বিদ্যুৎ নেই, মরে যাচ্ছে শিল্পকারখানা by আবুল কাশেম
চলতি অর্থবছরে পর পর তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এ নিয়ে গত তিন বছরে পাঁচবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। দেশের শিল্প খাত অবশ্য তাতেও কাবু হয়নি। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের চাওয়া একটাই, দাম দিয়ে হলেও বিদ্যুৎ চাই। উৎপাদন অব্যাহত থাকলে দাম বাড়ার প্রতিকূলতা কাটানো সম্ভব হবে।
বাস্তবতা হলো, কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ টাকা দিয়েও মিলছে না। বিদ্যুৎ দিতে পারছে না সরকার। এ অবস্থায় আবার নির্দেশনা, সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে। কোনো বিদ্যুৎ খরচ করা যাবে না। এ নিয়ে শিল্প মালিকদের যথেষ্ট প্রতিবাদ-অসন্তোষ থাকলেও বাকি সময়টায় উৎপাদন সচলের একটা চেষ্টা ছিল। কিন্তু হা-হতোস্মি! দিনের বেলাতেও কারখানা সার্বক্ষণিক সচল রাখার সুযোগ নেই।
সকালে বিদ্যুৎ আসার পর বন্ধ কারখানা চালু করতেই কেটে যায় ঘণ্টাখানেক। তারপর উৎপাদন শুরু হতে না হতেই নেমে আসে লোডশেডিংয়ের খৰ। বিদ্যুতের অভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অচল হয়ে থাকে শিল্পের চাকা। বিকল্প হিসেবে জেনারেটর চালানোরও সুযোগ নেই। কারণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চাপে গ্যাসের সরবরাহ নেই। আবার ডিজেল বা ফার্নেস অয়েলের দামও সরকার টেনে তুলেছে অনেক ওপরে। এ অবস্থায় এ দুটি জ্বালানি দিয়ে জেনারেটর চালাতে গেলে শিল্পের উৎপাদন মূল্য পোষানো সম্ভব নয়। অগত্যা শিল্পের চাকা বন্ধ, উৎপাদন বন্ধ। পথে বসার উপক্রম শিল্প মালিকদের।
এদিকে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বিকল হয়ে পড়ছে মূল্যবান মেশিনারি। উৎপাদিত পণ্যের মানও হচ্ছে খারাপ। রাতে ১২ ঘণ্টা শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্তের পর সরাসরি সংযোগ লাইন রয়েছে এমন প্রায় ৩০০ বৃহৎ কারখানায় রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ কেন্দ্রীয়ভাবেই বন্ধ করে দিচ্ছে পিডিবি।
শিল্প মালিকরা বলছেন, বিদ্যুতের অভাবে কারখানার উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ ভাগই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। জেনারেটরও চলে না গ্যাসের চাপের অভাবে। এ অবস্থায় অস্তিত্বের স্বার্থে ডিজেল দিয়ে কোনোমতে কারখানা চালু রাখছেন তাঁরা। এতে বড় বড় কারখানাগুলোকে ডিজেল কিনতেই খরচ করতে হচ্ছে কোটি টাকা। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ, কমছে উৎপাদনের পরিমাণও। রপ্তানিমুখী খাতগুলো বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহ-সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকারের তথ্য অনুযায়ী তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। তার পরও ১২ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে কখনো ১২ ঘণ্টা কারখানা বন্ধ রাখার কথা বলা হয়নি। তাহলে বর্ধিত তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গেল কোথায়?
