দাহকালের কথা-কুমির by মাহমুদুজ্জামান বাবু
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আর দুঃখ নয়। হতাশা নয়। বিষণ্নতা একটি রোগ—এই মর্মে সরকারি টেলিভিশনে একসময়ের বহুল প্রচারিত বিজ্ঞাপনচিত্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, রোগাক্রান্ত বিষণ্ন একজন তরুণীর মুখ এখনো মানসপটে ভাসছে। সেই সময়ের ওষুধের দোকানগুলোতে ওই রকম পোস্টার ছিল।
নিজের মুখকে কয়েক দিন থেকে ওই রকম দেখতে দেখতে এ মুহূর্তেই সিদ্ধান্তটা নেওয়া। হাসব। নানাভাবে হাসব। মৃদু, মুচকি, দাঁত কেলানো, উচ্চ স্বরে কিংবা স্বদেশ-বিদেশ কাঁপিয়ে অট্টহাসি হলেও হাসব। হাসতেই হবে। না হেসে উপায় নেই। কারণ, বিষণ্নতা একটি রোগের নাম। আমরা কি কেউ সাধ করে অসুস্থ হব? প্রশ্নই ওঠে না।
দেড় শ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ বছর ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে কয়েক দিন খুব বেড়ালেন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, সসম্মানে এবং বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির আর্থিক সহযোগিতায়। আয়োজনের ঘটা ছিল, আড়ম্বর ছিল, বরণ ও বিদায়ের আনন্দ-বেদনাও হয়তো ছিল, যাঁদের মুখগুলো বহুদিন দেখা যায়নি, যাঁদের স্বর শ্রুত হয়নি বহুকাল, তাঁরাও পাদপ্রদীপের সামনে এসেছিলেন এবার রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় পা মিলিয়ে। মঞ্চসজ্জা হলো, নৃত্যগীত হলো, দুই দেশের মন্ত্রী-অভিজাত ব্যক্তিরা বিমানে উড়লেন, এদেশ-ওদেশ করলেন এবং নিজেরা তৃপ্তিতে হাসলেন, হাসবেনই তো, কারণ রবীন্দ্রনাথ বলে কথা! এই হাসির রহস্য উদ্ঘাটনে বড় একটা হাসির পাত্রের ঢাকনা খুলতে হচ্ছে এবার।
ধরে নেওয়া যায়, জোড়াসাঁকো নামের যে জায়গাটি কলকাতায় অনেক আগে ছিল বা এখনো আছে, পাশাপাশি দুটি সাঁকোর নিচে শীর্ণ নদী বা মৃত খাল, হয়তো বিভাজনের এপার-ওপার মিলেছিল জোড়াসাঁকো দিয়েই। তো, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্রনাথ কোনো একটি সাঁকো দিয়ে ওপারে গেলেন, একটু পুবের দিকে, মানে তাঁর সময় ছাড়িয়ে একটু পেছনে এবং গিয়ে তাঁর চোখ ধাঁধালো। ধাঁধালো কারণ, সেখানে আর এক যুগপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঋজু শরীরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়ে ছিলেন ঋজু ভঙ্গিমায়; কিন্তু তাঁর মুখে কোনো হাসি ছিল না। বিদ্যাসাগরও বিষণ্ন ছিলেন। কারণ, অন্ধকার ভারতবর্ষে বাঙালি জাতির অন্ধকার মনের কোণে কোণে আলো জ্বালাতে নেমে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন একা এবং সমযোগ্য সহযোগীহীন। বিদ্যাসাগরের বিষণ্ন চোখ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিপাতে লীন হলে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন... ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশবিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য...’। এহেন বিদ্যাসাগর এবং তা দেখে জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথের বিষণ্ন মুখ আমাদের নিশ্চয়ই হাসির উপাদান দিয়ে যায়। না হলে আমাদের এত হাসিমুখ কেন? উফ্! আবার বিষণ্নতা ঘিরে আসছে; এবার সত্যিই হাসির কথা বলব। বাজারে আগুন জ্বলুক। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে আকাশ ফুটো করুক। জ্বালানি তেলের জ্বলুনি চলুক। কার কী?
