গদ্যকার্টুন-দেশ চালাচ্ছে কে? by আনিসুল হক
দেশ কে চালাচ্ছে? মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন। এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব। কিন্তু তার আগে একটা গল্প বলে নিই।
এই গল্পটা শিবরামের। হুবহু মনে নেই, কিন্তু আমিও তো লেখক, বানিয়ে বানিয়ে একটা শিবরামের গল্প বলতে পারব না?
একজন লোক, ধরা যাক, তাঁর নাম কনক, তিনি গেলেন আঁধারপুর গ্রামে। একেবারে অজপাড়াগাঁ।
এই গল্পটা শিবরামের। হুবহু মনে নেই, কিন্তু আমিও তো লেখক, বানিয়ে বানিয়ে একটা শিবরামের গল্প বলতে পারব না?
একজন লোক, ধরা যাক, তাঁর নাম কনক, তিনি গেলেন আঁধারপুর গ্রামে। একেবারে অজপাড়াগাঁ।
মহাসড়ক থেকে আরও ভেতরে যেতে হয়। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। সেদিন ছিল অমাবস্যা। চারদিকে ঘনঘোর অন্ধকার। এখানে-ওখানে পেঁচা ডাকছে। দূরে কোথাও আর্তনাদ করে উঠল একটা কুকুর। শিমুলগাছে ঠিক মানবশিশুর কণ্ঠে ডেকে উঠছে শকুনি।
সবাই কনককে বলে রেখেছিল, শ্যাওড়াপাড়া বাসস্টপটা সন্ধ্যার পরে এড়িয়ে চলতে। জায়গাটা নাকি ভালো না। ওখানে নাকি সন্ধ্যার পরে ওনাদের উপদ্রব। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। তিনি এই অমাবস্যার রাতে শ্যাওড়াপাড়া বাসস্টপেই যাচ্ছেন। ওখান থেকেই তাঁকে শহরের বাস ধরতে হবে।
তিনি মহাসড়কে উঠলেন।
অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আশপাশেও কোনো জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। তিনি নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে উঠছেন।
একটার পর একটা বাস ধেয়ে আসছে, আর না থেমেই চলে যাচ্ছে। এ তো ভারি মুশকিল। কোনো গাড়িঘোড়া থামবে না নাকি। এই শ্যাওড়াতলাতেই কি তাঁকে রাত কাটাতে হবে? তাহলে আর রক্ষে নেই!
আর কোনো গাড়ি আসছে না। এর পরে যে গাড়ি আসবে, সেটাই থামাতে হবে। কোনো না কোনো কায়দা করতেই হবে। কী করবেন তিনি?
একটা গাছের গুঁড়ি কেটে ফেলে রাখলেও তো একটা গাড়ি থামত।
ভূতপ্রেতে তিনি বিশ্বাস করেন না। তাতে কী? তিনি বিশ্বাস না করলেই যে ভূত তাঁর কোনো ক্ষতি করবে না, সেটা কীভাবে বলা যাবে?
তবে তিনি নিশ্চিত, অশরীরী কিছু নেই। অলৌকিকও কিছু নেই। শুধু আজকের এই বিপদটা কেটে গেলেই তাঁর বিশ্বাস আরও পোক্ত হবে।
একজোড়া হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। একটা গাড়ি এদিকেই আসছে। আর মনে হচ্ছে, গাড়িটা আসছে ধীরে ধীরে।
এটাতেই লাফিয়ে উঠতে হবে। যা-ই হোক না কেন।
গাড়িটা বোধ হচ্ছে একটা ট্যাক্সি। এই তো চাইছিলাম। ধীরে আসছে। বোধ হয় তাঁকে হাত নাড়তে দেখে স্লো করেছে গতিবেগ।
কনক এক ঝটকায় গাড়ির দরজা খুলে উঠে পড়লেন তাতে।
যাক, ওঠা গেল।
কিন্তু এ কী?
গাড়িতে তো কোনো ড্রাইভার নেই!!