তিনি জানান, অনেক কারখানায় প্রতি আট ঘণ্টায় এক শিফট হিসাব করে তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা কাজ চলে। সেখানে কারখানাগুলো ১২ ঘণ্টা বন্ধ রাখলে ওই সময় যেসব শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করে তাদের উপায় কী হবে? শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে, নাকি চাকরিচ্যুত করবে- সে সিদ্ধান্তও সরকারকে দিতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ইতিমধ্যে শিল্প খাতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। রপ্তানি বাজার হাতছাড়া হয়ে যাবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়ায় স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব পণ্যের দাম বাড়বে। এতে জনজীবনেও বিপর্যয় নেমে আসবে।
রপ্তানিকারকদের সংগঠন এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, লোডশেডিংয়ের কারণে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শিল্প ও রপ্তানি খাত। এ অবস্থা চলতে থাকলে রপ্তানি আয় আরো কমার আশঙ্কা রয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে দুটি শর্ত হলো- পণ্যের মান ঠিক রাখা ও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এর কোনোটিই সম্ভব হচ্ছে না।
তৈরি পোশাক শিল্প : বিদ্যুৎ সংকটে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে স্থবিরতা নেমে আসতে শুরু করেছে। আগের রপ্তানি অর্ডার ধরে রাখতে ব্যবসায়ীদের ডিজেল খরচ দ্বিগুণ করতে হচ্ছে। এতে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়া তো বটেই, লোকসানের শঙ্কা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
পোশাক খাতের অন্যতম বৃহৎ কারখানা ওশান গ্রুপের স্বত্বাধিকারী তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, সরকার রাতের বেলায় কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও দিনের ১২ ঘণ্টায় বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এতে উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে অনেক। বিদ্যুৎ সংকটে কী সংখ্যক কারখানা বন্ধ হচ্ছে বিজিএমইএ সে তথ্য সংগ্রহ করছে।
ওষুধ শিল্প খাত : ওষুধ শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকায় উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে ২০ শতাংশের মতো।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি ও জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কর্ণধার ড. মোমিনুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ওষুধ শিল্প ধ্বংসের প্রান্তে। কারখানাগুলোর জেনারেটর পাঁচ-ছয় ঘণ্টা চালানোর পর বন্ধ হয়ে যায়। তবুও বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। অথচ ওষুধ কারখানাগুলো ২৪ ঘণ্টা সচল না রাখলে উৎপাদন সম্ভব হয় না। কোনো ওষুধ তৈরির পর মেশিন কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকলে তা পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়। পরে মেশিন পরিষ্কার করে আবার উৎপাদনে যেতে পাঁচ-ছয় দিন সময় লাগে। গ্যাসের চাপ না থাকায় জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালকে মাসে এক কোটি টাকার ডিজেল কিনতে হয়। সার্বিকভাবে ওষুধ শিল্পের অবস্থা নাজুক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে মালিকদের পথে বসতে হবে।
চামড়া শিল্প : চামড়া শিল্প ব্যবসায়ীরা বিদেশি ক্রেতার অর্ডার বাতিল করতে শুরু করেছেন। কারণ বিদ্যুতের সংকটে তাঁরা কারখানা সচল রাখতে পারছেন না।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মেসার্স করিম লেদারস লিমিটেডের কর্ণধার রেজাউল করিম আনসারী জানান, ইতালির একটি প্রতিষ্ঠান তাঁর কারখানা থেকে প্রতি বর্গফুট এক দশমিক ছয় ডলার দরে চার লাখ বর্গফুট ফিনিশড লেদার আমদানির চুক্তি করেছে। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে ওই অর্ডার বাতিল করতে হচ্ছে। তিনি জানান, বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কারখানা চালু রাখা সম্ভব হবে না।
সিমেন্ট শিল্প : বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন সংকটের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে সিমেন্ট রপ্তানি। এখন কারখানাগুলো স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে পারবে কি-না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ বিশাল কলেবরের সিমেন্ট কারখানা ডিজেলচালিত জেনারেটরে সচল রাখা সম্ভব নয়। আর জেনারেটর চালানোর মতো গ্যাসও পাওয়া যায় না পাইপলাইনে। অনেক কারখানাতেই দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে শ্রমিকরা কাজ করেন। রাতের বেলায় শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখায় এ ধরনের শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছেন না। বেকার হয়ে পড়া এসব শ্রমিক এক পর্যায়ে ফুঁসে উঠতে পারেন- এমন আশঙ্কা শিল্পমালিকদের।
