এলডিসি সম্মেলন-ইস্তাম্বুল ঘোষণা আলো দেখাতে পারেনি by মহিউদ্দিন আহমদ
এশিয়া ও ইউরোপজুড়ে ১২৫ কিলোমিটার বিস্তৃত নগর ইস্তাম্বুলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নিয়ে জাতিসংঘের চতুর্থ সম্মেলন। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মিলনকেন্দ্র বসফোরাস প্রণালির তীরে এই বৈশ্বিক সম্মেলনে সমবেত হয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
উদ্দেশ্য একটাই—কীভাবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় উন্নয়নের চাকা সচল করে দারিদ্র্য দূর করা যায়।
স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিয়ে আলাদা একটি ব্লক গঠনের চিন্তা আসে ১৯৬৮ সালে। তখন ২৪টি দেশকে স্বল্পোন্নত হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলোর জন্য বিশেষ উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণের চিন্তা করা হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রথম সম্মেলন আয়োজন করেছিল ১৯৭১ সালে প্যারিস শহরে। বাংলাদেশ এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য তিনটি বিষয় জরুরি—মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও ঝুঁকি। এসব বিবেচনায় যে দেশগুলোর অবস্থান খুব নাজুক, সেগুলোকেই জাতিসংঘের পরিভাষায় স্বল্পোন্নত দেশ বলা হয়। ২০০০ সালে মাথাপিছু আয়ের সীমা ধরা হয়েছিল ৭৫৫ ডলার। ২০০৬ সালে এটা বাড়িয়ে ৯০০ ডলার করা হয়। এই তিনটি অনুষঙ্গের সব থাকলেই সেগুলোকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া ১৯৯১ সালে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় আনা হয় যে, দেশগুলোর কোনোটির মোট জনসংখ্যা ৭৫ মিলিয়নের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ও ইথিওপিয়ার জনসংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও দেশ দুটি স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে রয়ে যায়।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলার এবং অতিরিক্ত ২০ শতাংশ যোগ করে যা দাঁড়ায়, সে পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। একটি দেশ যদি উত্তরণের পর আবার স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে নেমে আসে, সে জন্য একটি পর্যবেক্ষণ পর্যায় অতিক্রম করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটা তিন থেকে ছয় বছর হতে পারে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, গত ৪০ বছরে জাতিসংঘ চারটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। দাতা দেশগুলো ও স্বল্পোন্নত দেশের সরকারগুলো উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য হাজার হাজার পৃষ্ঠার কৌশলপত্র রচনা করেছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয়নি। স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ। গত ৪০ বছরে মাত্র তিনটি দেশ কেপভার্দে, বতসোয়ানা ও মালদ্বীপ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এতেই বোঝা যায়, এসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় বড়সড় গোলমাল রয়ে গেছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বর্তমান জনসংখ্যা ৮৮ কোটি। আগামী দু-এক বছরে তা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এক হিসাবে দেখা গেছে, এই দেশগুলো ঋণের সুদ হিসেবে প্রতিবছর গড়ে ৭৫০ কোটি ডলার দেয় শিল্পোন্নত দেশগুলোকে। এ ছাড়া বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা তো রয়েছেই। এতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ছে।
২০০১ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে অনেক শিল্পোন্নত দেশের উচ্চপর্যায়ের নেতারা—যাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সরকারপ্রধান—তাঁরা যোগ দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পর্যাপ্ত সমর্থন দেওয়ার। একটি প্রতিশ্রুতি ছিল, দাতা দেশগুলো তাদের জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ সাহায্য দেবে শুধু স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে। সেই প্রতিশ্রুতি অধিকাংশ দেশই পালন করেনি।
এবারের ইস্তাম্বুল সম্মেলনে দাতা দেশগুলো থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন ইউএসএইডের ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। জি-৮-ভুক্ত অন্য দেশগুলোর আচরণও ছিল অনুরূপ। অর্থাৎ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য দাতা দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমর্থনের কার্যকর প্রতিফলন এ সম্মেলনে দেখা যায়নি।
