সমকালীন প্রসঙ্গ-সাংবাদিকদের আন্দোলনে গণতান্ত্রিক উপাদানের ঘাটতি by বদরুদ্দীন উমর
সাংবাদিকরা যেভাবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তির জন্য আন্দোলন করছেন তাতে তাদের আন্দোলন শক্তিশালী হতে দেখা যাচ্ছে না। সংক্ষিপ্ত অনশন, মানববন্ধন ইত্যাদি হচ্ছে তাদের আন্দোলনের পদ্ধতি; কিন্তু এসব পদ্ধতি কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারে না। কারণ এর চরিত্র প্রতীকীর বেশি কিছু নয়।
এর মধ্যে তেমন কোনো শক্তি নেই। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আন্দোলনের এই পদ্ধতি ও কৌশল সম্পূর্ণ অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পরও বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনকারীরা এ দেশে এখনও এটাই অনুসরণ করছেন। এর থেকে সন্দেহ হয় যে, যারা আন্দোলন করছেন তারা এই আন্দোলনকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে এক ধরনের 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' ধরনের আন্দোলনের মধ্যেই নিজেদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ করছেন
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার পর অনেকে আশা করেছিলেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা সহজেই হবে। বিশেষ করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর এটা তাদের মনে হয়েছিল। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পর এতদিন পার হলেও এর সুরাহা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এখন ভোল পাল্টে বলছেন, এ ধরনের একটা খুনের ঘটনার তদন্ত তাড়াহুড়ো করে অল্পকালের মধ্যে শেষ করা যায় না। যদি না যায় তাহলে তিনি নিজে তড়িঘড়ি করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধী গ্রেফতারের কথা কেন বলেছিলেন? হতে পারে অপরাধীদের প্রকৃত পরিচয় তার তখন জানা ছিল না। এখন সে পরিচয় আন্দাজ করেই তিনি উল্টো গীত গাইছেন।
এ কথা বলার কারণ, সাংবাদিকরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রকারান্তরে সরকারকেই দায়ী করছেন। কেউ কেউ মনে করেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনার তদন্তের তদারকি নিজের হাতে নেওয়ার পর এদিক দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু দেখা গেল যে, তদন্তের তদারকির দায়িত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিজের হাতে যাওয়ার পর এদিক দিয়ে উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হলো। অবস্থা দেখে মনে হয়, সাক্ষ্য-প্রমাণের কোনো হদিস এখন আর কারও পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।
সাংবাদিকরা যেভাবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তির জন্য আন্দোলন করছেন তাতে তাদের আন্দোলন শক্তিশালী হতে দেখা যাচ্ছে না। সংক্ষিপ্ত অনশন, মানববন্ধন ইত্যাদি হচ্ছে তাদের আন্দোলনের পদ্ধতি; কিন্তু এসব পদ্ধতি কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারে না। কারণ এর চরিত্র প্রতীকীর বেশি কিছু নয়। এর মধ্যে তেমন কোনো শক্তি নেই। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আন্দোলনের এই পদ্ধতি ও কৌশল সম্পূর্ণ অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পরও বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনকারীরা এ দেশে এখনও এটাই অনুসরণ করছেন। এর থেকে সন্দেহ হয় যে, যারা আন্দোলন করছেন তারা এই আন্দোলনকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে এক ধরনের 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' ধরনের আন্দোলনের মধ্যেই নিজেদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ করছেন।
এ ক্ষেত্রে যা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার তা হলো, এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাই এ দেশে একমাত্র বা অল্পসংখ্যক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটি নয়। নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে হচ্ছে। এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশে অরাজকতা বৃদ্ধি পেয়ে যে কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়। এই ব্যাপক অরাজকতা জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এক বড় হুমকি। এই হুমকির মুখেই এখন জনগণ নিজেদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করছেন।