এমআই সিমেন্ট কারখানার মালিক আলমগীর কবির জানান, 'সরকারের নির্দেশে রাতে কারখানা বন্ধ। সকালে বিদ্যুৎ পাওয়ার পর বন্ধ কারখানা চালু করতে এক ঘণ্টা চলে যায়। বাকি ১১ ঘণ্টার মধ্যেও দু-তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশ এমনিতেই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ফলে আমরা এখন আর ঠিকমতো সিমেন্ট রপ্তানি করতে পারছি না। এতে সিমেন্ট শিল্প মালিকদের বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হচ্ছে। আগামী ১৫ দিন বিদ্যুতের এ অবস্থা থাকলে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এতে রপ্তানির বদলে সিমেন্ট আমদানি করতে হবে।'
চাহিদা নিয়ে লুকোচুরি : পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের ৩১ মার্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। ওইদিন সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল তিন হাজার ৮০৯ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৩২৬ মেগাওয়াট। পরবর্তী বছরের ওইদিন বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয় আগের বছরের তুলনায় অনেক কম- চার হাজার ৯৫০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল চার হাজার ৬১২ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয় ৪৮৮ মেগাওয়াট। আর গত ৩১ মার্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল চার হাজার ৯৭৯ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয়েছে ৯২০ মেগাওয়াট। বর্তমান বছরে বিদ্যুতের এই ঘোষিত চাহিদা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কেননা গত তিন বছরে মোট ২১ লাখ গ্রাহককে নতুন করে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। অথচ চাহিদা বেড়েছে মাত্র ১৪০০ মেগাওয়াট।
পিডিবি ব্যস্ত কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে : দেশব্যাপী বিদ্যুৎ সংকটের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কালের কণ্ঠের কথা হয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মেম্বার (বিতরণ) আবদুল ওয়াহাব খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাতে ১২ ঘণ্টা কারখানা বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের পর যারা সরাসরি সঞ্চালন লাইন নিয়েছেন সেগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায়ই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ অফিস থেকে। এর মধ্যে টিকে গ্রুপ, সোনারগাঁও টেঙ্টাইলসহ এ ধরনের বড় বড় কারখানা রয়েছে। এতে প্রায় দুই শ থেকে আড়াই শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। তবে বিভিন্ন রাস্তা ও গলির কারখানাগুলোতে এ সিদ্ধান্ত এখনো কার্যকর করা যায়নি। এসব কারখানাও বন্ধের উপায় নিয়ে পিডিবি ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই বিদ্যুৎ সেক্টর নিয়ে বড় বড় আশার বাণী শুনিয়েছিল। ঘোষণা দেওয়া হয় ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করার। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া হয় মহাপরিকল্পনা। সরকার প্রতিবছর বাজেটে বিপুল অংকের অর্থ ভর্তুকি রাখছে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য। বিপুল ব্যয় সত্ত্বেও ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনছে সরকার। এতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি যাচ্ছে শুধু এ খাতেই। তা সত্ত্বেও জাতীয় গ্রিডে চাহিদা ও জোগানের ফাঁরাক কমেনি।
সকালে বিদ্যুৎ আসার পর বন্ধ কারখানা চালু করতেই কেটে যায় ঘণ্টাখানেক। তারপর উৎপাদন শুরু হতে না হতেই নেমে আসে লোডশেডিংয়ের খৰ। বিদ্যুতের অভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অচল হয়ে থাকে শিল্পের চাকা। বিকল্প হিসেবে জেনারেটর চালানোরও সুযোগ নেই। কারণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চাপে গ্যাসের সরবরাহ নেই। আবার ডিজেল বা ফার্নেস অয়েলের দামও সরকার টেনে তুলেছে অনেক ওপরে। এ অবস্থায় এ দুটি জ্বালানি দিয়ে জেনারেটর চালাতে গেলে শিল্পের উৎপাদন মূল্য পোষানো সম্ভব নয়। অগত্যা শিল্পের চাকা বন্ধ, উৎপাদন বন্ধ। পথে বসার উপক্রম শিল্প মালিকদের।
এদিকে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বিকল হয়ে পড়ছে মূল্যবান মেশিনারি। উৎপাদিত পণ্যের মানও হচ্ছে খারাপ। রাতে ১২ ঘণ্টা শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্তের পর সরাসরি সংযোগ লাইন রয়েছে এমন প্রায় ৩০০ বৃহৎ কারখানায় রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ কেন্দ্রীয়ভাবেই বন্ধ করে দিচ্ছে পিডিবি।
শিল্প মালিকরা বলছেন, বিদ্যুতের অভাবে কারখানার উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ ভাগই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। জেনারেটরও চলে না গ্যাসের চাপের অভাবে। এ অবস্থায় অস্তিত্বের স্বার্থে ডিজেল দিয়ে কোনোমতে কারখানা চালু রাখছেন তাঁরা। এতে বড় বড় কারখানাগুলোকে ডিজেল কিনতেই খরচ করতে হচ্ছে কোটি টাকা। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ, কমছে উৎপাদনের পরিমাণও। রপ্তানিমুখী খাতগুলো বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহ-সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকারের তথ্য অনুযায়ী তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। তার পরও ১২ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে কখনো ১২ ঘণ্টা কারখানা বন্ধ রাখার কথা বলা হয়নি। তাহলে বর্ধিত তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গেল কোথায়?