স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে অনেক সরকারপ্রধান এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তবে তাঁদের কথাবার্তায় তেমন জোর ছিল না। তাঁরা শুধু সাহায্য চেয়েছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণের যে ব্যর্থতা, তার সমালোচনা করেননি। এটাও সত্য যে অধিকাংশ স্বল্পোন্নত দেশের সরকারগুলোর পেছনে জনসমর্থন নেই। অনেক দেশেই রয়েছে নানা রঙের সিভিল ও মিলিটারি একনায়কত্ব। এই সরকারগুলো জনগণের কথা চিন্তা করে কম, নিজেদের শানশওকত নিয়েই বেশি ব্যস্ত। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো বাংলাদেশ, যার জনসংখ্যা এসব দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। কিন্তু সম্মেলনে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিরা ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারেননি। সম্মেলন উপলক্ষে প্রতিদিন যে নিউজলেটার প্রকাশিত হতো, তাতে বাংলাদেশ ছিল লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত। অথচ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও কমপক্ষে পাঁচজন মন্ত্রী।
একই স্থানে পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়েছে নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক ফোরাম। এটা উদ্বোধন করেন জাতিসংঘের মহাসচিব। উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বর্তমান মুখপাত্র নেপালের প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নাগরিক সমাজের এই সম্মেলনে অনেক দেশের উচ্চপর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিরা এসেছেন, বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশ নিয়েছেন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা সুযোগটি তেমন কাজে লাগাননি।
নাগরিক সমাজের উদ্যোগে একটি ইন্টেলেকচুয়ালস ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ‘স্বল্পোন্নত’ শব্দটিকে অপমানজনক বিশেষণ হিসেবে চিহ্নিত করে এর পরিবর্তন দাবি করা হয়। নাগরিক সমাজের প্রস্তাব ছিল, এসব দেশকে বলা হোক ‘সর্বাধিক নির্যাতিত দেশ’ (মোস্ট এক্সপ্লোয়েটেড কান্ট্রি)। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি একজন শিক্ষাবিদ, তিনি এ প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন, তথাকথিত স্বল্পোন্নত দেশগুলো অনেক দিক দিয়ে খুব উন্নত। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কারণেই তাদের এই দুর্দশা।
সম্মেলনের শেষ দিন অর্থাৎ, ১৩ মে ঘোষণা করা হলো ‘ইস্তাম্বুল প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন’। এই কৌশলপত্র বাগাড়ম্বরে পরিপূর্ণ এবং দাতা দেশগুলো সত্যিকারের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি—ভবিষ্যতে তারা কে কী ভূমিকা নেবে, কতটুকু সহায়তা দেবে। নাগরিক সমাজের সমাপনী অধিবেশনটিও ওই দিন সকালে অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁরা ‘ইস্তাম্বুল ঘোষণা’ প্রকাশ করেন। এই ঘোষণায় জাতিসংঘের কৌশলপত্রকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া—এসব দেশের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ওই সব দেশের বর্তমান প্রাচুর্য ও ক্ষমতা বজায় রাখতে হলে তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্র্যের চাষ চালু রাখতে হবে। পশ্চিমের ভোগবাদী অর্থনীতির বিশেষত্ব হলো এই যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকেরা তাঁদের সস্তা শ্রম দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে যাবেন; আর পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকেরা তার বিনিময়ে তাঁদের শিল্পপণ্য চড়া দামে এ দেশগুলোর কাছে বিক্রি করবেন। এখানে সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতার কোনো স্থান নেই। আর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর এলিট শ্রেণী নিজেদের গোষ্ঠীর স্বার্থে একধরনের ভারসাম্য বজায় রেখে যাবে এবং ‘সেফটি নেট’ কর্মসূচি দিয়ে দুর্ভিক্ষ ঠেকিয়ে রাখবে।
ইস্তাম্বুল সম্মেলন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের তেমন আশার আলো দেখাতে পারেনি। জাতিসংঘের ঘোষণার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল আগামী ১০ বছরে কমপক্ষে অর্ধেকসংখ্যক অর্থাৎ, ২৪টি দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল দেশের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এই লক্ষ্য পূরণের জন্য যে ব্যাপক আয়োজন দরকার, প্রয়োজন যে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বৈশ্বিক অনুকূল পরিবেশ, তার একটি পরিষ্কার চিত্র এই সম্মেলনের কৌশলপত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সরকারগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের কাজগুলো ঠিকঠাক করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব নাগরিক সমাজের। কিন্তু অনেক দেশেই নাগরিক সমাজের জন্য সে সুযোগ নেই। এসব দেশে সরকারের জন্য জনগণ, জনগণের জন্য সরকার নয়।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com