সাংবাদিকরা সংগঠিত। এ কারণে সাংবাদিক দম্পতি হত্যার প্রতিবাদে তারা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করছেন। কিন্তু যতই তারা সংগঠিত হোন, সংবাদমাধ্যমের শক্তি যতই প্রবল হোক, দেশে যেখানে ব্যাপকভাবে নানা স্থানে এ ধরনের নানা কার্যক্ষেত্রে অরাজকতা চলছে, খুন-খারাবিসহ বিপুল অধিকাংশ অপরাধেরই বিচার সরকার এবং আদালতের দ্বারা হচ্ছে না, অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা যেখানে নেই বলেই চলে, সেখানে সাংবাদিকদের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হবে এবং সাংবাদিকরা নিরাপত্তা হুমকির বাইরে থাকবেন, এই চিন্তা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক নয়।
সাংবাদিকরা নিজেরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করছেন। কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে এই ঐক্য সত্ত্বেও এ আন্দোলন জনবিচ্ছিন্ন। যেহেতু সাধারণভাবে জনগণের জীবনেও কোনো নিরাপত্তা নেই, তাই এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকদের স্বার্থের একটা যোগ আছে। এই যোগসূত্র বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই গুরুত্বের উপলব্ধি সাংবাদিকদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। থাকলে তারা নিজেদের এই আন্দোলনের সঙ্গে জনগণকে যুক্ত করার চেষ্টা করতেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এটা করতেন না।
সাংবাদিকরা মাঝে মধ্যে প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকার সভা-সমাবেশের ওপর, মিছিলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে সেটা মান্য করেই তারা কাজ করছেন। এই সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দুই বছর কার্যত সামরিক শাসন ছিল। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত ঢাকার মুক্তাঙ্গন, পল্টন ময়দান ইত্যাদি জায়গায় সভা-সমাবেশ হতো, যদিও এর জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগত। কিন্তু এখন এসব জায়গায় সরকার সভা-সমাবেশ একেবারে নিষিদ্ধ করেছে। কোন আইনে এবং গণতন্ত্রের কোন রীতি অনুযায়ী তারা এটা করেছে এর কোনো ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। হুকুম জারি করেই তারা জনগণের সভা-সমাবেশ-মিছিলের অধিকার হরণ করে রেখেছে। এর বিরুদ্ধে সাংবাদিকদেরও দাঁড়ানো দরকার। তাদের আন্দোলনকে বৃহত্তর পরিধির মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। তারা সভা-সমাবেশের জন্য মুক্তাঙ্গন ব্যবহার করতে দাঁড়ালে জনগণেরও যথেষ্ট সমর্থন লাভ করতে পারতেন। সরকারি প্রশাসন এ ধরনের সভা-সমাবেশের ওপর আক্রমণ করার আগে দু'বার চিন্তা করত। আক্রমণ করলে জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হতো তার ফলে সাংবাদিকদের আন্দোলন নিঃসন্দেহে জোরদার হতো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকরা সেদিকে পা বাড়াচ্ছেন না। আন্দোলনকে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়া, তার বিস্তার ঘটানোর কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই! আগেও বলেছি যে, তারা যেভাবে আন্দোলন করছেন এটা একটা গা বাঁচিয়ে চলার ব্যাপার। কিন্তু গা বাঁচিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলন করলে কোনো আন্দোলনের সাফল্যই সম্ভব নয়। বিশেষত যার বা যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয় তারা যদি বোঝে আন্দোলনকারীদের এই সীমাবদ্ধতা, তাহলে এই দুর্বলতাকে হিসাবের মধ্যে রেখেই তারা নিজেদের অবস্থান অটুট রাখে। তা পরিবর্তন করে না। বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। সাংবাদিকদের দাবির মুখে সরকারের অটল অবস্থার কারণ এটাই।
জনগণের ওপর যে রাজনৈতিক নির্যাতন এখন চলছে এটা শুধু আওয়ামী লীগেরই কাজ এটা মনে করা ঠিক নয়, যদিও আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের আমলে এই নির্যাতন এবং চারদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এখন আগের যে কোনো সময়ের থেকেও বেশি। কিন্তু এর পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের আমলে এ ধরনের নির্যাতন, সভা-সমাবেশের ওপর আক্রমণ ছিল না, এটা একেবারেই ঠিক নয়। তখনও বিরোধীদের সভা-সমাবেশের ওপর নানাভাবে বিধিনিষেধ ছিল। তখনও রাস্তার ওপর মিছিল পুলিশের দ্বারা আক্রান্ত ও ছত্রভঙ্গ হতো। এর কারণ বাংলাদেশের সমগ্র শাসকশ্রেণীই এখন ফ্যাসিস্ট চরিত্র পরিগ্রহ করেছে। তাদের এই চরিত্রের অবনতিও ঘটছে, যার প্রমাণ প্রতিদিনের নানা ঘটনার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নির্যাতনের জোর সমালোচনা বিএনপি করছে। কিন্তু এরপর যদি তারা আবার সরকার গঠন করে ক্ষমতায় বসে তাতে জনগণকে যে তারা নিরাপত্তা প্রদান করবে, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দেবে এবং তাদের ওপর রাজনৈতিক নির্যাতন করবে না, এটা বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে এক অবাস্তব