খালেদা জিয়ার ব্রিটেন সফর : দেশের প্রাপ্তি এবং অনুজ্জ্বল অভিবাস by ফারুক যোশী

খালেদা জিয়া লন্ডনে এসেছিলেন। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা তিনি। এ ছাড়া তিন তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ব্যক্তি হিসেবে এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন খালেদা জিয়া বিদেশের বিভিন্ন দেশে সম্মানিত মানুষ হিসেবেই আসীন থাকার কথা।


কিন্তু তার পরও খালেদা জিয়া লন্ডনে যে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছিলেন, তা কি ঠিকমতো করে যেতে পেরেছেন, তিনি বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চেয়েছেন নাকি দেশ নিয়ে একটি নেগেটিভ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চেয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে প্রবাসীদের মধ্যে। খালেদা জিয়া ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। আর কিছু না হোক, অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও তিনি চেয়েছিলেন ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে দেখা করার। এই সাক্ষাৎটা তাঁর প্রয়োজন ছিল। আর সে জন্যই অ্যাসাইনমেন্ট সফল করতে ব্রিটেনে আগেই এসেছিলেন একসময় ব্রিটেনে অবস্থানকারী দুজন মানুষ। একজন সাংবাদিক শফিক রেহমান, অন্যজন খালেদা জিয়ার শাসনামলের লন্ডনের হাইকমিশনার সাবিহ উদ্দিন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁরা সার্থক হতে পারেননি। এই সাক্ষাৎটা তাঁরা করিয়ে দিতে পারেননি। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তিনি অনেক কিছুই বলতে চেয়েছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকে। কী এই কথাগুলো? যে কথাগুলো তিনি বলতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর প্রধানমন্ত্রীকে, তা অবশ্য তিনি বলেছেন। যাঁদের বলেছেন, তাঁরা শুনেছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রোশনারা আলী এবং হয়তো তাঁর মাধ্যমেই ম্যানেজ করা লেবার দলের নেতা তথা বিরোধীদলীয় নেতা এড মিলিবার্ন। এ ছাড়া দেখা করেছেন তিনি মানবাধিকার কর্মী লর্ড এভারভারির সঙ্গে, কথা বলেছেন কনজারভেটিভ দলীয় কো-চেয়ারম্যান সৈয়দা ওয়ার্সীর সঙ্গে, কথা হয়েছে দু-একজন মন্ত্রীর সঙ্গেও। এতে তিনি বলেছেন বাংলাদেশের কথা।
বাংলাদেশের কোনো দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ নিয়ে আলোচনা তিনি করেননি। শুধু উচ্চারণ করেছেন কিভাবে বাংলাদেশ এখন আইনের শাসনের ঊধর্ে্ব উঠে গেছে। সংসদ নিষ্ক্রিয়, সংসদের পরিবর্তে দেশ চালাচ্ছেন কোর্ট। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কিভাবে একটি স্বাধীন ও পবিত্র আদালতকে ব্যবহার করছে সরকার তার ইচ্ছামতো। অর্থাৎ তাঁর ইচ্ছামতো যা কিছু বলা যায়, তা-ই তিনি বলেছেন। আর সে জন্যই তাঁকেও পড়তে হয়েছে বেকায়দায়। কারণ তিনি কিংবা আমাদের এই পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরা দেশ সম্পর্কে যাচ্ছেতাই বলে বলে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাঁরা বিকল্প কোনো প্রস্তাব না রেখে বিরোধিতা করতে পারেন। কারণ এরা অধস্তন নেতাদের স্তুতিবাক্য শুনেই অভ্যস্ত, যা তাঁরা বলেন তা-ই হয়ে যায় বেদবাক্য। যুক্তি তাঁদের কাছে মূল্যহীন। সে জন্য খালেদা জিয়া যখন দেশের চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তখন এভারবারির পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি। কারণ তিনি হয়তো মনে করেছিলেন তাঁর অধস্তন নেতাদের মতোই এভারবারি শুনে যাবেন আর মাথা দোলাবেন। বরং লর্ড তাঁর শাসনামলকেই যেন দায়ী করলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের এই অশান্তির জন্য। অন্যদিকে যে প্রত্যাশা নিয়ে খালেদা জিয়া এভারবারিকে অবহিত করেছিলেন বাংলাদেশে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হওয়ার কথা, সে প্রত্যাশার গুড়েবালি। কারণ এভারবারি বলেছেন, তিনি সহসাই খালেদা জিয়ার এ অভিযোগ ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন না, বরং তিনি বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গেই এ ব্যাপারে আলাপ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দিনের পর দিন এবং এটা করছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার। এ সময়ের ব্রিটেনের একজন ক্ষমতাবান রাজনীতিক সৈয়দা ওয়ার্সীকে খালেদা জিয়া তাঁর ভাষায় এভাবেই বাংলাদেশের নেগেটিভ ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। এই ফিরিস্তি পাকাপোক্ত করতে বাংলাদেশে মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রয়োজনের কথা যখন তিনি তুলে ধরেন, তখন সৈয়দা ওয়ার্সীর মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিকল্প সরকারের ধারণার ব্যাখ্যা চাইলে আমতা আমতার মাঝেই অন্যের ওপর ছেড়ে দিতে হয় ব্যাখ্যার ভার। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হওয়ায় তিনি হয়তো মনে করেছিলেন, এখানে খালেদা জিয়া একটু বাড়তি সুবিধা পেতেই পারেন। কিন্তু ব্রিটেনের রাজনীতি তো আর হাজার হাজার মানুষের শুধু জনসভার দর্শক কিংবা শোনার রাজনীতি নয়। এখানে জবাবদিহিতা আছে। জবাবদিহিতার কারণে রাজনীতিই এখানে প্রাধান্য পায়।