স্কুলের ক্লাসে রচনা লিখতে দিয়েছেন শিক্ষক। গরুর রচনা। লেখা শেষে জমা নেওয়া খাতা দেখছেন তিনি। একটি খাতায় এসে শিক্ষক রেগে টং। একজন লিখেছে, কুমির দেখতে খুব সুন্দর। কুমিরের বড় একটি চোয়াল আছে। দুটি চোখ ও চারটি পা আছে। আর আছে ইয়া লম্বা একটি লেজ। সেই লেজের গায়ে শুধু খাঁজকাটা খাঁজকাটা...। খাঁজকাটা লিখেই সে তিন পৃষ্ঠা ভরিয়েছে। শিক্ষক কান ধরে বললেন, গরুর রচনা পরিসনি, সেটা বুঝলাম, কিন্তু খাঁজকাটা এতবার লিখলি কেন? স্যার, লেজটা তো অনেক লম্বা—ছাত্রের উত্তর। শিক্ষক এবার শাস্তি দিলেন কড়া। বাড়ি থেকে রচনা লিখে আনতেই হবে কাল। ছাত্র লিখল, আমাদের বাড়ি অনেক সুন্দর। লতায়-পাতায় ছাওয়া। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে পথিক থমকে দাঁড়ায়, আহা অপূর্ব! বাড়িতে একটি গরু আছে। রাখাল গরু নিয়ে নদীর ধারে যায়। গিয়ে দেখে, নদীতে একটি কুমির। কুমিরের চোয়াল চোখ পা...এবং যথারীতি লেজের খাঁজে খাঁজে রচনা চলতে থাকলে শিক্ষক এবার আরও কঠিন রচনা লিখতে দিলেন তাকে। পলাশীর যুদ্ধ। শুনে, ছাত্র মাথা চুলকায়। এটা তো স্যার জানি না। স্যার হুংকার ছাড়েন, জানিস না? জেনে লিখে আনবি। পরদিন ছাত্র লেখে, পলাশীতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা আর ব্রিটিশ সৈন্যের যুদ্ধ হয়েছিল। নবাবের সৈন্য ছিল কম, যদিও যুদ্ধের অগ্রগতি নবাবের পক্ষেই ছিল। কিন্তু নবাবের সেনাপতি মীরজাফরকে নবাব বিশ্বাস করে খাল কেটে কুমির এনেছিলেন। কুমির খুবই সুন্দর...এরপর রচনাটি যথারীতি অই খাঁজকাটার মধ্যে ঘুরপাক খায়।
আমরা বিশ্বাস করে পাঁচ বছর পর পর খাল কাটি। কুমির আনি। কুমিরের ইয়া লম্বা লেজ। লেজের গায়ে খাঁজকাটা, খাঁজকাটা খাঁজকাটা...।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
দেড় শ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ বছর ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে কয়েক দিন খুব বেড়ালেন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, সসম্মানে এবং বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির আর্থিক সহযোগিতায়। আয়োজনের ঘটা ছিল, আড়ম্বর ছিল, বরণ ও বিদায়ের আনন্দ-বেদনাও হয়তো ছিল, যাঁদের মুখগুলো বহুদিন দেখা যায়নি, যাঁদের স্বর শ্রুত হয়নি বহুকাল, তাঁরাও পাদপ্রদীপের সামনে এসেছিলেন এবার রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় পা মিলিয়ে। মঞ্চসজ্জা হলো, নৃত্যগীত হলো, দুই দেশের মন্ত্রী-অভিজাত ব্যক্তিরা বিমানে উড়লেন, এদেশ-ওদেশ করলেন এবং নিজেরা তৃপ্তিতে হাসলেন, হাসবেনই তো, কারণ রবীন্দ্রনাথ বলে কথা! এই হাসির রহস্য উদ্ঘাটনে বড় একটা হাসির পাত্রের ঢাকনা খুলতে হচ্ছে এবার।