চিন্তা। শাসকশ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই তারা এসব করবে। এদিক দিয়ে সামরিক-বেসামরিক সরকারের মধ্যেও বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, সাংবাদিকরা নিজেদের আন্দোলন করতে দাঁড়িয়ে কেন এই সাধারণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন করছেন না! কেন তারা জনগণের থেকে, তাদের স্বার্থের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছেন? এর কারণ কি এই যে, তাদের ওপর আক্রমণ হলেও তারা এই আক্রমণকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার অর্থাৎ শাসকশ্রেণীর অংশ হিসেবে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যাপার মনে করছেন? এই সন্দেহ অমূলক নয়। কারণ দেখা যায় যে, সাংবাদিকরা তাদের নিজেদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্য স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে কাজ করলেও, তার ওপর সরকারি আক্রমণ প্রতিহত করার আন্দোলন করলেও, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার, সভা-সমাবেশ-মিছিলের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তাদের পত্রিকার কোনো পাতা ব্যবহার করেন না। এ সংক্রান্ত অন্যদের কিছু কিছু লেখা তারা প্রকাশ করলেও তারা নিজেরা এ নিয়ে কোনো সমর্থনমূলক আন্দোলন করেন না।
এটা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে যেভাবে দেখা যায় তার থেকেও স্পষ্টভাবে দেখা যায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ শাসকশ্রেণীর অন্যান্য বিরোধী দলের ক্ষেত্রে। বিএনপিকে সভা-সমাবেশের জন্য তাদের অফিসের সামনে আটকে রাখার বিরুদ্ধে তারা কথা বললেও জোর সক্রিয় আন্দোলন করতে যা বোঝায় সেটা তারা করেন না। কারণ তারা জানেন যে, জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ-মিছিলের স্বাধীনতার কথা বলা তাদের নিজেদের শ্রেণী আন্দোলনের দিক দিয়ে বিপজ্জনক। অতীতে তারা জনগণের বিরুদ্ধে এদিক দিয়ে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছিলেন এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তারা আবার একই কাজ করবেন। কাজেই তাদের নিজেদের ওপর আওয়ামী লীগের আক্রমণকে তারা নিজেদের শ্রেণীর গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান। এর জন্য কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলন তারা চান না এবং শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই তারা এটা চাইতে পারেন না।
সাংবাদিকরা যেভাবে নিজেদের আন্দোলনকে সাংবাদিক মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন এবং এ কাজ করতে গিয়ে যেভাবে নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন রেখেছেন, এটা দেখে এই সিদ্ধান্তে আসা স্বাভাবিক যে, তারাও শাসকশ্রেণীর অংশ হিসেবে জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন
রাখতে সচেষ্ট।
২.৪.২০১২
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার পর অনেকে আশা করেছিলেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা সহজেই হবে। বিশেষ করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর এটা তাদের মনে হয়েছিল। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পর এতদিন পার হলেও এর সুরাহা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এখন ভোল পাল্টে বলছেন, এ ধরনের একটা খুনের ঘটনার তদন্ত তাড়াহুড়ো করে অল্পকালের মধ্যে শেষ করা যায় না। যদি না যায় তাহলে তিনি নিজে তড়িঘড়ি করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধী গ্রেফতারের কথা কেন বলেছিলেন? হতে পারে অপরাধীদের প্রকৃত পরিচয় তার তখন জানা ছিল না। এখন সে পরিচয় আন্দাজ করেই তিনি উল্টো গীত গাইছেন।
এ কথা বলার কারণ, সাংবাদিকরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রকারান্তরে সরকারকেই দায়ী করছেন। কেউ কেউ মনে করেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনার তদন্তের তদারকি নিজের হাতে নেওয়ার পর এদিক দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু দেখা গেল যে, তদন্তের তদারকির দায়িত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিজের হাতে যাওয়ার পর এদিক দিয়ে উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হলো। অবস্থা দেখে মনে হয়, সাক্ষ্য-প্রমাণের কোনো হদিস এখন আর কারও পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।