খালেদা জিয়ার এই ব্রিটেনে আছে এক বিশাল কর্মীবাহিনী। এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। বিএনপির এখানে আছে একটি ভিত্তি। আর সে কারণে খালেদা জিয়া তাঁর কর্মীবাহিনীকে সুসংগঠিত করতে ব্রিটেন কিংবা আমেরিকা সফরে যেতেই পারেন। তাঁর কর্মীবাহিনীর কাছে তুলে ধরতে পারেন তাঁর দলের রাজনৈতিক দর্শন। দীর্ঘদিনের না দেখা কর্মীবাহিনী তাঁর কিংবা তাঁদের দলের এজেন্ডাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য খালেদা জিয়ার নির্দেশকে অবশ্যই সম্মান দেবেন_এটাই দলীয় রাজনীতির দর্শন। কিন্তু তাঁর দলের রাজনৈতিক দর্শন এখন বাংলাদেশকে একটা অকার্যকর-ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু, তা নিয়ে যদি ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধরনা দেওয়া হয়, তাহলে তা কোন রাজনীতিতে চলে যায়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। এ দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তাঁর একটি বিশাল দল আছে। এই দলের নেত্রী তিনি। অথচ তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচন করতে সহযোগিতা চান ব্রিটেনের কাছে। আমাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে দৈন্য আছে ঠিকই, কিন্তু এ কোন রাজনৈতিক দৈন্য, যা দিয়ে খালেদা জিয়া প্রমাণ করলেন যে জনগণ আসলে কোনো শক্তির উৎসই নয়। তিনি আরো প্রমাণ করলেন, সরকারে যেতে হলে আমেরিকা-ব্রিটেন কিংবা ইউরোপের ওপরই ভর করতে হবে তাঁদের। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের তো আছেই একটি সুদৃঢ় ভিত্তি। সেই স্বাধীনতা আন্দোলন থেকেই। সে কারণে আওয়ামী লীগও এখানে খালেদা জিয়ার সফরকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে গরম রেখেছে ব্রিটেন। এতে সফলতা-ব্যর্থতা কী এসেছে জানি না, তবে হিথরো এয়ারপোর্টে হেসেছে ভিনদেশি মানুষ মারামারি আর স্লোগানের বাংলাদেশি হুঙ্কারে। খালেদা জিয়ার টার্গেটই ছিল যেন কিভাবে ডাউনিং স্ট্রিট ছোঁয়া যায়। কিভাবে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটকে দেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা দেওয়া যায়। সময়-সুযোগে ব্রাসেলসে (গত বছর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ) ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সামনে গিয়ে এভাবেই বলে দেওয়া হয়েছিল আমাদের কথা সারা ইউরোপের প্রতিনিধির কাছে। এভাবেই আমাদের দারিদ্র্য, হিংস্রতা, জঙ্গিত্ব, নীতিহীনতার কথা আমাদের বড় দলগুলো জানিয়ে দিতে চায় সারা পৃথিবীর কাছে। খালেদা জিয়ার আগমনের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের বাঙালিরা সরকারের একটি চিত্র হয়তো পেতে পারত, হয়তো আমরা পেয়েছিও। প্রবাসের মানুষগুলো কিংবা অভিবাসী বাঙালিরা দেশ সম্পর্কে আসলেও খুব একটা অজ্ঞ নয়। আমরা অন্ধকারেও নই। তবুও তাঁর কাছ থেকে আমরা শুনেছি অনেক কিছু। কিন্তু আমরা কি প্রত্যাশা করেছিলাম বিএনপির রাজনৈতিক খসড়া বাস্তবায়নে ডাউনিং স্ট্রিটের মুরবি্বদের হস্তক্ষেপ। এ যেন ক্ষমতার জন্য ভিক্ষার থলে নিয়ে হাজার-কোটি টাকার বিদেশ সফর। আমাদের এই বড় দলগুলো সার্বভৌমত্বের কথা বলে, আবার ক্ষমতার স্বাদ নিতে পালাবদল চায় ইউরোপিয়ান মুরবি্বদের দিয়ে। এ এক নষ্ট রাজনীতির মাঝে চলছে আমাদের দোলাচল। এই দোলাচলের কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আমাদের নিয়ে খেলে।
আজ ৪০ বছরের মাথায় এসেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতিতে কতটুকুইবা পরিবর্তন এসেছে, তা এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ। রাজনীতিতে টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে গিয়ে বিশেষত বড় দলগুলো কোনো না কোনোভাবে যে দুর্বৃত্তায়ন প্রতিষ্ঠা করেনি কিংবা করছে না, তা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু নেতা-নেত্রীদের বিদেশ সফরকে কেন্দ্র করে যেভাবে প্রশ্নবোধক হয়ে উঠছে আমাদের রাজনীতি বহির্বিশ্বে, তা কি ভেবে দেখছি আমরা? খালেদা জিয়ার দেশ-সমালোচনায় একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ন হয়েছে ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, ঠিক সেভাবেই দলগুলোর প্রতিবাদ আর পাল্টা প্রতিবাদেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হয়েছে অনুজ্জ্বল বহির্বিশ্বে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া মানে এখানে অভিবাসী বাঙালিদেরও হেয়প্রতিপন্ন করা। অভিবাসী বাঙালিরা অন্তত তাদের প্রয়োজনে এই সংস্কৃতি থেকে কি বেরিয়ে আসতে পারে না? ভেবে দেখতে হবে, দলবাজি আমাদের আগামী প্রজন্মের সম্মান-সম্ভাবনাকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়? এর মাধ্যমে দেশের-ই বা প্রাপ্তি কী?
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক
faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.