরা এখনও চিন্তা করতে পারি?
বলাবাহুল্য, উপনির্বাচনে বিজয় মানেই সরকার পরিচালনা এনএলডির ভূমিকা অনিবার্য হয়ে ওঠে না। ৬৬৪ আসনের পার্লামেন্টে সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থিত রাজনৈতিক দল ইউএসডিপি (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্তত ৮০ শতাংশ আসন তাদের দখলে। বলে রাখা ভালো, নিজেদের সমর্থিত রাজনৈতিক দল ছাড়াও মিয়ানমারের পার্লামেন্টে সেনাবাহিনী থেকে সরাসরি মনোনীত এমপি রয়েছে। উচ্চ ও নিম্নকক্ষ মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ১৬৬। কিন্তু তারপরও সু চির বিজয় মিয়ানমারের রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায় এক গুণগত পরিবর্তনের সূচনা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে না থাকলেও সে পরিবর্তন সু চির নেতৃত্বেই শুরু হবে। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের যে প্রত্যাশা দেশ-বিদেশে সবাই করছে, তার কেন্দ্রে থাকবেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চি। তিনি যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে করে আসছেন, আগামী দিনগুলোতে সেটাই মিয়ানমারকে পথ দেখাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সাত দশকের বেশি সময় সামরিক শাসনাধীনে থাকার পর গণতান্ত্রিক মিয়ানমার কোন পথে চলবে এর নীতিনির্ধারণ করবেন অং সান সু চি। কেবল মিয়ানমার নয় আমি মনে করি, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সু চির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং অবশ্যই সংস্কৃতি নতুন পথ দেখাতে পারে। পাশের বাংলাদেশকে তো বটেই।
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে অং সান সু চির ত্যাগ, একাগ্রতা ও সহনশীলতার কথা। আজ থেকে দুই দশক আগে তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। কিন্তু সামরিক সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেয়নি। নির্বাচনের ফল বাতিল করেছে। এনএলডির প্রথম সারির সব নেতাকর্মীর ওপর জেল-জুলুম চালিয়েছে। সু চি নিজেও দফায় দফায় বন্দি ও গৃহবন্দি হয়েছেন। স্বামী ও সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হয়েছেন। গত বছর নভেম্বরের নির্বাচনেও তার দলকে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু যখনই গণতন্ত্রের প্রশ্নে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে, তিনি হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। সামরিক শাসক থাকা অবস্থায় যে ব্যক্তিদের সু চি এক চুল ছাড় দেননি; গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়া মাত্র তাদেরই তিনি সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বলেছেন, তার লক্ষ্য শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা নয়, গণতান্ত্রিক মিয়ানমার। গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রশ্নে তিনি বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রপতি যে 'ন্যাশনাল ভিশন' ঘোষণা করেছেন, সেখানে সু চির নিবিড় পরামর্শ রয়েছে। অনেকে হয়তো জানেন, বর্তমান রাষ্ট্রপতির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা উ মিন্ত নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আগে অং সান সু চির উপদেষ্টা ছিলেন। সু চিই তাকে উৎসাহিত করেছেন। এভাবে মিয়ানমারে গড়ে উঠছে এক অনন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যার পথিকৃৎ হচ্ছেন অং সান সু চি।
দায়িত্বশীল বিরোধী দল বলতে কী বোঝায়, অং সান সু চি তা এখন হাতে-কলমে দেখাচ্ছেন। মিয়ানমারে যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়, মধ্যপ্রাচ্যে তখন একের পর এক স্বৈরাচারের পতন ঘটছিল। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়াসহ আরও কিছু দেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে একজন বিদেশি সাংবাদিক অং সান সু চিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তার দল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু করবে কি-না? তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, মিয়ানমার মধ্যপ্রাচ্য নয়। আমরা কারও পতন নয়, গণতন্ত্রের উত্থান চাই। রোববারের নির্বাচন পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে, তিনি নিছক কথার কথা বলেননি। যারা সু চিকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন তারা জানেন, তিনি কতটা দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার কথা ও কাজে কোনো ফারাক থাকে না।
সৌভাগ্যক্রমে আমারও সুযোগ হয়েছিল সু চির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাতের। কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তার প্রবল ব্যক্তিত্ব অথচ অতুলনীয় বিনয়, আড়ম্বরহীনতা। সু চির ব্যক্তিত্ব যে কাউকে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ভক্ত করে তোলে। গত বছর অক্টোবরের গোড়ার দিকের ওই সন্ধ্যা আমার জীবনেও স্মরণীয় হয়ে আছে। ওই সময় মিয়ানমার সফরে এসেছিলেন অ্যাকশন এইড ইন্টারন্যাশনালের সিইও জোয়ানা কের। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাকশন এইডের শুভেচ্ছাদূত এবং অস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ অভিনেত্রী এমা থম্পসন। তারা চাইছিলেন সু চির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করতে। বৈঠকটি গোপনই রাখা হয়েছিল। কারণ, তখন যদিও সু চির গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন, সরকারের মনোভাব স্পষ্ট হয়নি। ইউরোপীয় একটি দেশের রাষ্ট্রদূত তার বাসায় সু চি এবং আমাদের নৈশভোজের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ঘরোয়া পরিবেশে খুব কাছ থেকে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তার কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম, মিয়ানমারের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী। তিনি নিদ্বর্িধায় বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন রাখা। এনএলডি এমন কিছু করবে না যাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় এবং সরকার দুর্বল হয়। নির্বাচিত সরকার দুর্বল হলে গণতন্ত্রই দুর্বল হবে। মিয়ানমারের মানুষ দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছিল না। নির্বাচন, ভোট প্রদান, নাগরিক অধিকার সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তোলা সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলেরও দায়িত্ব। আমরা বলেছিলাম, নতুন সরকারের জন্য অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে অন্যরা সাধারণত বলে থাকেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি। কিন্তু সু চি বললেন, প্রথম কাজ হচ্ছে 'রুল অব ল' প্রতিষ্ঠা। কারণ, আইনের শাসন না থাকলে গণতন্ত্র থাকবে না। এ জন্য সবার আগে রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। কোথাও কেউ বঞ্চিত হলে যাতে বিচার চাইতে পারে।
ওইদিন সন্ধ্যায় রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় অং সান সু চিকে যেমন দক্ষ, দূরদর্শী, আত্মবিশ্বাসী রাজনীতিক মনে হচ্ছিল, তেমনি শিল্পকলা নিয়ে কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল যেন একজন শিল্পবোদ্ধা। এমা থম্পসনের সঙ্গে কথা বলার সময় ধ্রুপদী চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে কথা বলছিলেন। আর্ট ফিল্ম নিয়ে, হলিউডের মুভি নিয়ে কথা বললেন। দেখা গেল, এমারও কিছু চলচ্চিত্রের কিছু দৃশ্য সু চির মনে রয়েছে। অভিনয় সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান থেকে এমা বিস্মিত হয়ে পড়েছিলেন। সু চির কথা বলার ভঙ্গি, সাদাসিধে পোশাক এবং অন্যের প্রতি মনোযোগ দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন এক সন্ত।
সু চি তো আসলেই সন্ত। গণতন্ত্রের সন্ত। তার কাছে রাজনীতি হচ্ছে একটি শিল্পের মতো। তিনি রাজনীতির শিল্পী। রোববারের উপনির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের গণতন্ত্র বোধহয় সেই শিল্পী ও সন্তের পেছনেই হাঁটা শুরু করল।
শিহাবউদ্দিন আহমদ : কর্মসূত্রে রেঙ্গুনে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক; মিয়ানমারে কর্মরত একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার আবাসিক পরিচালক
No comments