ধরে নেওয়া যায়, জোড়াসাঁকো নামের যে জায়গাটি কলকাতায় অনেক আগে ছিল বা এখনো আছে, পাশাপাশি দুটি সাঁকোর নিচে শীর্ণ নদী বা মৃত খাল, হয়তো বিভাজনের এপার-ওপার মিলেছিল জোড়াসাঁকো দিয়েই। তো, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্রনাথ কোনো একটি সাঁকো দিয়ে ওপারে গেলেন, একটু পুবের দিকে, মানে তাঁর সময় ছাড়িয়ে একটু পেছনে এবং গিয়ে তাঁর চোখ ধাঁধালো। ধাঁধালো কারণ, সেখানে আর এক যুগপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঋজু শরীরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়ে ছিলেন ঋজু ভঙ্গিমায়; কিন্তু তাঁর মুখে কোনো হাসি ছিল না। বিদ্যাসাগরও বিষণ্ন ছিলেন। কারণ, অন্ধকার ভারতবর্ষে বাঙালি জাতির অন্ধকার মনের কোণে কোণে আলো জ্বালাতে নেমে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন একা এবং সমযোগ্য সহযোগীহীন। বিদ্যাসাগরের বিষণ্ন চোখ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিপাতে লীন হলে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন... ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশবিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য...’। এহেন বিদ্যাসাগর এবং তা দেখে জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথের বিষণ্ন মুখ আমাদের নিশ্চয়ই হাসির উপাদান দিয়ে যায়। না হলে আমাদের এত হাসিমুখ কেন? উফ্! আবার বিষণ্নতা ঘিরে আসছে; এবার সত্যিই হাসির কথা বলব। বাজারে আগুন জ্বলুক। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে আকাশ ফুটো করুক। জ্বালানি তেলের জ্বলুনি চলুক। কার কী?
স্কুলের ক্লাসে রচনা লিখতে দিয়েছেন শিক্ষক। গরুর রচনা। লেখা শেষে জমা নেওয়া খাতা দেখছেন তিনি। একটি খাতায় এসে শিক্ষক রেগে টং। একজন লিখেছে, কুমির দেখতে খুব সুন্দর। কুমিরের বড় একটি চোয়াল আছে। দুটি চোখ ও চারটি পা আছে। আর আছে ইয়া লম্বা একটি লেজ। সেই লেজের গায়ে শুধু খাঁজকাটা খাঁজকাটা...। খাঁজকাটা লিখেই সে তিন পৃষ্ঠা ভরিয়েছে। শিক্ষক কান ধরে বললেন, গরুর রচনা পরিসনি, সেটা বুঝলাম, কিন্তু খাঁজকাটা এতবার লিখলি কেন? স্যার, লেজটা তো অনেক লম্বা—ছাত্রের উত্তর। শিক্ষক এবার শাস্তি দিলেন কড়া। বাড়ি থেকে রচনা লিখে আনতেই হবে কাল। ছাত্র লিখল, আমাদের বাড়ি অনেক সুন্দর। লতায়-পাতায় ছাওয়া। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে-যেতে পথিক থমকে দাঁড়ায়, আহা অপূর্ব! বাড়িতে একটি গরু আছে। রাখাল গরু নিয়ে নদীর ধারে যায়। গিয়ে দেখে, নদীতে একটি কুমির। কুমিরের চোয়াল চোখ পা...এবং যথারীতি লেজের খাঁজে খাঁজে রচনা চলতে থাকলে শিক্ষক এবার আরও কঠিন রচনা লিখতে দিলেন তাকে। পলাশীর যুদ্ধ। শুনে, ছাত্র মাথা চুলকায়। এটা তো স্যার জানি না। স্যার হুংকার ছাড়েন, জানিস না? জেনে লিখে আনবি। পরদিন ছাত্র লেখে, পলাশীতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা আর ব্রিটিশ সৈন্যের যুদ্ধ হয়েছিল। নবাবের সৈন্য ছিল কম, যদিও যুদ্ধের অগ্রগতি নবাবের পক্ষেই ছিল। কিন্তু নবাবের সেনাপতি মীরজাফরকে নবাব বিশ্বাস করে খাল কেটে কুমির এনেছিলেন। কুমির খুবই সুন্দর...এরপর রচনাটি যথারীতি অই খাঁজকাটার মধ্যে ঘুরপাক খায়।
আমরা বিশ্বাস করে পাঁচ বছর পর পর খাল কাটি। কুমির আনি। কুমিরের ইয়া লম্বা লেজ। লেজের গায়ে খাঁজকাটা, খাঁজকাটা খাঁজকাটা...।
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com
No comments