তিনি জানান, অনেক কারখানায় প্রতি আট ঘণ্টায় এক শিফট হিসাব করে তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা কাজ চলে। সেখানে কারখানাগুলো ১২ ঘণ্টা বন্ধ রাখলে ওই সময় যেসব শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করে তাদের উপায় কী হবে? শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে, নাকি চাকরিচ্যুত করবে- সে সিদ্ধান্তও সরকারকে দিতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ইতিমধ্যে শিল্প খাতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। রপ্তানি বাজার হাতছাড়া হয়ে যাবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়ায় স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব পণ্যের দাম বাড়বে। এতে জনজীবনেও বিপর্যয় নেমে আসবে।
রপ্তানিকারকদের সংগঠন এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, লোডশেডিংয়ের কারণে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শিল্প ও রপ্তানি খাত। এ অবস্থা চলতে থাকলে রপ্তানি আয় আরো কমার আশঙ্কা রয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে দুটি শর্ত হলো- পণ্যের মান ঠিক রাখা ও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এর কোনোটিই সম্ভব হচ্ছে না।
তৈরি পোশাক শিল্প : বিদ্যুৎ সংকটে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে স্থবিরতা নেমে আসতে শুরু করেছে। আগের রপ্তানি অর্ডার ধরে রাখতে ব্যবসায়ীদের ডিজেল খরচ দ্বিগুণ করতে হচ্ছে। এতে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়া তো বটেই, লোকসানের শঙ্কা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
পোশাক খাতের অন্যতম বৃহৎ কারখানা ওশান গ্রুপের স্বত্বাধিকারী তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, সরকার রাতের বেলায় কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও দিনের ১২ ঘণ্টায় বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এতে উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে অনেক। বিদ্যুৎ সংকটে কী সংখ্যক কারখানা বন্ধ হচ্ছে বিজিএমইএ সে তথ্য সংগ্রহ করছে।
ওষুধ শিল্প খাত : ওষুধ শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকায় উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে ২০ শতাংশের মতো।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি ও জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কর্ণধার ড. মোমিনুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ওষুধ শিল্প ধ্বংসের প্রান্তে। কারখানাগুলোর জেনারেটর পাঁচ-ছয় ঘণ্টা চালানোর পর বন্ধ হয়ে যায়। তবুও বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। অথচ ওষুধ কারখানাগুলো ২৪ ঘণ্টা সচল না রাখলে উৎপাদন সম্ভব হয় না। কোনো ওষুধ তৈরির পর মেশিন কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকলে তা পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়। পরে মেশিন পরিষ্কার করে আবার উৎপাদনে যেতে পাঁচ-ছয় দিন সময় লাগে। গ্যাসের চাপ না থাকায় জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালকে মাসে এক কোটি টাকার ডিজেল কিনতে হয়। সার্বিকভাবে ওষুধ শিল্পের অবস্থা নাজুক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে মালিকদের পথে বসতে হবে।
চামড়া শিল্প : চামড়া শিল্প ব্যবসায়ীরা বিদেশি ক্রেতার অর্ডার বাতিল করতে শুরু করেছেন। কারণ বিদ্যুতের সংকটে তাঁরা কারখানা সচল রাখতে পারছেন না।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মেসার্স করিম লেদারস লিমিটেডের কর্ণধার রেজাউল করিম আনসারী জানান, ইতালির একটি প্রতিষ্ঠান তাঁর কারখানা থেকে প্রতি বর্গফুট এক দশমিক ছয় ডলার দরে চার লাখ বর্গফুট ফিনিশড লেদার আমদানির চুক্তি করেছে। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে ওই অর্ডার বাতিল করতে হচ্ছে। তিনি জানান, বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কারখানা চালু রাখা সম্ভব হবে না।
সিমেন্ট শিল্প : বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন সংকটের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে সিমেন্ট রপ্তানি। এখন কারখানাগুলো স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে পারবে কি-না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ বিশাল কলেবরের সিমেন্ট কারখানা ডিজেলচালিত জেনারেটরে সচল রাখা সম্ভব নয়। আর জেনারেটর চালানোর মতো গ্যাসও পাওয়া যায় না পাইপলাইনে। অনেক কারখানাতেই দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে শ্রমিকরা কাজ করেন। রাতের বেলায় শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখায় এ ধরনের শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছেন না। বেকার হয়ে পড়া এসব শ্রমিক এক পর্যায়ে ফুঁসে উঠতে পারেন- এমন আশঙ্কা শিল্পমালিকদের।
এমআই সিমেন্ট কারখানার মালিক আলমগীর কবির জানান, 'সরকারের নির্দেশে রাতে কারখানা বন্ধ। সকালে বিদ্যুৎ পাওয়ার পর বন্ধ কারখানা চালু করতে এক ঘণ্টা চলে যায়। বাকি ১১ ঘণ্টার মধ্যেও দু-তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। ফলে উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশ এমনিতেই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ফলে আমরা এখন আর ঠিকমতো সিমেন্ট রপ্তানি করতে পারছি না। এতে সিমেন্ট শিল্প মালিকদের বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হচ্ছে। আগামী ১৫ দিন বিদ্যুতের এ অবস্থা থাকলে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এতে রপ্তানির বদলে সিমেন্ট আমদানি করতে হবে।'
চাহিদা নিয়ে লুকোচুরি : পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের ৩১ মার্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। ওইদিন সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল তিন হাজার ৮০৯ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৩২৬ মেগাওয়াট। পরবর্তী বছরের ওইদিন বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয় আগের বছরের তুলনায় অনেক কম- চার হাজার ৯৫০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল চার হাজার ৬১২ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয় ৪৮৮ মেগাওয়াট। আর গত ৩১ মার্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল চার হাজার ৯৭৯ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয়েছে ৯২০ মেগাওয়াট। বর্তমান বছরে বিদ্যুতের এই ঘোষিত চাহিদা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কেননা গত তিন বছরে মোট ২১ লাখ গ্রাহককে নতুন করে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। অথচ চাহিদা বেড়েছে মাত্র ১৪০০ মেগাওয়াট।
পিডিবি ব্যস্ত কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে : দেশব্যাপী বিদ্যুৎ সংকটের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কালের কণ্ঠের কথা হয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মেম্বার (বিতরণ) আবদুল ওয়াহাব খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাতে ১২ ঘণ্টা কারখানা বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের পর যারা সরাসরি সঞ্চালন লাইন নিয়েছেন সেগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায়ই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ অফিস থেকে। এর মধ্যে টিকে গ্রুপ, সোনারগাঁও টেঙ্টাইলসহ এ ধরনের বড় বড় কারখানা রয়েছে। এতে প্রায় দুই শ থেকে আড়াই শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। তবে বিভিন্ন রাস্তা ও গলির কারখানাগুলোতে এ সিদ্ধান্ত এখনো কার্যকর করা যায়নি। এসব কারখানাও বন্ধের উপায় নিয়ে পিডিবি ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই বিদ্যুৎ সেক্টর নিয়ে বড় বড় আশার বাণী শুনিয়েছিল। ঘোষণা দেওয়া হয় ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে লোডশেডিংমুক্ত করার। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া হয় মহাপরিকল্পনা। সরকার প্রতিবছর বাজেটে বিপুল অংকের অর্থ ভর্তুকি রাখছে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য। বিপুল ব্যয় সত্ত্বেও ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনছে সরকার। এতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি যাচ্ছে শুধু এ খাতেই। তা সত্ত্বেও জাতীয় গ্রিডে চাহিদা ও জোগানের ফাঁরাক কমেনি।
No comments