গাড়ি চলছে কী করে?
তিনি অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু শ্যাওড়াতলাতেই এই রকম কাণ্ড কেবল ঘটতে পারে। গাড়ি চলতে পারে, যাতে কোনো ড্রাইভার নেই।
কনক জ্ঞান হারালেন।
তাঁর জ্ঞান যখন ফিরল, তখনো তিনি গাড়িতে। পেছনের সিটে কাত হয়ে পড়ে আছেন। গাড়ি চলছে। তিনি আস্তে করে মাথা তুললেন। না, সত্যি গাড়িতে কোনো ড্রাইভার নেই।
তিনি দুপাশে তাকালেন। আলোয় চারদিক ঝকঝক করছে। তাঁরা শহরের উপকণ্ঠে এসে গেছেন। চারদিকে লোকজন, রিকশা, বেবিট্যাক্সি।
তিনি পেছনে তাকালেন। দেখলেন, ঘর্মাক্ত একজন ড্রাইভার গাড়িটা ঠেলছে।
কোনো কারণে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে, তাই বেচারা ড্রাইভার গাড়িটা ঠেলে শহরে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রিয় পাঠক, আশা করি, এবার আপনারা বুঝেছেন, দেশ কে চালাচ্ছে। দেশ চালকই চালাচ্ছে। তবে সামনে বসে নয়। পেছন থেকে ঠেলে। কারণ কী? কারণ ইঞ্জিন নষ্ট।
ইঞ্জিন নষ্ট হলে সারা রাত ঠেলে নিয়ে যাওয়ার কী হলো? কোনো একটা ওয়ার্কশপে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিন সারানোর চেষ্টা করলেই তো হতো!
এখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে। এই কবিতাটাও আমি হুবহু মনে করতে পারব না। বানিয়ে বানিয়ে এর লাইনগুলো বলে ফেলব।
রাগী লোকেরা কখনো কবিতা লিখতে পারে না,
তারা ভীষণ চেঁচায়।
আমি একজন রাগী লোককে জানি, নদীর গতিপথ কেন সরলরেখার মতো সোজা নয়, এই নিয়ে লোকটা রাগারাগি করছিল।
এই লোকটা কখনো কবিতা লিখতে পারবে না।
হাতে একগোছা চাবি,
লোকটা তালা খুলবার বদলে তালা ভাঙবার কথা ভাবছিল...
ইঞ্জিন সারাতে হয় বুদ্ধি দিয়ে। রাগ-ক্রোধ-ক্ষোভ দিয়ে নয়। হাতে চাবি থাকতে যদি আপনি তালা ভাঙার রাস্তা নেন, ইঞ্জিন নষ্ট হবেই।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নিয়ে জেদাজেদির পরিণামটা যে ভালো হলো না, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
পাকিস্তানের টাকা, ভারতের টাকা
নির্বাচন করার সময় বাংলাদেশের প্রধান দলগুলো প্রতিবেশী দেশ থেকে টাকা পায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত আছে।
আমরা এ বিষয়ে কোনো বিতর্কই করব না।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশ থেকে টাকাপয়সা গ্রহণ করে না।
একটা কৌতুক বলি!
আমেরিকার নিউইয়র্কের ঘটনা। এক ফ্ল্যাটবাড়িতে দোরবেল বেজে উঠল। বাসায় কেউ নেই। বাড়ির কর্ত্রী একা। তিনি ছিলেন গোসলখানায়। তোয়ালে জড়িয়ে তিনি দরজায় এসে বললেন, কে?
‘আমি পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। দরজাটা একটু খুলবেন?’
ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন।
ভদ্রলোক বললেন, আপনি যদি আপনার তোয়ালেটা এক পলকের জন্য একটু সরান, আপনাকে আমি এক শ ডলার দেব।
তাঁর হাতে সত্যি একটা এক শ ডলারের নোট।
ভদ্রমহিলা ভাবলেন, কিবা হবে আর। তিনি এক পলকের জন্যে তোয়ালে সরিয়ে আবার যথাস্থানে পেঁচিয়ে নিলেন। ভদ্রলোক মহিলাকে এক শ ডলারের নোট দিয়ে চলে গেলেন।
এ সময় ভদ্রমহিলার বাড়ির ফোন বেজে উঠল। তাঁর স্বামী ফোন করেছেন—‘শোনো, পাশের ফ্ল্যাটের জন আসবে। আমি ওর কাছে এক শ ডলার পাই। ও তোমাকে ডলার দিয়ে যাবে।’
প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা নিতে নেই, আমরা জানি। কাজেই আমরা প্রতিবেশীর কাছ থেকে কোনো রকমের টাকাপয়সা নিই না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
সবাই কনককে বলে রেখেছিল, শ্যাওড়াপাড়া বাসস্টপটা সন্ধ্যার পরে এড়িয়ে চলতে। জায়গাটা নাকি ভালো না। ওখানে নাকি সন্ধ্যার পরে ওনাদের উপদ্রব। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। তিনি এই অমাবস্যার রাতে শ্যাওড়াপাড়া বাসস্টপেই যাচ্ছেন। ওখান থেকেই তাঁকে শহরের বাস ধরতে হবে।
তিনি মহাসড়কে উঠলেন।
অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আশপাশেও কোনো জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। তিনি নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে উঠছেন।
একটার পর একটা বাস ধেয়ে আসছে, আর না থেমেই চলে যাচ্ছে। এ তো ভারি মুশকিল। কোনো গাড়িঘোড়া থামবে না নাকি। এই শ্যাওড়াতলাতেই কি তাঁকে রাত কাটাতে হবে? তাহলে আর রক্ষে নেই!
আর কোনো গাড়ি আসছে না। এর পরে যে গাড়ি আসবে, সেটাই থামাতে হবে। কোনো না কোনো কায়দা করতেই হবে। কী করবেন তিনি?
একটা গাছের গুঁড়ি কেটে ফেলে রাখলেও তো একটা গাড়ি থামত।
ভূতপ্রেতে তিনি বিশ্বাস করেন না। তাতে কী? তিনি বিশ্বাস না করলেই যে ভূত তাঁর কোনো ক্ষতি করবে না, সেটা কীভাবে বলা যাবে?
তবে তিনি নিশ্চিত, অশরীরী কিছু নেই। অলৌকিকও কিছু নেই। শুধু আজকের এই বিপদটা কেটে গেলেই তাঁর বিশ্বাস আরও পোক্ত হবে।
একজোড়া হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। একটা গাড়ি এদিকেই আসছে। আর মনে হচ্ছে, গাড়িটা আসছে ধীরে ধীরে।
এটাতেই লাফিয়ে উঠতে হবে। যা-ই হোক না কেন।
গাড়িটা বোধ হচ্ছে একটা ট্যাক্সি। এই তো চাইছিলাম। ধীরে আসছে। বোধ হয় তাঁকে হাত নাড়তে দেখে স্লো করেছে গতিবেগ।
কনক এক ঝটকায় গাড়ির দরজা খুলে উঠে পড়লেন তাতে।
যাক, ওঠা গেল।
কিন্তু এ কী?
গাড়িতে তো কোনো ড্রাইভার নেই!!
গাড়ি চলছে কী করে?