সাংবাদিকরা যেভাবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তির জন্য আন্দোলন করছেন তাতে তাদের আন্দোলন শক্তিশালী হতে দেখা যাচ্ছে না। সংক্ষিপ্ত অনশন, মানববন্ধন ইত্যাদি হচ্ছে তাদের আন্দোলনের পদ্ধতি; কিন্তু এসব পদ্ধতি কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারে না। কারণ এর চরিত্র প্রতীকীর বেশি কিছু নয়। এর মধ্যে তেমন কোনো শক্তি নেই। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, আন্দোলনের এই পদ্ধতি ও কৌশল সম্পূর্ণ অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পরও বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনকারীরা এ দেশে এখনও এটাই অনুসরণ করছেন। এর থেকে সন্দেহ হয় যে, যারা আন্দোলন করছেন তারা এই আন্দোলনকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে এক ধরনের 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' ধরনের আন্দোলনের মধ্যেই নিজেদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ করছেন।
এ ক্ষেত্রে যা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার তা হলো, এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাই এ দেশে একমাত্র বা অল্পসংখ্যক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটি নয়। নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে হচ্ছে। এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশে অরাজকতা বৃদ্ধি পেয়ে যে কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়। এই ব্যাপক অরাজকতা জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এক বড় হুমকি। এই হুমকির মুখেই এখন জনগণ নিজেদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করছেন।
সাংবাদিকরা সংগঠিত। এ কারণে সাংবাদিক দম্পতি হত্যার প্রতিবাদে তারা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করছেন। কিন্তু যতই তারা সংগঠিত হোন, সংবাদমাধ্যমের শক্তি যতই প্রবল হোক, দেশে যেখানে ব্যাপকভাবে নানা স্থানে এ ধরনের নানা কার্যক্ষেত্রে অরাজকতা চলছে, খুন-খারাবিসহ বিপুল অধিকাংশ অপরাধেরই বিচার সরকার এবং আদালতের দ্বারা হচ্ছে না, অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা যেখানে নেই বলেই চলে, সেখানে সাংবাদিকদের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হবে এবং সাংবাদিকরা নিরাপত্তা হুমকির বাইরে থাকবেন, এই চিন্তা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক নয়।
সাংবাদিকরা নিজেরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করছেন। কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে এই ঐক্য সত্ত্বেও এ আন্দোলন জনবিচ্ছিন্ন। যেহেতু সাধারণভাবে জনগণের জীবনেও কোনো নিরাপত্তা নেই, তাই এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকদের স্বার্থের একটা যোগ আছে। এই যোগসূত্র বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই গুরুত্বের উপলব্ধি সাংবাদিকদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। থাকলে তারা নিজেদের এই আন্দোলনের সঙ্গে জনগণকে যুক্ত করার চেষ্টা করতেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এটা করতেন না।
সাংবাদিকরা মাঝে মধ্যে প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকার সভা-সমাবেশের ওপর, মিছিলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে সেটা মান্য করেই তারা কাজ করছেন। এই সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দুই বছর কার্যত সামরিক শাসন ছিল। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত ঢাকার মুক্তাঙ্গন, পল্টন ময়দান ইত্যাদি জায়গায় সভা-সমাবেশ হতো, যদিও এর জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগত। কিন্তু এখন এসব জায়গায় সরকার সভা-সমাবেশ একেবারে নিষিদ্ধ করেছে। কোন আইনে এবং গণতন্ত্রের কোন রীতি অনুযায়ী তারা এটা করেছে এর কোনো ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। হুকুম জারি করেই তারা জনগণের সভা-সমাবেশ-মিছিলের অধিকার হরণ করে রেখেছে। এর বিরুদ্ধে সাংবাদিকদেরও দাঁড়ানো দরকার। তাদের আন্দোলনকে বৃহত্তর পরিধির মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। তারা সভা-সমাবেশের জন্য মুক্তাঙ্গন ব্যবহার করতে দাঁড়ালে জনগণেরও যথেষ্ট সমর্থন লাভ করতে পারতেন। সরকারি প্রশাসন এ ধরনের সভা-সমাবেশের ওপর আক্রমণ করার আগে দু'বার চিন্তা করত। আক্রমণ করলে জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হতো তার ফলে সাংবাদিকদের আন্দোলন নিঃসন্দেহে জোরদার হতো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকরা সেদিকে পা বাড়াচ্ছেন না। আন্দোলনকে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়া, তার বিস্তার ঘটানোর কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই! আগেও বলেছি যে, তারা যেভাবে আন্দোলন করছেন এটা একটা গা বাঁচিয়ে চলার ব্যাপার। কিন্তু গা বাঁচিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলন করলে কোনো আন্দোলনের সাফল্যই সম্ভব নয়। বিশেষত যার বা যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয় তারা যদি বোঝে আন্দোলনকারীদের এই সীমাবদ্ধতা, তাহলে এই দুর্বলতাকে হিসাবের মধ্যে রেখেই তারা নিজেদের অবস্থান অটুট রাখে। তা পরিবর্তন করে না। বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। সাংবাদিকদের দাবির মুখে সরকারের অটল অবস্থার কারণ এটাই।
জনগণের ওপর যে রাজনৈতিক নির্যাতন এখন চলছে এটা শুধু আওয়ামী লীগেরই কাজ এটা মনে করা ঠিক নয়, যদিও আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের আমলে এই নির্যাতন এবং চারদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এখন আগের যে কোনো সময়ের থেকেও বেশি। কিন্তু এর পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের আমলে এ ধরনের নির্যাতন, সভা-সমাবেশের ওপর আক্রমণ ছিল না, এটা একেবারেই ঠিক নয়। তখনও বিরোধীদের সভা-সমাবেশের ওপর নানাভাবে বিধিনিষেধ ছিল। তখনও রাস্তার ওপর মিছিল পুলিশের দ্বারা আক্রান্ত ও ছত্রভঙ্গ হতো। এর কারণ বাংলাদেশের সমগ্র শাসকশ্রেণীই এখন ফ্যাসিস্ট চরিত্র পরিগ্রহ করেছে। তাদের এই চরিত্রের অবনতিও ঘটছে, যার প্রমাণ প্রতিদিনের নানা ঘটনার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নির্যাতনের জোর সমালোচনা বিএনপি করছে। কিন্তু এরপর যদি তারা আবার সরকার গঠন করে ক্ষমতায় বসে তাতে জনগণকে যে তারা নিরাপত্তা প্রদান করবে, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দেবে এবং তাদের ওপর রাজনৈতিক নির্যাতন করবে না, এটা বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে এক অবাস্তব চিন্তা। শাসকশ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই তারা এসব করবে। এদিক দিয়ে সামরিক-বেসামরিক সরকারের মধ্যেও বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, সাংবাদিকরা নিজেদের আন্দোলন করতে দাঁড়িয়ে কেন এই সাধারণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন করছেন না! কেন তারা জনগণের থেকে, তাদের স্বার্থের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছেন? এর কারণ কি এই যে, তাদের ওপর আক্রমণ হলেও তারা এই আক্রমণকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার অর্থাৎ শাসকশ্রেণীর অংশ হিসেবে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যাপার মনে করছেন? এই সন্দেহ অমূলক নয়। কারণ দেখা যায় যে, সাংবাদিকরা তাদের নিজেদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্য স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে কাজ করলেও, তার ওপর সরকারি আক্রমণ প্রতিহত করার আন্দোলন করলেও, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার, সভা-সমাবেশ-মিছিলের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তাদের পত্রিকার কোনো পাতা ব্যবহার করেন না। এ সংক্রান্ত অন্যদের কিছু কিছু লেখা তারা প্রকাশ করলেও তারা নিজেরা এ নিয়ে কোনো সমর্থনমূলক আন্দোলন করেন না।
এটা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে যেভাবে দেখা যায় তার থেকেও স্পষ্টভাবে দেখা যায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ শাসকশ্রেণীর অন্যান্য বিরোধী দলের ক্ষেত্রে। বিএনপিকে সভা-সমাবেশের জন্য তাদের অফিসের সামনে আটকে রাখার বিরুদ্ধে তারা কথা বললেও জোর সক্রিয় আন্দোলন করতে যা বোঝায় সেটা তারা করেন না। কারণ তারা জানেন যে, জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ-মিছিলের স্বাধীনতার কথা বলা তাদের নিজেদের শ্রেণী আন্দোলনের দিক দিয়ে বিপজ্জনক। অতীতে তারা জনগণের বিরুদ্ধে এদিক দিয়ে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছিলেন এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তারা আবার একই কাজ করবেন। কাজেই তাদের নিজেদের ওপর আওয়ামী লীগের আক্রমণকে তারা নিজেদের শ্রেণীর গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান। এর জন্য কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলন তারা চান না এবং শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই তারা এটা চাইতে পারেন না।
সাংবাদিকরা যেভাবে নিজেদের আন্দোলনকে সাংবাদিক মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন এবং এ কাজ করতে গিয়ে যেভাবে নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন রেখেছেন, এটা দেখে এই সিদ্ধান্তে আসা স্বাভাবিক যে, তারাও শাসকশ্রেণীর অংশ হিসেবে জনগণের প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন
রাখতে সচেষ্ট।
২.৪.২০১২
No comments