স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিয়ে আলাদা একটি ব্লক গঠনের চিন্তা আসে ১৯৬৮ সালে। তখন ২৪টি দেশকে স্বল্পোন্নত হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলোর জন্য বিশেষ উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণের চিন্তা করা হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রথম সম্মেলন আয়োজন করেছিল ১৯৭১ সালে প্যারিস শহরে। বাংলাদেশ এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য তিনটি বিষয় জরুরি—মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও ঝুঁকি। এসব বিবেচনায় যে দেশগুলোর অবস্থান খুব নাজুক, সেগুলোকেই জাতিসংঘের পরিভাষায় স্বল্পোন্নত দেশ বলা হয়। ২০০০ সালে মাথাপিছু আয়ের সীমা ধরা হয়েছিল ৭৫৫ ডলার। ২০০৬ সালে এটা বাড়িয়ে ৯০০ ডলার করা হয়। এই তিনটি অনুষঙ্গের সব থাকলেই সেগুলোকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া ১৯৯১ সালে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় আনা হয় যে, দেশগুলোর কোনোটির মোট জনসংখ্যা ৭৫ মিলিয়নের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ও ইথিওপিয়ার জনসংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও দেশ দুটি স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে রয়ে যায়।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলার এবং অতিরিক্ত ২০ শতাংশ যোগ করে যা দাঁড়ায়, সে পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। একটি দেশ যদি উত্তরণের পর আবার স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে নেমে আসে, সে জন্য একটি পর্যবেক্ষণ পর্যায় অতিক্রম করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটা তিন থেকে ছয় বছর হতে পারে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, গত ৪০ বছরে জাতিসংঘ চারটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। দাতা দেশগুলো ও স্বল্পোন্নত দেশের সরকারগুলো উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য হাজার হাজার পৃষ্ঠার কৌশলপত্র রচনা করেছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয়নি। স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ। গত ৪০ বছরে মাত্র তিনটি দেশ কেপভার্দে, বতসোয়ানা ও মালদ্বীপ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এতেই বোঝা যায়, এসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় বড়সড় গোলমাল রয়ে গেছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বর্তমান জনসংখ্যা ৮৮ কোটি। আগামী দু-এক বছরে তা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এক হিসাবে দেখা গেছে, এই দেশগুলো ঋণের সুদ হিসেবে প্রতিবছর গড়ে ৭৫০ কোটি ডলার দেয় শিল্পোন্নত দেশগুলোকে। এ ছাড়া বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা তো রয়েছেই। এতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ছে।
২০০১ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে অনেক শিল্পোন্নত দেশের উচ্চপর্যায়ের নেতারা—যাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সরকারপ্রধান—তাঁরা যোগ দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পর্যাপ্ত সমর্থন দেওয়ার। একটি প্রতিশ্রুতি ছিল, দাতা দেশগুলো তাদের জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ সাহায্য দেবে শুধু স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে। সেই প্রতিশ্রুতি অধিকাংশ দেশই পালন করেনি।
এবারের ইস্তাম্বুল সম্মেলনে দাতা দেশগুলো থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন ইউএসএইডের ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। জি-৮-ভুক্ত অন্য দেশগুলোর আচরণও ছিল অনুরূপ। অর্থাৎ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য দাতা দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমর্থনের কার্যকর প্রতিফলন এ সম্মেলনে দেখা যায়নি।
স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে অনেক সরকারপ্রধান এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তবে তাঁদের কথাবার্তায় তেমন জোর ছিল না। তাঁরা শুধু সাহায্য চেয়েছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণের যে ব্যর্থতা, তার সমালোচনা করেননি। এটাও সত্য যে অধিকাংশ স্বল্পোন্নত দেশের সরকারগুলোর পেছনে জনসমর্থন নেই। অনেক দেশেই রয়েছে নানা রঙের সিভিল ও মিলিটারি একনায়কত্ব। এই সরকারগুলো জনগণের কথা চিন্তা করে কম, নিজেদের শানশওকত নিয়েই বেশি ব্যস্ত। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো বাংলাদেশ, যার জনসংখ্যা এসব দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। কিন্তু সম্মেলনে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিরা ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারেননি। সম্মেলন উপলক্ষে প্রতিদিন যে নিউজলেটার প্রকাশিত হতো, তাতে বাংলাদেশ ছিল লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত। অথচ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও কমপক্ষে পাঁচজন মন্ত্রী।
একই স্থানে পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়েছে নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক ফোরাম। এটা উদ্বোধন করেন জাতিসংঘের মহাসচিব। উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বর্তমান মুখপাত্র নেপালের প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নাগরিক সমাজের এই সম্মেলনে অনেক দেশের উচ্চপর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিরা এসেছেন, বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশ নিয়েছেন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা সুযোগটি তেমন কাজে লাগাননি।
নাগরিক সমাজের উদ্যোগে একটি ইন্টেলেকচুয়ালস ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ‘স্বল্পোন্নত’ শব্দটিকে অপমানজনক বিশেষণ হিসেবে চিহ্নিত করে এর পরিবর্তন দাবি করা হয়। নাগরিক সমাজের প্রস্তাব ছিল, এসব দেশকে বলা হোক ‘সর্বাধিক নির্যাতিত দেশ’ (মোস্ট এক্সপ্লোয়েটেড কান্ট্রি)। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি একজন শিক্ষাবিদ, তিনি এ প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন, তথাকথিত স্বল্পোন্নত দেশগুলো অনেক দিক দিয়ে খুব উন্নত। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কারণেই তাদের এই দুর্দশা।
সম্মেলনের শেষ দিন অর্থাৎ, ১৩ মে ঘোষণা করা হলো ‘ইস্তাম্বুল প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন’। এই কৌশলপত্র বাগাড়ম্বরে পরিপূর্ণ এবং দাতা দেশগুলো সত্যিকারের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি—ভবিষ্যতে তারা কে কী ভূমিকা নেবে, কতটুকু সহায়তা দেবে। নাগরিক সমাজের সমাপনী অধিবেশনটিও ওই দিন সকালে অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁরা ‘ইস্তাম্বুল ঘোষণা’ প্রকাশ করেন। এই ঘোষণায় জাতিসংঘের কৌশলপত্রকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া—এসব দেশের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ওই সব দেশের বর্তমান প্রাচুর্য ও ক্ষমতা বজায় রাখতে হলে তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্র্যের চাষ চালু রাখতে হবে। পশ্চিমের ভোগবাদী অর্থনীতির বিশেষত্ব হলো এই যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকেরা তাঁদের সস্তা শ্রম দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে যাবেন; আর পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকেরা তার বিনিময়ে তাঁদের শিল্পপণ্য চড়া দামে এ দেশগুলোর কাছে বিক্রি করবেন। এখানে সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতার কোনো স্থান নেই। আর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর এলিট শ্রেণী নিজেদের গোষ্ঠীর স্বার্থে একধরনের ভারসাম্য বজায় রেখে যাবে এবং ‘সেফটি নেট’ কর্মসূচি দিয়ে দুর্ভিক্ষ ঠেকিয়ে রাখবে।
ইস্তাম্বুল সম্মেলন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের তেমন আশার আলো দেখাতে পারেনি। জাতিসংঘের ঘোষণার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল আগামী ১০ বছরে কমপক্ষে অর্ধেকসংখ্যক অর্থাৎ, ২৪টি দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল দেশের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এই লক্ষ্য পূরণের জন্য যে ব্যাপক আয়োজন দরকার, প্রয়োজন যে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বৈশ্বিক অনুকূল পরিবেশ, তার একটি পরিষ্কার চিত্র এই সম্মেলনের কৌশলপত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সরকারগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের কাজগুলো ঠিকঠাক করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করার দায়িত্ব নাগরিক সমাজের। কিন্তু অনেক দেশেই নাগরিক সমাজের জন্য সে সুযোগ নেই। এসব দেশে সরকারের জন্য জনগণ, জনগণের জন্য সরকার নয়।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com
No comments