তিনি অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু শ্যাওড়াতলাতেই এই রকম কাণ্ড কেবল ঘটতে পারে। গাড়ি চলতে পারে, যাতে কোনো ড্রাইভার নেই।
কনক জ্ঞান হারালেন।
তাঁর জ্ঞান যখন ফিরল, তখনো তিনি গাড়িতে। পেছনের সিটে কাত হয়ে পড়ে আছেন। গাড়ি চলছে। তিনি আস্তে করে মাথা তুললেন। না, সত্যি গাড়িতে কোনো ড্রাইভার নেই।
তিনি দুপাশে তাকালেন। আলোয় চারদিক ঝকঝক করছে। তাঁরা শহরের উপকণ্ঠে এসে গেছেন। চারদিকে লোকজন, রিকশা, বেবিট্যাক্সি।
তিনি পেছনে তাকালেন। দেখলেন, ঘর্মাক্ত একজন ড্রাইভার গাড়িটা ঠেলছে।
কোনো কারণে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে, তাই বেচারা ড্রাইভার গাড়িটা ঠেলে শহরে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রিয় পাঠক, আশা করি, এবার আপনারা বুঝেছেন, দেশ কে চালাচ্ছে। দেশ চালকই চালাচ্ছে। তবে সামনে বসে নয়। পেছন থেকে ঠেলে। কারণ কী? কারণ ইঞ্জিন নষ্ট।
ইঞ্জিন নষ্ট হলে সারা রাত ঠেলে নিয়ে যাওয়ার কী হলো? কোনো একটা ওয়ার্কশপে দাঁড়িয়ে ইঞ্জিন সারানোর চেষ্টা করলেই তো হতো!
এখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে। এই কবিতাটাও আমি হুবহু মনে করতে পারব না। বানিয়ে বানিয়ে এর লাইনগুলো বলে ফেলব।
রাগী লোকেরা কখনো কবিতা লিখতে পারে না,
তারা ভীষণ চেঁচায়।
আমি একজন রাগী লোককে জানি, নদীর গতিপথ কেন সরলরেখার মতো সোজা নয়, এই নিয়ে লোকটা রাগারাগি করছিল।
এই লোকটা কখনো কবিতা লিখতে পারবে না।
হাতে একগোছা চাবি,
লোকটা তালা খুলবার বদলে তালা ভাঙবার কথা ভাবছিল...
ইঞ্জিন সারাতে হয় বুদ্ধি দিয়ে। রাগ-ক্রোধ-ক্ষোভ দিয়ে নয়। হাতে চাবি থাকতে যদি আপনি তালা ভাঙার রাস্তা নেন, ইঞ্জিন নষ্ট হবেই।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নিয়ে জেদাজেদির পরিণামটা যে ভালো হলো না, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
পাকিস্তানের টাকা, ভারতের টাকা
নির্বাচন করার সময় বাংলাদেশের প্রধান দলগুলো প্রতিবেশী দেশ থেকে টাকা পায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত আছে।
আমরা এ বিষয়ে কোনো বিতর্কই করব না।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশ থেকে টাকাপয়সা গ্রহণ করে না।
একটা কৌতুক বলি!
আমেরিকার নিউইয়র্কের ঘটনা। এক ফ্ল্যাটবাড়িতে দোরবেল বেজে উঠল। বাসায় কেউ নেই। বাড়ির কর্ত্রী একা। তিনি ছিলেন গোসলখানায়। তোয়ালে জড়িয়ে তিনি দরজায় এসে বললেন, কে?
‘আমি পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। দরজাটা একটু খুলবেন?’
ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন।
ভদ্রলোক বললেন, আপনি যদি আপনার তোয়ালেটা এক পলকের জন্য একটু সরান, আপনাকে আমি এক শ ডলার দেব।
তাঁর হাতে সত্যি একটা এক শ ডলারের নোট।
ভদ্রমহিলা ভাবলেন, কিবা হবে আর। তিনি এক পলকের জন্যে তোয়ালে সরিয়ে আবার যথাস্থানে পেঁচিয়ে নিলেন। ভদ্রলোক মহিলাকে এক শ ডলারের নোট দিয়ে চলে গেলেন।
এ সময় ভদ্রমহিলার বাড়ির ফোন বেজে উঠল। তাঁর স্বামী ফোন করেছেন—‘শোনো, পাশের ফ্ল্যাটের জন আসবে। আমি ওর কাছে এক শ ডলার পাই। ও তোমাকে ডলার দিয়ে যাবে।’
প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা নিতে নেই, আমরা জানি। কাজেই আমরা প্রতিবেশীর কাছ থেকে কোনো রকমের টাকাপয়সা নিই না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments