গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা কাম্য
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন মধ্য ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এ লেখা। গেল কিছু দিন ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক-কুরুচিপূর্ণ ভাষার ব্যবহার বাড়ছে বৈ কমছে না। নতুন নতুন মন্ত্রী-উপদেষ্টা-সাংসদ-সরকারি দলের নেতারা এই কুরুচি উদ্গিরণের
তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন। তাদের ভাষা ও শব্দ চয়ন ক্ষেত্রবিশেষে সাধারণ মানুষকেও লজ্জিত ও হতবাক করছে। এসব কটূক্তি-উষ্মা আর ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যাচার করে চরিত্র হননের চেষ্টা থেকে ব্যক্তির পাশাপাশি নানা প্রতিষ্ঠান এমনকি গণমাধ্যমও আক্রান্ত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, সম্মানিত নাগরিকরা যেসব কথা বলার অথবা সরকারের যেসব কাজের জন্য সরকারের বিরাগের শিকার হচ্ছেন সেসব অভিযোগ কি মিথ্যা? যে কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাদের মোবাইল কোর্টে বিচারের নামে জেলে ঢোকানো, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে মানুষকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা, জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের রহস্যময় আচরণ, সরকারি ও নানা ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে সরকারের বশংবদদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কথা বললে কিংবা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার বিষয়টি মনে করিয়ে দিলেই সরকারের মন্ত্রীরা অগি্নমূর্তি ধারণ করছেন, জেল খাটানোর ভয় দেখাচ্ছেন, হুমকি দিচ্ছেন, এমনকি অনেক বিশিষ্ট নাগরিকের নামের সঙ্গে শেল্গষাত্মক বিশেষণ জুড়ে দিচ্ছেন। সম্প্রতি বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যদের 'টোকাই' বলেছেন, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে বলেছেন 'কোথাকার কোন মনু মুহাম্মদ'। কৃষি বাজেট নিয়ে কথা বলায় কৃষিমন্ত্রী ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে 'সেনা-প্রিয়' ভট্টাচার্য বলে কটাক্ষ করেছেন, হরতালে মোবাইল কোর্টের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের আইনের ব্যাখ্যা দেওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলন করে লিমনের পায়ে গুলি করার খবরটি অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করার জন্য একজন সম্পাদককে হুমকি দিয়ে জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা বলে অভিহিত করেছেন।
গত দুই দশকে আমাদের এখানকার নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী প্রেশার গ্রুপ হিসেবে দাঁড়িয়েছেন, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশে অনুঘঠকের ভূমিকা পালন করছে। নাগরিক সমাজ তাদের চিন্তা দিয়ে সমাজকে প্রভাবিত করতে পারেন, বিশেষ করে তরুণদের যে আকৃষ্ট করতে পারেন তা অস্বীকার করা যাবে না। এসব নাগরিক তরুণ প্রজন্মকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পক্ষে, ইতিবাচক উপাদানগুলোকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। অনেক সময় তারা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে পরিবর্তনের পক্ষে সেখানের শিক্ষিত নাগরিক সমাজ বড় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু হালে বাংলাদেশের অবস্থা হলো আড়িয়ল বিলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষকে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে সর্বজনমান্য বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে জামিন চাইতে আদালতে যেতে হচ্ছে। ক্ষমতার আস্বাদ পাওয়ার আগে যাদের নিজ এলাকায় সামান্য কিছু লোকের মধ্যে পরিচয় সীমাবদ্ধ ছিল তারা আজ জাতীয় ব্যক্তিত্বদের হুমকি দিচ্ছেন, তাচ্ছিল্য করছেন, কটাক্ষ আর উপহাস করছেন। সংবাদপত্র-গণমাধ্যমকে একহাত দেখে নিচ্ছেন বা ক্রমাগত দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এ জন্য তারা দুটি অস্ত্র বেছে নিয়েছেন_ এক. মন্ত্রী-উপদেষ্টারা নাগরিক সমাজকে হয় ঠাট্টার পাত্র বানাচ্ছেন; দুই. নয়তো চোখ রাঙিয়ে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। দলের ভেতর থেকে অভিযোগ উঠছে কিছু মন্ত্রী-এমপি ঢাকার সচিবালয় কিংবা নিজ এলাকায় রাজা হয়ে গেছেন। এদের সংখ্যা বাড়ছে_ বিপদ এখানেই। সরকারের সব নেতা-মন্ত্রী এ ধরনের আচরণ করছেন তা নয়। অনেক মন্ত্রী রয়েছেন যারা কম কথা বলছেন, নিজের মন্ত্রণালয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন, তাদের সফলতায় মানুষের চোখ পড়ছে। কিন্তু অতিকথন আর ফালতু বকোয়াজিতে ওস্তাদ জনা কয়েক মন্ত্রী-নেতার আচরণ দলের সুনাম যে বাড়াচ্ছে না তা কিন্তু স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠরাও স্বীকার করবেন, সরকারের পায়ের নিচের মাটি নরম হয়ে যাচ্ছে। আজ সাহারা খাতুন আইনজীবী রফিক-উল হককে নিয়ে কটু কথা বলছেন। যদিও এটা নির্মম সত্য যে, রফিক-উল হক শুধু ক্যাঙ্গারু আদালতে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার পক্ষে লড়েননি। তিনি একটি সাজানো ও প্রহসনের বিচার প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষের সামনে উন্মোচন করেছেন যে, জরুরি অবস্থার সময় দেশে আইন ও বিচার মানে কর্নেল সাহেবের মনোবাঞ্ছনার বহিঃপ্রকাশ ছিল। এসব মানুষ সরকারের ভুল-ত্রুটির সমালোচনা করলেও তারা কখনোই জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক শক্তি, অস্ত্র ও পেশিশক্তির মদদদাতাদের মিত্র নন। এরা কখনোই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যাহত চেষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন না। এসব ব্যক্তি সরকারের কাজের সমালোচনা করছেন, কেননা তারা একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সংবিধান এবং নিরাপদ সমাজ চান। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সবাইকে শুধু তার সমর্থক-ভোটার হিসেবে দেখতে চায়, সমালোচক হিসেবে নয়। এ মানসিকতার জন্য তাকে মাঝে মধ্যে মাশুলও দিতে হয়।
লেখকবৃন্দ : উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী ও প্রকৌশলী
গত দুই দশকে আমাদের এখানকার নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী প্রেশার গ্রুপ হিসেবে দাঁড়িয়েছেন, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশে অনুঘঠকের ভূমিকা পালন করছে। নাগরিক সমাজ তাদের চিন্তা দিয়ে সমাজকে প্রভাবিত করতে পারেন, বিশেষ করে তরুণদের যে আকৃষ্ট করতে পারেন তা অস্বীকার করা যাবে না। এসব নাগরিক তরুণ প্রজন্মকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পক্ষে, ইতিবাচক উপাদানগুলোকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। অনেক সময় তারা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে পরিবর্তনের পক্ষে সেখানের শিক্ষিত নাগরিক সমাজ বড় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু হালে বাংলাদেশের অবস্থা হলো আড়িয়ল বিলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষকে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে সর্বজনমান্য বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে জামিন চাইতে আদালতে যেতে হচ্ছে। ক্ষমতার আস্বাদ পাওয়ার আগে যাদের নিজ এলাকায় সামান্য কিছু লোকের মধ্যে পরিচয় সীমাবদ্ধ ছিল তারা আজ জাতীয় ব্যক্তিত্বদের হুমকি দিচ্ছেন, তাচ্ছিল্য করছেন, কটাক্ষ আর উপহাস করছেন। সংবাদপত্র-গণমাধ্যমকে একহাত দেখে নিচ্ছেন বা ক্রমাগত দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এ জন্য তারা দুটি অস্ত্র বেছে নিয়েছেন_ এক. মন্ত্রী-উপদেষ্টারা নাগরিক সমাজকে হয় ঠাট্টার পাত্র বানাচ্ছেন; দুই. নয়তো চোখ রাঙিয়ে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। দলের ভেতর থেকে অভিযোগ উঠছে কিছু মন্ত্রী-এমপি ঢাকার সচিবালয় কিংবা নিজ এলাকায় রাজা হয়ে গেছেন। এদের সংখ্যা বাড়ছে_ বিপদ এখানেই। সরকারের সব নেতা-মন্ত্রী এ ধরনের আচরণ করছেন তা নয়। অনেক মন্ত্রী রয়েছেন যারা কম কথা বলছেন, নিজের মন্ত্রণালয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন, তাদের সফলতায় মানুষের চোখ পড়ছে। কিন্তু অতিকথন আর ফালতু বকোয়াজিতে ওস্তাদ জনা কয়েক মন্ত্রী-নেতার আচরণ দলের সুনাম যে বাড়াচ্ছে না তা কিন্তু স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠরাও স্বীকার করবেন, সরকারের পায়ের নিচের মাটি নরম হয়ে যাচ্ছে। আজ সাহারা খাতুন আইনজীবী রফিক-উল হককে নিয়ে কটু কথা বলছেন। যদিও এটা নির্মম সত্য যে, রফিক-উল হক শুধু ক্যাঙ্গারু আদালতে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার পক্ষে লড়েননি। তিনি একটি সাজানো ও প্রহসনের বিচার প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষের সামনে উন্মোচন করেছেন যে, জরুরি অবস্থার সময় দেশে আইন ও বিচার মানে কর্নেল সাহেবের মনোবাঞ্ছনার বহিঃপ্রকাশ ছিল। এসব মানুষ সরকারের ভুল-ত্রুটির সমালোচনা করলেও তারা কখনোই জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক শক্তি, অস্ত্র ও পেশিশক্তির মদদদাতাদের মিত্র নন। এরা কখনোই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যাহত চেষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন না। এসব ব্যক্তি সরকারের কাজের সমালোচনা করছেন, কেননা তারা একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সংবিধান এবং নিরাপদ সমাজ চান। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সবাইকে শুধু তার সমর্থক-ভোটার হিসেবে দেখতে চায়, সমালোচক হিসেবে নয়। এ মানসিকতার জন্য তাকে মাঝে মধ্যে মাশুলও দিতে হয়।
লেখকবৃন্দ : উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী ও প্রকৌশলী
No comments